৩ জুলাই ১৯৭১: করাচিগামী জাহাজে বাঙালি নারীদের ধরে নিয়ে যায় হানাদাররা

By আহমাদ ইশতিয়াক
3 July 2021, 17:50 PM
UPDATED 3 July 2021, 23:55 PM

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি পাঁচ অফিসার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ খান, ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ পাশা ও ক্যাপ্টেন আনাম পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোটের কাছে মারালা সীমান্তের খরোস্রোতা মুনাওয়ার তাবী নদী অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। তাদের পক্ষ ত্যাগের এই ঘটনা বিশ্ব গণমাধ্যমে ঝড় তুলেছিল। তারা পাঁচ জনই কলকাতায় গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন।

৩ জুলাই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে সীমান্ত পার হয়ে আসা আরেক বাঙালি বিমানবাহিনীর অফিসার কালান্তর পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় তিন হাজার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও অফিসারের মরদেহ করাচি এবং পেশোয়ারে বিমান যোগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এফএনএস ঢাকা, বাবর এবং এফএনএস খাইবার নামের তিনটি জাহাজ করাচি ফিরে যাওয়ার পথে বহু বাঙালি নারীকে নিয়ে গেছে। তাদের যখন করাচি বন্দরে নামানো হয় তখন একজনের হাতের সঙ্গে আরেকজনের হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। সবার কোমরে দড়ি বাঁধা ছিল। করাচিতে এখনো বিমানবাহিনীর বহু বাঙালি অফিসার, সেনা নিরস্ত্র এবং নজরবন্দি অবস্থায় আছেন।’

ঢাকায় এদিন

৩ জুলাই ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন এক বিবৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ‘দুষ্কৃতকারী ও দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে বলে, ‘আবু সাঈদ চৌধুরী ভারত ও ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে চক্রান্তমূলকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। দেশদ্রোহী এই লোক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভারতীয় চর হিসেবে নিযুক্ত হয়ে জাতিসংঘকেও মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য দিয়েছে।’

ভারতে এদিন

৩ জুলাই কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে বাংলাদেশ শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সমিতির উদ্যোগে দুই দিন ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র। তিনিই এদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তৃতা দেন বাংলাদেশ শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সমিতির সম্পাদক দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিখ্যাত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস। এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সনজীদা খাতুনের পরিচালনায় একাধারে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, লালন গীতি ও পল্লিগীতি পরিবেশন করা হয়। একই সঙ্গে তুলে ধরা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা চিত্র।

৩ জুলাই লক্ষ্ণৌতে নব কংগ্রেসের অধিবেশনের প্রথম দিনে বক্তৃতা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এসময় পূর্ব বাংলার নানাবিধ সমস্যা নিয়ে তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার বিষয়ে এখনো বহু রাষ্ট্র আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। এটি বোধগম্য নয়। কিছু রাষ্ট্র তো এতো অনাচার ও পূর্ব বাংলায় নিপীড়ন সত্ত্বেও পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে, পক্ষাবলম্বন করেছে। পূর্ব বাংলার সমস্যা এখন কেবল বাংলাদেশের একার সমস্যা না। বরং এটি এখন বৈশ্বিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে।

৩ জুলাই পশ্চিম জার্মানির তিন সদস্যের সংসদীয় প্রতিনিধিদল পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে কলকাতায় ফিরে আসেন। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ড. সাইন ভিহগেনস্টাইন বলেন, ‘ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানের প্রকৃত পন্থা বা সমাধান নয়। জার্মানির বরাবরই জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পক্ষে। আমরা চাই জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক।

৩ জুলাই রাজস্থানের উদয়পুরে ভারতীয় জনসংঘ দলের সাধারণ পরিষদে বক্তৃতা দেন ভারতীয় জনসংঘের সভাপতি অটল বিহারি বাজপেয়ী। অটল বিহারী বাজপেয়ী তার ভাষণে বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় স্বাধীনতাসংগ্রামীদের জন্য সব ধরণের সাহায্য দেওয়া উচিৎ ভারতের। যদি এর ফলে ভারতকে যুদ্ধেও জড়াতে হয় তবুও ভারতকে এগিয়ে আসা উচিত। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের আগেই ভারতের উচিৎ প্রস্তুত থাকা। পূর্ববাংলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এখন কারাগারে। তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভালো নয়। ভারত সরকার যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য দাবি তুলছে ঠিক তেমনি ভাবে বিশ্বের সব দেশেরই শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে এগিয়ে আসা উচিত।’

পাকিস্তানে এদিন

৩ জুলাই অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান থেকে এক খবরে বলা হয়, ‘আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর চারটি জঙ্গী বিমান ও একটি অস্ত্র সজ্জিত হেলিকপ্টার পাকিস্তানের আকাশসীমার ছয় মাইল ভেতরে অনুপ্রবেশ করে এবং দিনাজপুর জেলার অমরখানায় বিমান থেকে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে। এছাড়া আজ বিকেলে ভারতের দিক থেকে ১২০ মিলিমিটার মর্টারের সাহায্য আমরখানায় প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করা হয়।’ আজ বিকেলেই তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতের অস্থায়ী রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এ হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এর ব্যাখ্যা চায়। একই সঙ্গে পাকিস্তান সরকার বলেছে ‘কোনরূপ উস্কানি ছাড়া পাকিস্তানি এলাকায় এ ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা না হলে তা উপমহাদেশের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। তখন এর জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী হবে ভারত।’

আন্তর্জাতিক মহলে বিবৃতি

৩ জুলাই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ ও গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্যার দাউদা জাওয়ারা অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি সিরিয়া ও গাম্বিয়ার সমর্থন প্রকাশ করে পৃথক বিবৃতি দেন। হাফিজ আল আসাদ বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। এই বিষয়ে আমাদের কথা বলা শোভা পায় না। আমরা অখণ্ড পাকিস্তানের বিশ্বাসী। আমরা আশা করি পূর্ব পাকিস্তানের চলমান অচলাবস্থার শিগগির সমাধান হবে। সিরিয়া সবসময় পাকিস্তানের পক্ষে আছে।’ এর আগের দিন ২ জুলাই সিরিয়া ও গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে সমর্থন প্রকাশ্য করা হয়েছিল।

৩ জুন লন্ডনের রয়্যাল কমনওয়েলথ সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার পরে ব্রিটেনে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে সোসাইটির সহসভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। এর আগের দিন পাকিস্তান সরকার এক বিবৃতিতে বলেছিল ‘বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা চালানোর সুযোগ করে দেওয়ার প্রতিবাদে পাকিস্তান কমনওয়েলথের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমনওয়েলথ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। যা ভীষণ লজ্জাজনক। এই মুহূর্তে আমাদের পক্ষে তাই কমনওয়েলথের সঙ্গে থাকা সম্ভব না।’

৩ জুলাই ভারত সফর শেষে লন্ডনে পৌঁছান ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধি দল। লন্ডনে ফিরে প্রতিনিধিদলের নেতা ও সাবেক কমনওয়েলথ মন্ত্রী আর্থার বটমলি বলেন, ‘পূর্ব বাংলার এই ভয়াবহ ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্য টিক্কা খান সম্পূর্ণভাবে দায়ী। প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় সমস্যার সমাধানের নামে সামরিক পদক্ষেপ গভীর হতাশাজনক ও নিন্দাজনক। সেখানে সামরিক কার্যক্রম চলছে না। বরং সেনাবাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে। সেখানে মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। আমরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির ঘুরে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। দেশের অবস্থা ঠিক হলে তারা দেশে ফিরতে আগ্রহী। তারা মূলত প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু এই অবস্থায় তো তাদের দেশে ফেরার কথা ভাবাই যায় না।’

৩ জুলাই ইরানের তেহরানে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাহেদি পাকিস্তানি সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইরান সবসময়ই পাকিস্তানের পাশে ছিল এবং এখনো থাকবে। পাকিস্তানের প্রতি ইরানের সমর্থন ভবিষ্যতেও থাকবে।’

দেশজুড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ

৩ জুলাই মুক্তিবাহিনীর একটি দল চট্টগ্রামের রামগড়-করেরহাট সড়কে চিকনছড়ায় পাকিস্তানি হানাদারদের একটি মাইক্রোবাসকে অ্যামবুশ করে। এসময় হানাদার বাহিনীর এক ক্যাপ্টেনসহ চার হানাদার সেনা নিহত হয়।

৩ জুলাই বগুড়ার কামালপুরে মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়।

৩ জুলাই রাজশাহী শহরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি ট্রাকে অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় বেশ কয়েকজন সেনা নিহত হয়।

৩ জুলাই কুষ্টিয়ার মহিষাকুণ্ডিতে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর প্রবল গুলিবর্ষণে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা আহত হয়।

৩ জুলাই মুক্তিবাহিনীর একটি দলের ছোড়া হাতবোমায় চুয়াডাঙ্গার থানা ভবন চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসময় বেশ কয়েকজন পুলিশ আহত হয়।

৩ জুলাই নোয়াখালীতে জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এডভোকেট সৈয়দুল হক, অধ্যাপক ফজলে আজিজ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘ভারতীয় দালাল কথিত মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংসের জন্য আমরা আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে সর্বদা প্রস্তুত আছি।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র- সপ্তম, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান, ৪ জুলাই ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৪ জুলাই ১৯৭১

দৈনিক কালান্তর, ৩ জুলাই ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক, ahmadistiak1952@gmail.com