জোকারের হাতে দুই অস্কার

সুচিস্মিতা তিথি
সুচিস্মিতা তিথি
12 February 2020, 10:59 AM
UPDATED 17 October 2021, 20:07 PM

সূর্যের আলোয় ঝলমলে সিঁড়ি বেয়ে নাচতে নাচতে নামছেন একজন ব্যর্থ কমেডিয়ান। মুখভর্তি মেকআপ, ঠোঁটে সিগারেট। আবহসংগীতে বাজছে আনন্দের সুর। কয়েক ধাপ এগুতেই সিঁড়িতে ছায়া এসে পড়লো। আবহসংগীত পাল্টে গেল করুণ সুরে। তখনও নাচ থামেনি জোকারের। এইমাত্র খুন করে এসেছে যে।

গত বছর 'জোকার' মুক্তির পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তোলেন হোয়াকিন ফিনিক্স। প্রেক্ষাগৃহে লুকিয়ে, কাঁপা কাঁপা হাতে অনেক দর্শক তাদের মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন ফিনিক্সের ওই নাচের দৃশ্য। দর্শকের 'নায়ক-খলনায়ক' ধারণা রীতিমতো ওলটপালট করে দিয়েছেন বিশৃঙ্খলার জালে বন্দি সমাজে মানসিক অসুস্থতা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এই ব্যর্থ কমেডিয়ান। ছবিটি চলাকালীন প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি মানুষের চোখে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খলনায়কের প্রতি নিবিড় আবেগ এবং ভালোবাসা। এতো দরদ দিয়ে আর কখনও কোন খলনায়ককে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলে মনে পড়ে না।

১৯৪০ সালে বব কেইনের হাত ধরে প্রথম কমিক্সের রঙিন পৃথিবীতে আসে জোকার। দর্শকের মাঝে আলোড়ন তোলে দ্য ডার্ক নাইট (২০০৮) চলচ্চিত্র মুক্তির পর। পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের হাতেই পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খলনায়ক হিসেবে পরিচিতি পায় জোকার। প্রথমবারের মতো ব্যাটম্যানের কোনো ছবির টাইটেলে 'ব্যাটম্যান' শব্দটি যুক্ত হলো না।

প্লাস্টিকের কোনো মুখোশ নয়, মুখভর্তি পুরু মেকআপ নিয়ে সর্বদা হাস্যরত 'জোকার' হিসেবে পর্দায় হাজির হন ছবির খলনায়ক, ব্যাটম্যানের প্রতিদ্বন্দ্বী। মার্ক হামিলের কণ্ঠে কিংবা জ্যাক নিকলসনের অভিনয়ে এর আগে পর্দায় জোকারকে দেখা গেলেও অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, হিংস্রতার এক অদ্ভুত দর্শন তৈরি করে দর্শকের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছেন দ্য ডার্ক নাইট চলচ্চিত্রের জোকার হিথ লেজার। এখানে নায়ক নয় বরং খলনায়ককেই অনেক বেশি যৌক্তিক বলে মনে হয়। দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য ৮১তম অস্কারে সেরা পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে মরণোত্তর পুরস্কার জেতেন তিনি। ক্ষণজন্মা লেজার 'জোকার' চরিত্রের মাধ্যমেই অমর হয়ে রইলেন দর্শকের মনে।

২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি 'দ্য সুইসাইড স্কোয়াড'-এ জ্যারেড লেটোর বিতর্কিত রূপায়ণের পর ওয়ার্নার ব্রাদারস এবং ডিসি জোকার চরিত্রটিকে নতুনভাবে নির্মাণের কথা ভাবতে থাকে। ব্যাটম্যান বনাম জোকার প্রথা ভেঙ্গে একজন জোকার হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে তৈরি হয় 'জোকার' (২০১৯)।

শোনা যায়, টড ফিলিপস জোকার এর চিত্রনাট্য লেখেন হোয়াকিন ফিনিক্সের কথা মাথায় রেখেই। এজন্যই হয়তো নির্মাণকৌশল, দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি, গানের নিপুণ ব্যবহার সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে ফিনিক্সের অভিনয়। 

মেথোড অ্যাক্টিংয়ের মায়াজালে গোথাম শহরের অন্ধকার জগতের সঙ্গে দর্শককে পরিচয় করিয়ে দেন ফিনিক্স। মনে হয়, যেন সমাজের করুণ বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করা পরিচিত কোনো মানুষের গল্প বলা হচ্ছে। দরিদ্রতা, ব্যর্থতা, গ্লানির ভারে জর্জরিত হেরে যাওয়া এক মানুষের গল্প। যেন ব্যর্থতার এ অনুভূতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় দীর্ঘদিনের।

একজন অভিনেতা হিসেবে হোয়াকিন ফিনিক্স এখানেই সার্থক। 'নায়ক' কিংবা 'খলনায়ক' ধারণাকে পুরোপুরি ভেঙ্গে দিতে তিনি সফল। আর এ কারণেই প্রচণ্ড দুঃখের মুহূর্তে, ভেজা চোখ নিয়ে জোকার যখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, দর্শকসারিতে তখন কেবলই দীর্ঘশ্বাস নিতে দেখা যায়।

জোকারের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ৯২তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের পুরস্কার বাগিয়ে নিয়েছেন হোয়াকিন ফিনিক্স। এটি দুর্দান্ত অভিনেতা ফিনিক্সের প্রথম এবং জনপ্রিয় 'খলনায়ক' চরিত্র জোকারের দ্বিতীয় অস্কার।

একসময় 'জোকার' এর আলোচনায় মেতে থাকা চলচ্চিত্র-প্রেমীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন জায়গা করে নিচ্ছে হিথ লেজার এবং হোয়াকিন ফিনিক্সের দ্বৈত একটি ছবি, যেখানে অনেকেই লিখেছেন 'নিশ্চয়ই জোকারের এই সাফল্যে হিথ লেজার এখন ওপর থেকে মুচকি হাসছেন।'