উপমহাদেশের রাজনীতিতে ট্র্যাজিক নায়ক সোহরাওয়ার্দী

আলিমুজ্জমান
আলিমুজ্জমান
5 November 2025, 13:13 PM
সোহরাওয়ার্দীও পারিবারিক সূত্রের উজ্জ্বল ধারাবাহিকতা পেয়েছিলেন গভীর পাণ্ডিত্যের।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা—এমন অনেক কিছুই তার নামের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। অপরদিকে তার অসাধারণ প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের কথাও এই সঙ্গে স্মরণযোগ্য। সুদীর্ঘ আলোকোজ্জ্বল পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ধারে কাছে আর কেউ ছিলেন কি না, সন্দেহ। সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন এগিয়ে।

প্রায় ৯০০ বছরের বাগদাদের 'সোহরাওয়ার্দী' পরিবারের ঐতিহ্য বহনকারী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাতামহ বাহার উল উলুম ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী, মামা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য কর্নেল স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দী, বড় ভাই পণ্ডিত শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, মামাতো বোন পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম নারী সদস্য শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী। এমন বহুজনই ছিলেন তার পরিবারে।

সোহরাওয়ার্দীও পারিবারিক সূত্রের উজ্জ্বল ধারাবাহিকতা পেয়েছিলেন গভীর পাণ্ডিত্যের। অক্সফোর্ডিও উচ্চারণে ইংরেজি বলা ছাড়াও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ফার্সি, আরবি প্রভৃতি ভাষাতেও দখল ছিল প্রশ্নাতীত। অপরদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও আইন শাস্ত্রেও ছিলেন প্রচণ্ড জ্ঞানের অধিকারী।

পরিষদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজে ছিলেন সুদক্ষ একজন পার্লামেন্টিরিয়ান ও দক্ষ প্রশাসক। ভয়-ভীতি কাকে বলে, তা তিনি জানতেন না। নিজে যা বিশ্বাস করতেন, তাই করে দেখাতে অভ্যস্ত ছিলেন। ছেচল্লিশের কলকাতা দাঙ্গা (দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং) প্রতিরোধে, প্রিমিয়ার হিসেবে দাঙ্গা কবলিত এলাকায় তার একক প্রচেষ্টায় এগিয়ে থাকা বা দেশ ভাগের অব্যবহিত পরবর্তীতে গান্ধীর সঙ্গে শান্তি মিশনে বেলেঘাটার হায়দারি মঞ্জিলে অবস্থানের সময়ে তিনি যে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, তা ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

দেশভাগের কারণে ১৩ আগস্ট অখণ্ড বাংলার প্রিমিয়ারের দায়িত্ব পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে পরদিন সোহরাওয়ার্দী চলে যান সোদপুরের হায়দারি মঞ্জিলে, গান্ধীর কাছে। হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য কাতরভাবে আবেদন জানাতে থাকেন জনসাধারণের উদ্দেশ্যে।

অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কয়েক হাজার মারমুখী মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নির্ভীকভাবে সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী। বলেছিলেন, 'তোমাদেরকে কথা দিতে হবে, আমাকে হত্যার পর আর কোনো মুসলমানকে তোমরা হত্যা করবে না।'

তাৎক্ষণিক কাজ হয়েছিল এই বক্তব্যে। রুদ্রমূর্তি ধরা উন্মত্ত জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনেকখানি প্রশমিত হয়ে ফিরে যান সেখান থেকে।

সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে যত বিতর্ক থাকুক না কেন, হিন্দু-মুসলিম মিলনের দূত হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা যায় তাকে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মহাত্মা গান্ধীর পরই তার নাম এসে যায়।

পরবর্তীতে আমরা দেখি, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্যই গান্ধীকে নিহত হতে হয় নাথুরাম গডসের ছোড়া গুলিতে। অপরদিকে শান্তি মিশনের কাজ করার সময়ে সোহরাওয়ার্দীকেও বারবার ঘাতকের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবুও তিনি সরে আসেননি। কর্তব্যে ছিলেন অটল।

জীবনীকার আহমেদ ফিরোজ তার সোহরাওয়ার্দী নামক গ্রন্থে লিখেছেন, 'সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবনের প্রধান সাফল্য ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা প্রতিরোধ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে শান্তি স্থাপন। কিন্তু একশ্রেণীর উগ্রবাদী হিন্দু দাঙ্গার জন্য তাকে ও তার সরকারকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করে। এমনকি আইনসভার ভেতরেও সোহরাওয়ার্দীকে গভীর সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হয়।'

অথচ ১৯৪৬ সালে কলকাতার রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তিনি মানবতার যে সেবা করেছেন, যা সকলেরই কম বেশি জানা থাকার কথা। নিজের গাড়িচালকের জীবন যাতে বিপন্ন না হয়, সেজন্য তিনি নিজেই দিনে-রাতে গাড়ি চালিয়ে কীভাবে সারা কলকাতায় টহল দিয়েছেন, তাও কারো অবিদিত থাকার কথা নয়।

মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষে তিনি ১৬ আগস্টের 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস' ঘোষণা করেছিলেন এ কথা সত্য। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে দাঙ্গা শুরু হতে যাচ্ছে, এটা তিনি মোটেও আঁচ করতে পারেননি। অথচ হিন্দু নেতৃত্ব ও উগ্রবাদী হিন্দু সমাজ আজও সোহরাওয়ার্দীকে হত্যাকাণ্ডের একমাত্র নায়ক বা 'বুচার' বলে অভিহিত করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন লেখক প্রমাণিত করেছেন, কলকাতা দাঙ্গার জন্য সোহরাওয়ার্দী প্রকৃতপক্ষে দায়ী ছিলেন না। এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে এবং সত্য উদ্ঘাটিত হবে।

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সোহরাওয়ার্দীর প্রকৃত মূল্যায়ন আজও হয়নি। ইতিহাসের এটা একটা বিরাট খামতি হিসেবেই থেকে গেছে। যদিও 'দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং'-এর ওপর বস্তুনিষ্ঠ নির্মোহ আলোচনা অল্প কিছু হয়েছে। এই পরিসরে তার সবগুলোর আলোচনাও সম্ভব নয়। তবে এসব লেখকদের মধ্য থেকে মাত্র দুজন লেখক ও তাদের গ্রন্থের নামই যথেষ্ট—অক্সফোর্ডের অধ্যাপক জয়া চ্যাটার্জির 'Bengal Divided Hindu Communalism and Partition, 1932-1947' ও টরেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনম মুখার্জির 'Hungry Bengal'।

আশ্চর্য হতে হয়, বর্তমান ভারতবর্ষে একশ্রেণীর লেখক, পরিচালক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কালিমালিপ্ত করে যাচ্ছেন লাগাতার ভাবে—জেনে, না জেনে। পরিচালক বিবেকরঞ্জন অগ্নিহোত্রীর 'দ্য বেঙ্গল ফাইলস' আপাতত সর্বশেষ সাম্প্রতিক সংযোজন। সম্প্রতি এক নামী টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি ছেচল্লিশের কলকাতা দাঙ্গার 'বুচার' হিসেবে নতুনভাবে পুনরায় চিহ্নিত করেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে এবং বলে বসেন, 'হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামাঙ্কিত কলকাতা পার্ক সার্কাসের "সোহরাওয়ার্দী এভিনিউ" রাস্তাটির নাম পরিবর্তন করে "গোপাল মুখার্জী এভিনিউ" করা হোক।' অথচ, সিনেমাটিতেও গোপাল মুখার্জীকে নিয়ে ভুল তথ্য পরিবেশিত হয়েছে এবং তার প্রতিবাদ হয়েছে গোপাল মুখার্জীর উত্তরাধিকারীর পরিবার থেকে।

আদতে 'সোহরাওয়ার্দী এভিনিউ' হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে নয়। ১৯৩৩ সালে কলকাতা করপোরেশন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মামা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৩০-৩৪) কর্নেল স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দীর নামে 'সোহরাওয়ার্দী এভিনিউ' নামকরণ করে।

একজন সফল রাজনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সোহরাওয়ার্দী বাংলার রাজনীতিতে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ মন্ত্রীসভা গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। তা না হলে ইতিহাসই হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো এবং কলকাতা দাঙ্গা হয়তো এড়ানো যেতো। বাংলাকে তিনি অবাঙালিদের শোষণ ও নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।

দূরদর্শী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা গঠন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে ওই সময়ে যা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি তা ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে হয়।

সোহরাওয়ার্দী যে সত্যিকারের একজন জাতীয় নেতা ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় দেশ বিভাগের পর। তিনি দ্বিজাতি তত্ত্বের রাজনীতি আর করেননি এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের বিলোপ সাধনের জন্য সুপারিশও করেছিলেন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান—সব জাতি মিলে তিনি পাকিস্তানি জাতীয়তায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং দেশ বিভাগের পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে তার আর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। এমনকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের কাছে তিনি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগ সরকারের পরিবর্তে পাকিস্তানে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার কথাও ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণ হয়নি।

দেশভাগের পর সোহরাওয়ার্দীর ভারত ত্যাগ সম্পর্কে তার চার দশকের একান্ত সহচর ও ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী মাহমুদ নূরুল হুদার 'হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কাছ থেকে দেখা' বইয়ের ১০৯ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, '১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের পিতা জাস্টিস স্যার জাহেদ সোহরাওয়ার্দী ইন্তেকাল করেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভারতে অবস্থান প্রথম থেকেই ভারত সরকার পছন্দ করছিল না। তারা সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে পাকিস্তানের চর হিসেবে ভাবতে থাকে।'

তাদের এই সন্দেহের মূলে ছিল পাকিস্তান হাসিলের পরও সোহরাওয়ার্দীর ভারতে অবস্থান করা। গান্ধী যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন হিন্দু নেতারা তাকে কিছু বলতে সাহস পাননি। গান্ধীর অবর্তমানে ভারত সরকার সোহরাওয়ার্দীকে তাড়ানোর পাঁয়তারা করতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে সোহরাওয়ার্দীর ওপর বিরাট অংকের আয়কর নোটিশ দেওয়া হয়। এই দাবি ছিল সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও অবাস্তব। এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য সোহরাওয়ার্দীর তখন ছিল না। ফলে তার স্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলো।

এই অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ তার কর্মতৎপরতার প্রাণকেন্দ্র কলকাতা থেকে সম্পূর্ণ রিক্ত হাতে করাচি চলে যান। কারণ, পূর্ববঙ্গে তার যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। সোহরাওয়ার্দী আমৃত্যু আর কোনোদিন কলকাতায় পা দেননি। অথচ, কলকাতায় তার ২৮-২৯ বছরের রাজনৈতিক কর্মজীবন অতিবাহিত হয়েছে।

১৯৪৯ সালে পাকিস্তানে এসেও তার হিন্দু-মুসলমান মিলনের চেষ্টা অব্যাহত ছিল। সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানে আন্তরিক প্রচেষ্টার মূল কারণ ছিল গণতান্ত্রিক জাতীয়তায় তার গভীর আস্থা। সরকার প্রধান বা বিরোধীদলের নেতা—সব অবস্থায় গণতন্ত্রই ছিল তার জীবনের মূলমন্ত্র। গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরাচারী উত্থানকে তিনি মেনে নিতে পারেননি কখনও। তাই তার ওপর নেমে আসে তৎকালীন সামরিক চক্রের নিপীড়ন।

সঙ্গতভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সোহরাওয়ার্দীকে বলা হতো গণতন্ত্রের মানসপুত্র। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র করা ও রাষ্ট্রপ্রধানকে মুসলমান হতে হবে—পার্লামেন্টে এসব সংশোধনীর তিনি প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। ওই বছরেই পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন ও তা পাশ হয় গণপরিষদে। এতে তার ও এ কে ফজলুল হকের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।

নতুন শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের পর সেটি কার্যকর করা নিয়ে টালবাহানার মধ্যেই ১৯৫৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। এরপর রিপাবলিকান দলের সমর্থনে ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে তিনি জোর পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তার এই পদক্ষেপ ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্ম দেয়।

পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার ইচ্ছানুসারে ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সোহরাওয়ার্দী। সঙ্গে সকল প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা বাতিল করা হয়, দেশব্যাপী জারি হয় সামরিক শাসন। প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে বহাল হন সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান। ১৯৫৭ সালের ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন আইয়ুব খান।

সোহরাওয়ার্দীর ওপর নেমে আসে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ১৯৬২ সালের জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ৬ মাস ২০ দিন কারাগারে থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় এলে তাকে বিমানবন্দরে বিপুল সংবর্ধনার দেওয়া হয়। ১৯৬৩ সালের ১৯ মার্চ উন্নত চিকিৎসার জন্য লেবাননের বৈরুতে যান সোহরাওয়ার্দী। চিকিৎসারত অবস্থায় ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।

'গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী' গ্রন্থের ৬১২ পৃষ্ঠায় লেখক মন্তব্য করেছেন, 'সোহরাওয়ার্দী ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক, কূটনীতিবিদ। তিনি একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন এ কথা সত্য। কিন্তু তারচেয়ে অধিক সত্য হলো, তিনি ছিলেন স্টেটসম্যান-রাষ্ট্রনায়ক। একজন রাজনীতিবিদ তার দল, নির্বাচন ও ক্ষমতা দখল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করেন এবং তাদের পথ প্রদর্শন করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, যুক্ত নির্বাচনের কথা বলেছেন, আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি ভাবীকালের মানুষের জন্য একটি কল্যাণকামী সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে স্বপ্ন আজো বাস্তবায়িত হয়নি।'