তিস্তা মহাপরিকল্পনা: উত্তরের হৃদয়ে জাগ্রত স্বপ্ন

এনায়েত উল্লাহ শরীফ
এনায়েত উল্লাহ শরীফ
8 November 2025, 09:59 AM
UPDATED 8 November 2025, 17:27 PM

ছবিটা কল্পনা করুন। সালটা ২০৪০। সকালের কোমল রোদে ঝিলমিল করছে তিস্তা নদীর পানি। কিন্তু এ তো সেই পুরনো তিস্তা নয়, যে শুষ্ক মৌসুমে মৃতপ্রায় হয়ে যায় আর বর্ষায় হয়ে ওঠে উন্মত্ত ধ্বংসযজ্ঞের মূর্তিমান প্রতীক। এ যেন এক নতুন তিস্তা!

হিমালয় থেকে উৎসারিত এই নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করে যমুনায় মিলিত হয়েছে। তার দুই কূল জুড়ে গড়ে উঠেছে সবুজ-নীলের অপরূপ লীলাভূমি।

নদীর দুই পাড়ে আধুনিক স্যাটেলাইট শহর, উঁচু অট্টালিকা, কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা। এরই মধ্যেই বয়ে চলেছে সবুজ বেল্ট, সাইকেল লেন, জলাশয় এবং ইকো-পার্ক।

নদীতে চলছে নিয়মিত নৌযান, পণ্যবোঝাই জাহাজ যাচ্ছে-আসছে। ১০২ কিলোমিটার নদীখননের ফলে সারাবছর নাব্যতা থাকছে তিস্তায়। কৃষকের মুখে হাসি, কারণ নিয়ন্ত্রিত সেচব্যবস্থায় ফসলের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

এটা কোনো বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর দৃশ্য নয়। এ হচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পরের সম্ভাব্য চিত্র—যা উত্তর বাংলাকে একটি 'গ্রিন ইকোনমিক করিডোরে' রূপান্তরিত করবে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা কী?

তিস্তা মহাপরিকল্পনা হলো চীন সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকারের একটি বৃহৎ উন্নয়ন উদ্যোগ। এর লক্ষ্য তিস্তা নদীকে ঘিরে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি, কৃষি, পরিবেশ ও জীবনমানে সামগ্রিক পরিবর্তন আনা।

এর পুরো নাম 'কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব তিস্তা রিভার প্রজেক্ট'। চীনের হোয়াংহো নদীর সফল ব্যবস্থাপনার আদলে তৈরি এই পরিকল্পনায় চীনের বিশেষজ্ঞরা সহায়তা দিচ্ছেন।

২০১৬ সালের একটি স্মারকচুক্তির মাধ্যমে এই প্রকল্পটি শুরু হয়েছে। এর আওতায় কৃষি, সেচ, পানি সংরক্ষণ, নদীশাসন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার মতো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকল্পের মূল উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে—১০২ কিলোমিটার নদীখনন করে গভীরতা ১০ মিটার বাড়ানো, ২০৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করে ভাঙন রোধ, ১৭১ বর্গকিলোমিটার চরভূমি পুনরুদ্ধার এবং নদীর দুই তীরে স্যাটেলাইট শহর, মেরিন ড্রাইভ, হোটেল-মোটেল, পর্যটন হাব এবং ১৫০ মেগাওয়াটের সোলার প্ল্যান্ট গড়ে তোলা।

এছাড়া, শিল্পাঞ্চল, লজিস্টিক সেন্টার, পুলিশ স্টেশন এবং কোস্ট গার্ড ক্যাম্পের মতো নিরাপত্তা ও অবকাঠামো উন্নয়নও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় অনুমান করা হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ের জন্য চীন থেকে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ চাওয়া হয়েছে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায় ২০২৬ সালে শুরু হয়ে ২০২৯ সালের মধ্যে শেষ হবে। যদিও এটি ৫০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

সাম্প্রতিক উন্নয়ন হিসেবে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের সময় প্রস্তাবটি চূড়ান্ত আকার নেয়। জুলাই মাসে চীনা পরামর্শকদের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ সম্মেলন হয়েছে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও দিনাজপুরের মতো জেলাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই নদীভাঙন, খরা ও মৌসুমি বন্যার কবলে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এই অঞ্চল বদলে যাবে, টেকসই উন্নয়নের কেন্দ্রে পরিণত হবে। জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহও রক্ষা করা হবে।

কেন প্রয়োজন তিস্তা মহাপরিকল্পনা?

এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে তিস্তার বর্তমান বেদনাদায়ক রূপান্তরে। এককালের 'উত্তরবঙ্গের জীবনরেখা' আজ 'বিবাদ ও বঞ্চনার প্রতীক'। বাংলাদেশে তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটার পড়েছে। এর মধ্যে ৪৫ কিলোমিটার তীরভূমি ক্ষয়প্রবণ। ২০ কিলোমিটারের অবস্থা আরও গুরুতর—বিশেষ করে কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলায়।

শুষ্ক মৌসুমে উজানের ভারতের গজলডোবা বাঁধের কারণে পানি আটকে রাখা হয়। ফলে নদী শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে ওঠে, ব্যাহত হয় কৃষি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায় এবং গৃহস্থালিতে পানির অভাব দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, এতে বার্ষিক ১৫ লাখ টন ধান উৎপাদন কমে।

আবার বর্ষায় উন্মত্ত তিস্তা তার দুই কূল ভাসিয়ে দিয়ে লাখো মানুষকে গৃহহারা করে, যা বার্ষিক ১ লাখ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়। ১৯৮৩ সালের অন্তর্বর্তী চুক্তিতে ভারতকে ৩৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশকে ৩৬ শতাংশ পানি বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু ২০১১ সালের সমান ভাগের খসড়া চুক্তি পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতায় আটকে আছে। এই অনিশ্চয়তা, এই সংকট থেকে মুক্তি পেতেই এই মহাপরিকল্পনার জন্ম।

তিস্তা শুধু একটি নদী নয়—এটি উত্তর বাংলার জীবনীশক্তি। কিন্তু দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত পানিপ্রবাহ, পলি জমে নদীর গভীরতা কমে যাওয়া এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের অভাবে নদীটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এছাড়া উজানের দেশ ভারত শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখে, ফলে তিস্তা শুকিয়ে যায়। আবার বর্ষায় বাঁধ খুলে দেয়, যা তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি করে। এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা তাই তিনটি কারণে অনস্বীকার্য।

প্রথমত, বন্যা ও নদীভাঙনের ভয় থেকে মুক্তি পাবে লক্ষাধিক পরিবার, যা ৩ কোটি মানুষের জীবিকা রক্ষা করবে। দ্বিতীয়ত, কৃষির পাশাপাশি গড়ে উঠবে শিল্পাঞ্চল, যা ৭-১০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। তৃতীয়ত, পুনরুদ্ধার হবে নদীর নাব্যতা, সংরক্ষিত থাকবে জীববৈচিত্র্য ও নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ, যা পরিবেশ উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়—ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ, চীনের প্রভাব বৃদ্ধির ভয় এবং জলবণ্টনের অমীমাংসিত বিবাদ এটাকে জটিল করে তুলেছে।

বাস্তবায়িত হলে মানুষের জীবনে যেসব পরিবর্তন আসবে

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে যে দৃশ্য আমরা দেখতে পাব, তা হবে এক অভাবনীয় পরিবর্তনের ক্যানভাস। উত্তরাঞ্চলের কৃষিতে আসবে বিপ্লব। নিয়ন্ত্রিত সেচব্যবস্থার মাধ্যমে সারাবছর চাষ সম্ভব হবে, ধান-ভুট্টা-সবজি-ফলের উৎপাদন বাড়বে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা বাড়বে, যা খরা-বন্যাও কমিয়ে দেবে।

শিল্পাঞ্চল ও কর্মসংস্থানের নতুন হাব হিসেবে গড়ে উঠবে উত্তরবঙ্গ। নদীর দুই তীরে ২২০ কিলোমিটার বাঁধের পাশে প্রসেসিং জোন, কৃষিভিত্তিক শিল্প, লজিস্টিক সেন্টার এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন তৈরি হবে। তরুণদের আর কাজের খোঁজে ঢাকায় ছুটতে হবে না, স্থানীয়ভাবেই লাখো চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে।

পর্যটনের সম্ভাবনাও ব্যাপক। নৌবিহার, তিস্তা ইকো-পার্ক, নদীকেন্দ্রিক রিসোর্ট, হেরিটেজ জোন এবং মেরিন ড্রাইভের কারণে দেশি-বিদেশি পর্যটক আসবে, যা অর্থনীতিতে নতুন গতি আনবে। পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের কারণে নদী থাকবে জীবন্ত—তীরজুড়ে সবুজ বেষ্টনী, জলাভূমি পুনরুদ্ধার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে।

মানবিক প্রভাব আরও গভীর। মানুষ পাবে স্থায়ী আশ্রয়, উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা—যা একসময় কল্পনাতীত ছিল। ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা হবে এবং দরিদ্রপীড়িত উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে মানুষের জীবনমান বাড়বে। এমনকি নদীর নাব্যতা পুনরুদ্ধার হওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হবে, যা সীমান্তবর্তী নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করবে।

তিস্তা—উত্তরের হৃদয়ে জাগ্রত স্বপ্ন

তিস্তা আজ শুধু একটি নদী নয়, এটি এক জাগ্রত স্বপ্নের প্রতীক—উন্নত, টেকসই ও মানবিক বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রতিচ্ছবি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ২০২৫ সালে পুনরুজ্জীবিত এই মহাপরিকল্পনার ফলে যদি ভারত-চীনের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপিত হয়, তবে উত্তরবঙ্গকে একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলে রূপান্তরিত করবে।

এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে একদিন হয়তো আমরা সত্যিই দেখতে পাব, নদীর পাড়ে সূর্য উঠছে নতুন আলোয়। সেখানে প্রতিটি ঢেউ ফিসফিস করে বলছে—আমার স্রোতে এখন স্বপ্ন বয়ে চলে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা কেবল একটি প্রকল্প নয়, বরং উত্তরের হৃদয়ে জাগ্রত আশার আলো।

এনায়েত উল্লাহ শরীফ, গবেষণা কর্মকর্তা, সরকারি কলেজসমূহের বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রকল্প।