কবিতার জন্য এক জীবন কাজ করতে হয়: আল মাহমুদ

আল মাহমুদ পুরো একটি জীবন কবিতার পথে কাটিয়ে এখন প্রায় গোধূলিলগ্নে। কবিজীবনের সঙ্গে দারুণভাবে মিশে আছে বাংলাদেশের বাঁক-বদলের ইতিহাস। স্বদেশের শক্তি বুকে নিয়ে, চোখে জাতির স্বপ্ন দিয়ে এখনো তিনি লিখে চলছেন সমান তালে। কবি হয়েও পাঠকের কাছে চমৎকার ভাষায় পৌঁছে দিয়েছেন গল্প, উপন্যাস। তাঁর গল্প থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কলকাতায়। ১৯৩৬ সালে জন্ম নেওয়া এই মানুষটির লেখালেখি এখনো চলছে। লিখছেন কবিতা ও উপন্যাস। ইমরান মাহফুজ-এর নেওয়া একটি সাক্ষাৎকার আজ ১১ জুলাই কবির জন্মদিন উপলক্ষে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পাঠকদের জন্যে তুলে ধরা হলো। এতে “সোনালী কাবিন”-এর কবির চিন্তা, বিশ্বাস আর রাজনীতির মতো প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।

দ্য ডেইলি স্টার: কবি হতে এসেছিলেন গ্রাম থেকে ঢাকায়। ঘুরেছেন অনেক পথ। খেয়েছেন অনেক ঘাটের পানি। পিছনের কথা যদি বলতেন।

আল মাহমুদ: আমি ঢাকায় এসেছিলাম খদ্দরের পিরহান গায়ে, পরনে খদ্দরের পাজামা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল এবং বগলের নিচে গোলাপফুল আঁকা ভাঙা সুটকেস নিয়ে। এসেছিলাম অবশ্যই কবি হতে। আজ অনেক বছর শহরে আছি। আমার সুটকেসের ভেতর আমি নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশের সবগুলো নদী, পাখি, পতঙ্গ, নৌকা, নর-নারীসহ বহমান আস্ত এক বাংলাদেশ। যেমন, যাদুকররা তাঁদের দ্রষ্টব্য দেখান। আমার ভাঙা সুটকেস থেকে জাতিকে দেখিয়েছি। আমার দ্রষ্টব্য দেখে বাংলার মানুষ কখনো কখনো হাততালি দিয়েছেন, আবার কখনো অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। আমি এখনো এই শহরই আছি। আমি যখন এসেছিলাম তখন আমার বন্ধুদের বগলের নিচে থাকতো সিলেক্টেড পয়েমস জাতীয় ইউরোপের নানা ভাষার নানা কাব্যগ্রন্থ। আমি যেমন আমার ভাঙা সুটকেস থেকে আমার জিনিস বের করে দেখিয়েছি তারাও তাঁদের বগলের নিচের পুঁজি থেকে নানা ভেলকি দেখিয়েছেন। এখনো আমি এই শহরেই আছি। আমার সেসব বন্ধুদের সৌভাগ্য হয়নি। এই মহানগরীতে তাঁদের নাম তরুণরা উচ্চারণ করেন না। একটি কথা মনে রাখবে - সাহিত্য কোন প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিলো না, এখনো নেই। এটা ছিলো আনন্দের বিষয়, ভষ্যিতেও তাই থাকবে।

Al Mahmud
লেখার টেবিলে আল মাহমুদ। ছবিটি কবির অ্যালবাম থেকে নেওয়া

দ্য ডেইলি স্টার: মাহমুদ ভাই, আপনি একবার একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন স্বপ্নই কবিতা, তাহলে কবিতা কি বাস্তব বর্জিত?

আল মাহমুদ: স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মিশেলেই কবিতা হয়। আমি কবিতার যে ভাষার কথা বলছি সেটি তো বাস্তবতাকে নিয়েই। কিন্তু বাস্তব জীবনের একটু ঊর্ধ্বে মানুষ যে কল্পনা করে আমি তার কথা বলছি। বাস্তব জীবন খুবই কষ্টকর। মানুষ এর বাইরে একটি স্বপ্ন দেখে, এজন্য ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে মানুষ আকাশের তারা দেখে। দেখে না? ওই ভাষারূপটাই কবিতা হয়ে বেরিয়ে আসে। আমি এটাই বলতে চাচ্ছি। কিন্তু, এটি বাস্তবতার বাইরে না, বাস্তবতার মধ্যে থেকেই কবিতা। মানুষ যা স্বপ্ন দেখে যা বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যায়, আমি তার কথা বলছি। আর এটা হলেই সেই স্বপ্ন কবিতার রূপ লাভ করে। এটি হলো মানুষের একটি পরিশ্রুত জীবনের কল্পনা। পরিশ্রুত মানে জীবনের ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে যে জীবন-রস বের হয় সেটিই কবিতা।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনি কি নিজেকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন প্রধান কবি বলে মনে করেন?

আল মাহমুদ: এই প্রশ্ন এর আগেও অনেকে আমাকে করেছেন। এখন আমার ধারণা “সোনালী কাবিন” কমবেশি সার্থক কবিতা। এই ধরনের কবিতা টিকে থাকে। কিন্তু, এই কবিতার জন্যে আমি এই দাবি কি করে করি যে আমি সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি। আমি অবশ্য এটি দাবি করি না। কেউ তা ভাবতে পারেন। আমি জানি, পাঠক মহলের অনেকে এরকম ভাবেন। অনেকে বলেন। অনেকে লিখিতভাবেও বলেন। কিন্তু, এতে স্বভাবতই আমি আনন্দবোধ করি। আমাকে যখন শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয় তখন পুলক জাগে। ভালোই লাগে আমার। কিন্তু, ঠিক এর যথার্থতা নিরূপণের ক্ষমতা আমার নেই। এটি সময় বিচার করবে। সময় বিচার করবে কে সবচেয়ে বড় কবি। অবশ্য কে বড় কবি, সাহিত্যে এমন প্রশ্ন নেই। আমি অবশ্য একথা বলতে রাজি আছি, এটুকু পর্যন্ত যেতে রাজি, এদেশের অনেক বড় কবিকেই আমার বড় কবি বলে মনে হয় না। অনেক বড় কবিকেও আমার খুব বড় কবি, খুব প্রতিভাবান কবি বলে মনে হয় না। কিন্তু, এটা তো আমি বলতে পারবো না যে আমি আমার দেশের শ্রেষ্ঠতম কবি। এটা বলা যেমন নিজের জন্য সম্ভব নয় তেমনি এটির কোনো যৌক্তিকতাও নেই। সাহিত্যে এ ধরনের প্রশ্নের সমাধানও কেউ করতে পারে না। সময় এসে এটি করে দেয়।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনার অনেক লেখায় দেহ আর কাম এসেছে নানাভাবে। এ নিয়ে বলতে গেলে কি বলবেন একজন কবির জায়গা থেকে?

আল মাহমুদ: আমি নিত্য নারীসত্বার আদান-প্রদানের মধ্যে মূলত জ্বলে উঠি। আর আমি আমার কবিতায় যেসব নারীর শরীরের সৌন্দর্য চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছি তা বিশেষ কোন একজন মানবীর পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা নয়। একজনের দেহে বহু বৈচিত্র্য তথা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যোগ করে তাঁকে পূর্ণ করে তুলতে চেয়েছি মাত্র। কবিতায় আমি নর-নারীর জীবনের বহু রহস্যময় অন্তরালকে উন্মোচন করার চেষ্টা করেছি। এছাড়া আর কিছুই নয়।

দ্য ডেইলি স্টার: আমরা দেখছি কবিতা জনপ্রিয়তার দিক থেকে এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে, অন্যদিকে কথাশিল্পের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে দিনদিন। এক্ষেত্রে আপনার অভিমত কি?

আল মাহমুদ: আসলে বিষয়টি হচ্ছে - বাংলাদেশে কথাসাহিত্যের চেয়ে কবিতাকেই মৌলিক সাহিত্য হিসেবে ধরা হয়েছে। আজকের এ অবস্থায় এসে কবিতা পরিপূর্ণতাও লাভ করেছে। আর কথাশিল্প প্রথম থেকেই অগ্রসর সাহিত্য ও জনপ্রিয়।

Al Mahmud
কবিপত্নী প্রয়াত নাদিরা মাহমুদের সঙ্গে। ছবিটি কবির অ্যালবাম থেকে নেওয়া

দ্য ডেইলি স্টার: সম্প্রতি কবি লেখকরা কথিত রাজনীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। এতে কবি বা রাজনীতি কতটা সুফল ভোগ করছে বলে মনে করেন?

আল মাহমুদ: আমাদের দেশের কবি-লেখকদের প্রধান সমস্যা হলো রাজনীতি – রাজনীতিবিদদের দ্বারা তাঁদের দলীয় শিবিরে টেনে আনা। রাষ্ট্র কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করুক এটি কবি মাত্রই আশা করেন। কিন্তু দলীয় রাজনীতি কবিকে বৃত্তবদ্ধ রাখুক এটি কবিতার জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। রাজনৈতিক বৃত্তে আবদ্ধ কবি মাত্রই আক্ষেপের রোগে আক্রান্ত। এ রোগ যক্ষ্মার চেয়েও ক্ষয়কারী এবং কর্কটের চেয়ে উৎকট।

দ্য ডেইলি স্টার: জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার একটি যোগাযোগ ছিলো। সেই স্মৃতি মনে পড়ে?

আল মাহমুদ: কিছুটা মনে পড়ে। সে সময় গণকণ্ঠের সম্পাদক ছিলাম। আমাকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। আমাদের পরিবারকে চিনতেন। উনি আমাকে বলতেন যে, উনি যখন ছাত্র ছিলেন, কোলকাতায়, তখন আমার চাচাতো ভাই, চাচা তাঁদের সঙ্গে তাঁর ভালো পরিচয় ছিল। আমি অবশ্যই জানতাম না অতো কিছু। আমি একটু উদাসীন ধরনের মানুষ ছিলাম তো।

দ্য ডেইলি স্টার: কবি আজ ৮২-তে পা দিলেন। দীর্ঘ অতীত পেরিয়ে তিনি কি পেলেন আর কি হারালেন অথবা সময়ের বুকে কোন ভাবনায় দোল খাচ্ছেন?

আল মাহমুদ: কাব্য লেখায় নব্য আমি আর কিছুকাল/ আমার গেল ছেলেখেলায় সন্ধ্যা-সকাল/ এখন হাতের মুঠো খুলে দেখছি রে ভাই/ কেবল আছে আয়ুরেখা আর কিছু নাই।