সম্ভাবনার পরিতৃপ্তি

By শাহীন আহম্মেদ - শীর্ষ নির্বাহী ও ডিজাইনার, অঞ্জন’স
17 July 2016, 10:11 AM
UPDATED 8 August 2016, 17:08 PM

ছোটবেলায় নিশ্চিত ছিলাম না যে, আমি পোশাক নিয়েই কাজ করব। যদিও পারিবারিক ব্যবসা ছিল টেক্সটাইলের। বড় হয়েছি নরসিংদীতে। ঢাকায় চলে এসেছিলাম পড়তে, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ম্যাট্রিক শেষ করে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ইন্টারমিডিয়েট, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে ¯স্নাতক। ওই সময়েই এক রমজানে ভাবলাম, ছুটির এই সময়টাতে কিছু করি। ১৯৯৪ সাল তখন। মালিবাগে আমাদের একটা খালি শো-রুম ছিল। সেখানেই নরসিংদীর সুতি কাপড়ের কিছু পাঞ্জাবি আর সালোয়ার-কামিজের প্রদর্শনীর আয়োজন করলাম একদিন। মিরপুরে এম্ব্রয়ডারির কাজ করিয়ে নিয়েছিলাম। খুবই ইতিবাচক সাড়া পেলাম সেই প্রদর্শনীতে। ওটাই সাহস জোগাল, শো-রুমটা থাকুক। তখন সেলসম্যান ছিল না, বন্ধুরাই দোকানে কাপড় বিক্রি করতে সাহায্য করত। আমাদের টেক্সটাইল থেকেই সাহায্য পেলাম। এভাবে চলল অনেকদিন। ১৯৯৮ সালে সোবহানবাগে দ্বিতীয় শো-রুমে ওঠার সময়েই অঞ্জন’সকে নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া। বাবা একটু মনঃক্ষুণ হয়েছিলেন। তিনি চাইতেন আমি যেন নিজেদের টেক্সটাইলের হাল ধরি। কিন্তু আমি ততদিনে নিজে কিছু করতে পারার স্বপ্ন আর সম্ভাবনায় বিভোর।

panjabi - anjans

সোবহানবাগে অঞ্জন’স, ওজি আর কে-ক্র্যাফটের দোকানগুলো ছিল পাশাপাশি।  দিনে দিনে ক্রেতাদের লাইন বাড়তে থাকল। আর আমাদের মাঝেও শুরু হলো প্রতিযোগিতা। কে কত ভালো করতে পারে। তখন প্রচুর ফ্যাশন প্রতিযোগিতা হতো। অন্যদিন, অনন্যা ও বিচিত্রার মতো পত্রিকায়। এমন এক সময়ে আমাদের সঙ্গে একজন ডিজাইনার যোগ দেয়। তার সঙ্গে সারারাত জেগে প্রতিযোগিতার পোশাকের ডিজাইন করতাম। শেষদিকে পোশাকগুলো কোনো না কোনো একটা জায়গায় থাকত।

shari - anajns

২০০৩ সাল পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা চলল আর দুইয়ে আমরা চ্যাম্পিয়ন অব দ্য ইয়ার হই। সে বছর  অন্যদিন বেক্সিফেব্রিক্স প্রতিযোগিতায় বেস্ট ফ্যাশন হাউস। একটি ব্যাপারেই আমাদের বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছে, কাঁচামাল সংগ্রহ। এখন যেমন পত্রিকা পড়েই অনেক কিছু জেনে ফেলা যায়, তখন তো এমন কিছু ছিল না। ফ্যাশন পত্রিকা বলতে কিছু ম্যাগাজিন আর জনকণ্ঠের একটা ফ্যাশন পাতা। সেই খবরগুলোও হতো ঈদকেন্দ্রিক। সেই কাজগুলো করতে গিয়েই মিরপুর, জামালপুর, ফরিদপুরের কাজ ও শ্রমিক খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়েছে। তবে সেই কাজেও একটা অন্যরকম আনন্দ মিশে থাকত। ডিজাইনের চর্চা করতে করতেই আমরা কাপড় চিনলাম, ফ্যাশনেবল কাপড় বানাতে শিখলাম। সারা বছর এক্সপেরিমেন্ট করে করে সিজনে এসে তার প্রতিফলন দেখা যেত। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সেই চর্চা এখনো চলছে।
এভাবেই অঞ্জন’সের সঙ্গে নিজের নাম মিশে যাওয়া। কাজের মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই এখন। তবুও বই পড়ি অবসর পেলেই। আগেও এই শখ ছিল। এখনো সময় পেলেই গাড়িতে বসে পাতা উল্টাই। জানিয়ে রাখি, সেই ক্লাস টেন থেকে আজ পর্যন্ত আমি একটিও বইমেলায় না গিয়ে এবং বই না কিনে থাকতে পারিনি। দুই ছেলের সঙ্গে ঘোরাঘুরি আরেকটি পছন্দের কাজ। দেশে এবং বিদেশে। অসম্ভব পছন্দের আরেকটি কাজ হলোÑ টিভি দেখা। হালকা কোনো অনুষ্ঠান অবশ্যই।
সবার জন্য পোশাক বানাতে বানাতে নিজের পোশাকের দিকে খুব কমই নজর দেয়া হয় এখন। আগে অনেক অনেক পাঞ্জাবি পরতাম। অঞ্জন’সের জন্য পাঞ্জাবি বানাতে বানাতে নিজে পাঞ্জাবি পরার হার নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। হালকা এবং উজ্জ্বল যেকোনো শার্ট, পোলো শার্ট আর টি-শার্টের সঙ্গে জিন্স, এই-ই এখন আমার পছন্দের পোশাক।

salowar - anjans

ঈদ এলেই ছোটবেলায় নিজে ঈদ পোশাক কেনার কিছু মজার স্মৃতি মনে পড়ে। ক্লাস টেনে পড়ার সময় আমি আর এক কাজিন মিলে এলিফ্যান্ট রোডে গিয়েছি ঈদের কাপড় কিনতে। তখন যে বিষয়টি বেশি কাজ করত তাহলো কম দাম হলে হবে না। যত বেশি দাম, তত ভালো জামা। এভাবে দামি পোশাক খুঁজতে খুঁজতে কালোর মধ্যে অনেকটা ইক্কত প্রিন্টের কাজওয়ালা একটা শার্ট কিনলাম। ঈদের পরে ওটা পরে গেলাম স্কুলে। এক বন্ধু ছিল একটু পাগলা স্বভাবের। তার শার্টটা এত পছন্দ হয়েছিল যে, বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েই খুলে দিতে হয়েছিল। সে তক্ষুণি পরবে সেটা!

saloar - anjans

সত্যি বলতে কী, আমার অনুপ্রেরণার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে ওই প্রতিযোগিতাগুলো। তবে মূল অনুপ্রেরণা আমার ক্রেতারা। গর্বভরে স্বীকার করি এই কথাটা। ওই প্রতিযোগিতায় প্রকাশিত ছবিগুলো নিয়ে ক্রেতারা দোকানে চলে আসতেন। তখন পোশাকের কপি হতো না বললেই চলে। একবার এক বৃদ্ধ মহিলা আর এক তরুণের মধ্যে একটি পাঞ্জাবি নিয়েই চরম বচসা শুরু হলো। সেটা মিটিয়ে দিতে হয়েছিল। আরেকবার এক কিশোর পছন্দের স্প্রে করা পাঞ্জাবি বিক্রি হয়ে গেছে শুনে কেঁদে ভাসিয়ে ফেলেছিল। দেখে এত মায়া হলো আমার ডিজাইনারের, রাতারাতি তাকে আরেকটি কপি বানিয়ে ঈদের আগের দিন সরবরাহ করা হলো। ছোট্ট শো-রুম ছিল, গুনে গুনে বিশজন ঢুকতে দিতে বাধ্য হতাম। ক্রেতারা এসে ঈদের কার্ড দিয়ে যেত, বাসায় দাওয়াত দিয়ে যেত। এখনো ওই সময়গুলোতে বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। অঞ্জন’স অনেক বড় হয়েছে। সারাদেশেই আমার ভোক্তারা ছড়িয়ে রয়েছে। নানা পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। ক্রেতাদের আমরা চেষ্টা করছি সেরা প্রডাক্ট দিতে। যাতে তারা অন্তত অনুভব করে দেশি পণ্য কিনে তারা সত্যিই ধন্য হয়েছেন। বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরতা যাতে কমে, দেশের টাকা দেশে থাকে সেজন্য চেষ্টা করি। এমনকি আমরা যত ছোট পরিসরেই হোক না কেন, দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পারছি। এটাও আমাকে বিশেষভাবে তৃপ্তি দেয়। ভবিষ্যতে অঞ্জন’কে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন আমি দেখি। আমার স্ত্রী লায়লা খায়ের কনক নানাভাবেই সহায়তা করেন। তিনি জুয়েলারি ডিজাইনার হিসেবে সিঙ্গাপুর থেকে ডিপ্লোমা করেছেন। আমি বলতে পারি এটা ব্র্যান্ড অঞ্জন’স-এর বিরাট অর্জন। আজ এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে অবশ্যই তৃপ্ত। তবে শুরুর সেসব দিন আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস জোগায়। প্রাণিত করে। এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় হয়।