‘সমালোচনাকারীদের লক্ষ্য করে হয়রানির চর্চা বন্ধ করতে হবে’
নাগরিক সংগঠনের উদ্যোগে ‘ইন্টারনেট স্বাধীনতা ও অধিকার: প্রেক্ষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় এই ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও অধিকারকর্মী অধ্যাপক সি আর আবরারের সভাপতিত্বে ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে ছিলেন ঢাবির শামসুননাহার হল সংসদের সাবেক ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি, ওয়েব ডেভেলপার রাসেল আহমেদ, অ্যাক্টিভিস্ট লামিয়া তানজিন তানহা, ঔপন্যাসিক রোকেয়া লিটা, ঢাবি শিক্ষক সুমন রহমান, সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম এবং জাবি শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যেসব অঙ্গীকার আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শুনেছি, নির্বাচনের বিভিন্ন অঙ্গীকার, যা আমরা শুনেছি, সে বিষয়ে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে কতটুকু এগিয়েছে ইন্টারনেট স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে, তা নিয়ে আজকের আলোচনা।’
এরপর ওয়েবিনারে ধারণাপত্র পাঠ করেন অধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন। তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। যেখানে পাঁচটি মূলনীতির ওপর জোর দেওয়া হয়। এর ভেতর রয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রবেশাধিকার, উন্মুক্ততা, উদ্ভাবনের সুযোগ দেওয়া ও কোনোরকম বাধাগ্রস্ত না করা এবং ব্যক্তির তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা, বিশেষ করে ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রূপকল্প ২০২১ ঘোষণার পর থেকেই প্রতিবছরের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল দিবস উদযাপন করা হয়। কিন্তু, তারপরও অবৈধভাবে ও বেআইনিভাবে ব্লগার, কার্টুনিস্ট, শিল্পী, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অযাচিতভাবে সেন্সরশিপ, ব্লক, ফিল্টারিং করা হচ্ছে। সাইবার বুলিং ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন অনেকে। নারী-শিশুরাও সাইবার স্পেসে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এটি শুধুমাত্র মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একইসঙ্গে জীবনের অধিকারেও পরিণত হচ্ছে। যে আইনি নীতিমালা তৈরি হচ্ছে, তাতে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নেই এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়াও বেশি আনন্দজনক নয়।’
রাসেল আহমেদ বলেন, ‘ইন্টারনেট ইকুয়ালিটির বিষয়ে আমরা সচেতন নই। কোনো মাধ্যমকে ব্লক করার কারণে কতখানি প্রভাব পড়বে, তা ভেবে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে কমিটি করা যেতে পারে এটার ইমপ্যাক্ট বোঝার জন্যে। আইটি বন্ধ করার বিষয় নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য সব মন্ত্রণালয়ে আলাদা টেক উইং থাকা প্রয়োজন।’
শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি বলেন, ‘ফেসবুকে কমবেশি সব মেয়েকেই বুলিংয়ের সম্মুখীন হতে হয়। আত্মসম্মানবোধ থাকলে এখানে টিকে যাওয়া কঠিন। এ বিষয়ে প্রশাসনের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে আমাকে ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত পেতে হয়েছে। আমার পরিবারের সদস্যদেরকেও হুমকি দেওয়া হয়। এমনকি একপর্যায়ে আমার ফেসবুক, ইমেইল সব নিয়ে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে আমি রাজনীতি ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।’
লামিয়া তানজিন তানহা বলেন, ‘ফেসবুকে নিজের ছবি না দিয়ে শুধু কার্টুনের ছবি দিয়েও হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। একপর্যায়ে আমাকে ভিকটিম ব্লেমিংও করা হয়। আমি ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে কাজ করি বলে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি হিজরা কি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডারদের তেমন উপস্থিতি নেই। কিন্তু, যারা আছেন, তাদেরকেও এমন হেনস্তার শিকার হতে হয়। অনেক সময় তাদের ফাঁদে ফেলে যৌন নির্যাতন ও ব্ল্যাকমেইলও করা হয়।’
রোকেয়া লিটা বলেন, ‘২০১৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জীবন সংক্রান্ত একটি উপন্যাস লেখার কারণে আমি টার্গেটেড হই। একসময় পরিস্থিতি এত খারাপ হয় যে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয় ও আমার ফেক ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আমাকে লেখা ছেড়ে দিতে হয়।’
তিনি মনে করেন, সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু, সামাজিকভাবে নাজেহাল করা অন্য বিষয়। তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট নজরদারির জন্যে এত আইন রয়েছে, এগুলোর প্রয়োগ আমাদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে কেন দেখা যায় না? নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বা তাদের লাঞ্ছিত হওয়ার বিষয়টি শুধু নারীদের নয়, এটা সবার হওয়া উচিত। এটা আলাদা না ভেবে একভাবে দেখা উচিত।’
সুমন রহমান বলেন, ‘আমাদেরকে প্রযুক্তি ও আইন দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু, এর ব্যবহার শেখানো হয়নি। ডিজিটাল লিটারেসির অভাব রয়েছে। অথচ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নিয়ম আমরা জানি না। আইনি নিরাপত্তার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাও প্রয়োজন।’
সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা মনে করেন, দেশে অনেক আইন রয়েছে। তাই আবার আলাদা করে ডিজিটাল শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন তেমন নেই। তবে, সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করা বেশি প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘আমরা যতদিন বিভক্ত থাকব, ততদিন উত্তরণের জায়গা নেই। আমরা যদি থেমে যাই, তাহলে তারা সফল। তাই মত প্রকাশ আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।’
মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনোকিছু শেয়ার করার বিষয়ে সম্মতির ধারণাটা নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এর পাশাপাশি স্কুলপড়ুয়া কিশোররা যেভাবে গেমিংয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে, তাদের মনোজগৎ গেমিংয়ের মাধ্যমে আসক্ত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।’
আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুমের মতে, ‘মানুষকে মানুষ হতে হলে চিন্তা করার ক্ষমতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা অত্যাবশ্যক।’ গোপনীয়তার অধিকার একটি প্রাথমিক মৌলিক অধিকার বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের স্বাভাবিক জীবনবোধের বিরুদ্ধে আইন ব্যবহার করা যাবে কি না, তা দেখতে হবে। যদি পুরো কাঠামোর পরিবর্তন না করা যায়, তাহলে শুধু সাইবার আইন দিয়ে এগুলো ঠিক করা যাবে না।’
অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, ‘বাধাপ্রাপ্ত হলেও আমাদের সক্রিয়তা জারি রাখতে হবে এবং এগিয়ে যেতে হবে। আমরা যারা একসঙ্গে কাজ করি, তাদের মাঝে সামষ্টিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। ভুল চিন্তা দমন করার জন্যে সঠিক চিন্তা প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।’
সবশেষে সি আর আবরার বলেন, ‘আজকের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সমস্যা নানামুখী এবং এটি মোকাবিলার জন্যে যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজন আছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু, বিদ্যমান কাঠামোগুলো যে ব্যর্থ হচ্ছে, তা আজকের বক্তাদের কথার মাধ্যমে উঠে এসেছে। এ কারণে জবাবদিহিতায় আনার প্রয়োজন রয়েছে।’
নাগরিকের পক্ষে কিছু প্রস্তাব পেশ করেন সি আর আবরার। প্রস্তাবগুলো হলো— ইন্টারনেট নীতিকে আন্তর্জাতিক আইন ও মূলনীতিগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পালন করা এবং এটা নিশ্চিত করা যে অনলাইনে ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট যাতে একটি উন্মুক্ত ফোরাম ও জনপরিসর হিসেবে থাকে। পাশাপাশি নিশ্চিত করা যে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের তাদের ইন্টারনেট অধিকারভোগ থেকে বিরত রাখার বা এতে হস্তক্ষেপ করার পেছনে যাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে একটি বৈধ উদ্দেশ্য থাকে এবং সেই হস্তক্ষেপ ওই উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। অনলাইন বিষয়বস্তুর ওপর যেকোনো বাধানিষেধ যাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে তিন ধাপের ধারাবাহিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়; রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্লকিং ও ফিল্টারিং সিস্টেম পরিহার করা এবং দেশে ইন্টারনেটে বিষয়বস্তুতে প্রবেশগম্যতার ওপর সামগ্রিক নিরীক্ষা চালানো।
একইসঙ্গে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করা এবং লঙ্ঘনকারীকে বিচারের আওতায় আনা; সামাজিক যোগাযোগেরমাধ্যমের যেসব ব্যবহারকারীরা কর্তৃপক্ষের বিষয়ে সমালোচনামূলক মতামত প্রকাশ করেন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে যারা প্রতিবাদের ডাক দেয়, তাদের লক্ষ্য করে হয়রানির চর্চা বন্ধ করা; ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করা এবং ব্যক্তি নাগরিকের ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রতি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি অবশ্যই সীমিত করা, আদালতের আদেশ ছাড়া যাতে এমন নজরদারি না হয়, তা খেয়াল রাখা ইত্যাদি।