মরুর বুকেই কি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বনাশ হয়ে গেল?

By বিশ্বজিত রায়
6 November 2021, 12:58 PM

মরুর বুকে আমাদের ক্রিকেটের কি সর্বনাশ হয়ে গেল! এমন হতশ্রী, এমন দরিদ্র বাংলাদেশের ক্রিকেট কেউ যেন আগে আর দেখেননি! চারিদিকে হতাশা, সর্বত্র গেল গেল রব। ক্রিকেট ভক্তরা এতটাই হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছেন যে অনেকে অভিমানে এমনটিও বলে ফেলেন, 'ধুর, বাংলাদেশের ক্রিকেট আর দেখবই না!'

এমন একটি অবস্থায় আমাদের অনেকেরই প্রিয় কবি তারাপদ রায়ের খুব বিখ্যাত একটি কবিতা... 'আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে' কেন যেন বারবার মনে আসছে। যদিও ভিন্ন এক প্রসঙ্গে এই কবিতাটিতে কবি তার মনের খেদ প্রকাশ করেছেন, তবুও ক্রিকেট নিয়ে এই হতাশার মধ্যে ওই কবিতার কিছু চরণ খুব মনে পড়ছে।

প্রথম কয়েকটি চরণ হচ্ছে, 'আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম
যার উদ্দেশ্যে ধ্রুপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশস্তি লিখেছিলাম
গতকাল বলাই বাবু বললেন, "ঐটি বাঁদরলাঠি গাছ"।'

আর শেষ দুটি চরণ, 'আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।'

সত্যিই তো! আমরা হয়তো কল্পনায়ও ভাবিনি যে আমাদের প্রিয় টাইগাররা চলমান এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এতটা হতদরিদ্রভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করবে। যেখানে আমাদের ক্রিকেট কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে খেলোয়াড়রা মরুদ্যানে ব্যাট-বলে ফুল ফোটানোর স্বপ্ন দেখিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ফুল ফোটানো তো দূরের কথা, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা একরাশ কাঁটা নিয়েই দেশে ফিরে এলেন। সেই কাঁটার ঘাঁয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়েই সবাই শঙ্কিত হচ্ছেন।

কিন্তু আমরা একটু ভেবে দেখি না কেন, আমাদের ক্রিকেট কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে ক্রিকেটাররা যেকোনো সিরিজ বা টুর্নামেন্ট শুরুর আগে 'অমৃত বচনে' বরাবরই চ্যাম্পিয়ন। কালে-ভদ্রে ওই 'অমৃত বচন' যে সত্যি হয় না, তা তো নয়! কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ সময় আমরা হতাশায়ই ডুবি। তাহলে এক্ষেত্রে এমন নতুন কোনো সর্বনাশ হয়ে যায়নি। 

তারপর যদি আমরা বাস্তবতার নিরিখে একটু ভেবে দেখি, শুধু কি ভুল পরিকল্পনায় ঘরের মাঠে দুটো সিরিজ খেলার কারণেই আমাদের এই বিপর্যয়? এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে বিসিবির সত্যিই কি কোনো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল? তদুপরি, ক্রিকেটের এই নবীনতম সংস্করণটি নিয়ে আমরা কি সত্যিই কোনো বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করেছি কখনও? আমরা কি আমাদের বিপিএলকে এখনও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে পেরেছি? যদি উত্তরগুলো 'না' বোধক হয়, তাহলে আমরা কি করে বলব যে শুধু এই বিশ্বকাপের ভরাডুবিতেই আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে?

বাদ দেওয়া যাক টি-টোয়েন্টির কথা। অন্য দুই সংস্করণেও কি আমাদের একই হতশ্রী দশা নয়?

আমরা প্রায়শই বলতে ভালোবাসি, টি-টোয়েন্টি সংস্করণটি এখনও আমরা আয়ত্বে আনতে পারিনি। কিন্তু সত্যিটা কি এই নয় যে অন্য দুই সংস্করণেও চিত্রটা কম-বেশি একইরকম?

কালে-ভদ্রে যখন দু'একটি ম্যাচে আমাদের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে, তখন আমরা সবকিছু ভুলে যাই। আবার আমাদের চিরাচরিত হতদরিদ্র রূপটি যখন সামনে আসে, তখন আমরা হতাশায় নিমজ্জিত হই। যেমনটি এখন হচ্ছি।

সবকিছুর চিত্রনাট্যই একইরকম। একই চিত্রনাট্যেরই যেন মঞ্চায়ন চলছে দিনের পর দিন!

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই হতদরিদ্র পারফরম্যান্সের চুলচেরা বিশ্লেষণে যে বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তা কি এমন নতুন কিছু? আমাদের ক্রিকেটারদের সম্ভাবনা আছে কিন্তু প্রয়োগ করতে পারেন না, এ তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক আপ্তবাক্যের মতো হয়ে গেছে।

আর বাংলাদেশ ক্রিকেটের মাঠে বিপর্যয় হবে, অথচ দলের ভেতর থেকে কেউ একজন বলবেন না যে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতি ঘটাতে হবে, তা তো হতেই পারে না! শুধু আপনি যদি বেরসিক হন, তাহলে হয়তো প্রশ্ন করে বসবেন, 'তবে সেটা কবে?' যেমনটি নির্বাচন এলে আপনি আঞ্চলিক ক্রিকেটের প্রয়োজনীয়তার কথা শুনতে পাবেন না, তা হতেই পারে না।

আর জিতলে বাংলাদেশ দল একটি পরিবার হিসেবে খেলে, কিন্তু হারলে যে তার ফাটলের শেষ নেই, সেও তো নতুন কিছু নয়। আর বাংলাদেশ দল নির্বাচনের দায়িত্বে আসলে কে, সেই গবেষণাপত্র হয়তো আপনি আজীবনেও শেষ করতে পারবেন না।

আমাদের পরিকল্পনার মান যা-ই থাকুক, আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের হাল-হকিকত যা-ই হোক, সেটা নিয়ে আপনার যত প্রশ্নই থাকুক, তারপরও প্রতিটি বিপর্যয়ের পর ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের ভাণ্ডারে নতুন নতুন ক্রিকেটারের অভাব যে নেই, এমন বাণীও চিরন্তন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমস্যা কী, কেন সেটা প্রত্যাশিত পর্যায়ে যেতে পারছে না, কেন আমরা প্রতিনিয়তই একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি? সেগুলো কম-বেশি আমজনতা থেকে শুরু করে ক্রিকেটবোদ্ধারা বুঝলেও যাদের সবচেয়ে বেশি বোঝার দরকার, সেটি তারা বুঝে ফেললেই যেন তাদের মহাবিপর্যয়। এটিই সম্ভবত বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা।

তা না হলে দুর্নীতির যে ঘুণপোকা একটু একটু করে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটকে গ্রাস করে ফেলেছে, তা হতে পারত না। আমাদের ক্রিকেটের সম্ভাবনাগুলো যে অঙ্কুরেই ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তা এখন আর এমন কিছু গোপন কথা নয়।

আর আপনি যদি এসব হতাশা ও রোগের কথা বলতে যান, তাহলে কর্তাব্যক্তিরা আপনাকে শুনিয়ে দিবেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সফলতার অনেক গল্প। তাতে অবশ্যই থাকবে বোর্ডের কোষাগারে কত টাকা তারা জমিয়েছেন।

একটি দেশের নিচের স্তরের ক্রিকেট যদি 'নষ্টদের অধিকারে চলে যায়', প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট যদি দুই দশকেও একটু ন্যূনতম মানে না পৌঁছায়, তার ঐতিহ্যবাহী পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটও যদি ক্ষয়িষ্ণুতার দিকে ধাবিত হয়, 'পেশাদারিত্ব' শব্দটি যদি কেবল বুলি আওড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেখানে নতুন একটি সংস্করণে মরুদ্যানে ফুল ফোটাতে না পারার ব্যর্থতা খুব বড় কিছু কি?

আমাদের ক্রিকেটের সর্বনাশ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই সর্বনাশ একটু একটু করে বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে সর্বনাশে সর্বনাশে আমরা হয়তো সর্বনাশের 'ষোলোকলা' পূরণ করে ফেলব।

তাই কবির সাথে সুর মিলিয়ে আমরা বলতে পারব না, 'আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।'