অনিচ্ছাকৃত চোখ পিটপিট করার মতো ‘ট্যুরেট সিন্ড্রোম’ সম্পর্কে জানেন
আপনার বা আপনার পরিচিত কারো কি এমন সমস্যা রয়েছে যে বারবার একই ধরনের কিছু করছেন, যা অন্যদের কাছে বিরক্তিকর বা অশোভন লাগছে? সেটা হতে পারে 'ট্যুরেট সিন্ড্রোম'।
ট্যুরেট সিন্ড্রোম এক ধরণের স্নায়বিক ব্যাধি। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী।
ট্যুরেট সিন্ড্রোম কী
মস্তিষ্কের কিছু অংশের কার্যক্রমের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে নিয়ন্ত্রণহীন নড়াচড়া ও শব্দ উৎপন্ন হলে তাকে বলা হয় ট্যুরেট সিন্ড্রোম।
এমন ক্ষেত্রে একজন মানুষ ইচ্ছার বাইরে বারবার কোনো অঙ্গ নাড়ানো বা শব্দ করা শুরু করে। একে বলা হয় 'টিকস'। অর্থাৎ রোগী জানে সে নড়ছে বা শব্দ করছে, কিন্তু নিজেকে থামাতে পারে না। যেমন: বারবার চোখ পিটপিট করা, মুখ বিকৃত করা, গলা পরিষ্কার করা বা অদ্ভুত শব্দ করা, কখনও কখনও অশোভন শব্দ বা কথা বলা (এটা তুলনামূলক বিরল)।
ট্যুরেট সিন্ড্রোম কেন হয়
ট্যুরেট সিন্ড্রোমের সুনির্দিষ্ট কারণ বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানেন না। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, এটি মূলত বংশগত ও মস্তিষ্কের কার্যক্রমজনিত কারণে হয়ে থাকে।
১. বংশগত বা জেনেটিক কারণ
ট্যুরেট সিন্ড্রোমের অন্যতম প্রধান কারণ হলো জিনের মাধ্যমে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। অর্থাৎ পরিবারের কারো ট্যুরেট সিন্ড্রোম, টিক ডিজঅর্ডার বা ওসিডি থাকলে সন্তানের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, একাধিক জিন মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে প্রভাব ফেলে, যা টিকস তৈরির প্রবণতা বাড়াতে পারে।
২. মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা
মস্তিষ্কে ডোপামিন, সেরোটোনিন এবং নরএপিনেফ্রিন নামের রাসায়নিক পদার্থ বা নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য নষ্ট হলে স্নায়ুতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যায়।
বিশেষ করে ডোপামিনের অতিরিক্ত কার্যকলাপ টিকসের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়।
৩. মস্তিষ্কের গঠন বা কার্যকারিতার সমস্যা
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ট্যুরেট সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের মস্তিষ্কের কয়েকটি অংশে কার্যকারিতার পরিবর্তন দেখা যায়—যেগুলো মূলত নড়াচড়া ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সেখানে অসামঞ্জস্য হলে ইচ্ছার বাইরে নড়াচড়া ও শব্দ দেখা দেয়।
৪. জন্ম-পূর্ব বা জন্ম-পরবর্তী প্রভাব
গর্ভাবস্থায় সংক্রমণ, ধূমপান, মানসিক চাপ, জন্মের সময় অক্সিজেনের ঘাটতি, কম ওজনের শিশু—এসব পরিস্থিতি ট্যুরেট সিন্ড্রোমের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৫. পরিবেশ ও মানসিক চাপ
ট্যুরেটের মূল কারণ না হলেও মানসিক চাপ, ক্লান্তি বা উত্তেজনা টিকস বাড়িয়ে দিতে পারে। অনেক সময় শিশুদের ক্ষেত্রে স্কুলের চাপ, ভয় বা লজ্জা টিকসকে আরও প্রকাশ্য করে তোলে।
ট্যুরেট সিন্ড্রোম কোন বয়সে বেশি হয়
ট্যুরেট সিন্ড্রোম সাধারণত শৈশবেই শুরু হয়—বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫ থেকে ৭ বছর বয়সের মধ্যে প্রথম টিকস (নড়াচড়া বা শব্দ) দেখা দেয়। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে টিকস কিছুটা বেড়ে বা কমে যেতে পারে।
সাধারণত ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সে টিকস সবচেয়ে তীব্র হয়। অনেক সময় বয়স বাড়লে টিকস অনেকটাই কমে যায় বা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
কাদের ট্যুরেট সিন্ড্রোম হওয়ার ঝুঁকি বেশি
১. পরিবারে কারো ট্যুরেট সিন্ড্রোম, টিক ডিজঅর্ডার বা ওসিডি থাকলে সন্তানের এই সিন্ড্রোম হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।
২. ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি আক্রান্ত হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ছেলেদের মধ্যে ৩৪ গুণ বেশি ট্যুরেট সিন্ড্রোম দেখা যায়। কেন এমন হয় তা পুরোপুরি জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, হরমোন ও জিনগত পার্থক্যের ভূমিকা রয়েছে।
৩. যাদের এডিএইচডি (মনোযোগ ঘাটতি ও অতি চঞ্চলতা) বা ওসিডি (অতিরিক্ত চিন্তা) আছে, তাদের মধ্যে ট্যুরেট সিন্ড্রোমের সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়।
৪. জন্ম-পূর্ব জটিলতা—যেমন: গর্ভাবস্থায় ধূমপান, সংক্রমণ, জন্মের সময় অক্সিজেনের ঘাটতি, কম জন্ম-ওজন—এগুলোও কিছু শিশুর মধ্যে পরবর্তীতে ট্যুরেট সিন্ড্রোমের ঝুঁকি বাড়ায়।
ট্যুরেট সিন্ড্রোমের ধরণ ও লক্ষণ
ট্যুরেট সিন্ড্রোমে মূলত ২ ধরণের টিকস দেখা যায়। একটি হলো মোটর টিকস (শারীরিক বা নড়াচড়াজনিত টিকস) এবং অপরটি ভোকাল টিকস (শব্দ বা কণ্ঠজনিত টিকস)।
এ ছাড়া, এর প্রতিটি আবার সরল ও জটিল—এই ২ ভাগে বিভক্ত।
মোটর টিকস বা শারীরিক টিকস
সরল মোটর টিকস—একটি বা কয়েকটি পেশী দিয়ে খুবই ছোট ও হঠাৎ নড়াচড়া হয়। যেমন: চোখ পিটপিট করা, মুখ বাঁকানো, কাঁধ ঝাঁকানো, মাথা নাড়ানো, নাক কুঁচকানো। এই টিকসগুলো সাধারণত খুব দ্রুত ও বারবার ঘটে।
জটিল মোটর টিকস—একাধিক পেশী একসঙ্গে জড়িত থাকে এবং কিছুটা সমন্বিত বা উদ্দেশ্যমূলক মনে হয়, যদিও তা ইচ্ছাকৃত নয়। যেমন: লাফানো, দৌড়ানো বা ঘোরা, কোনোকিছু স্পর্শ করা বা আঘাত করা, অশোভন ইঙ্গিত করা (হাতের অশালীন ভঙ্গি হতে পারে), নিজের শরীরকে বারবার ছোঁয়া।
ভোকাল টিকস বা কণ্ঠজনিত টিকস
সরল ভোকাল টিকস—সহজ, অর্থহীন বা এক শব্দের মতো শব্দ তৈরি হয়। যেমন: গলা পরিষ্কার করা, কাশি দেওয়া, হাঁচির মতো শব্দ, গোঁ গোঁ বা গরগর আওয়াজ করা।
জটিল ভোকাল টিকস—বাক্য বা অর্থবহ শব্দ উচ্চারণ করা হয়, যা কখনও অশোভন বা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। যেমন: হঠাৎ চিৎকার করা, অশালীন বা আপত্তিকর শব্দ বলা, কোন শব্দ বা বাক্য পুনরাবৃত্তি করা, নিজের বলা কথা পুনরাবৃত্তি করা।
এই রোগ নির্ণয়ের জন্য একজনের কমপক্ষে দুটি মোটর টিকস ও কমপক্ষে ১টি ভোকাল টিকস থাকতে হয় এবং টিকসগুলো অন্তত ১ বছর ধরে থাকতে হবে।
চিকিৎসা
অধ্যাপক জহিরুল হক চৌধুরী বলেন, 'ট্যুরেট সিন্ড্রোমের এখনো কোনো স্থায়ী নিরাময় নেই। তবে সঠিক চিকিৎসা ও সহায়তায় টিকসকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।'
তিনি বলেন, 'চিকিৎসা সাধারণত ৩টি প্রধান অংশে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে বিহেভিয়ারাল থেরাপি সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি।'
তিনি আরও বলেন, 'কস্প্রিহেনসিভ বিহেভিয়ারাল ইন্টারভেনশন ফর টিকস বা সিবিআইটি একধরণের আচরণ নিয়ন্ত্রণমূলক থেরাপি—যেখানে রোগীকে শেখানো হয়, টিকস শুরু হওয়ার আগেই সেই চাপ বা পরিস্থিতি চিনে নিতে এবং তা অন্য কোনো স্বেচ্ছা নড়াচড়ার মাধ্যমে দমন করতে। যেমন: চোখ পিটপিট করার ইচ্ছা হলে চোখ স্থির রেখে গভীর নিঃশ্বাস নেওয়া ইত্যাদি। এই থেরাপি শিশু ও কিশোরদের মধ্যে দারুণ কার্যকর।'
'মানসিক চাপ, ভয়, ক্লান্তি টিকস বাড়ায়। তাই ধ্যান, যোগব্যায়াম, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, গান শোনা, ছবি আঁকা টিকস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে,' যোগ করেন তিনি।
ওষুধের চিকিৎসা বিষয়ে অধ্যাপক জহিরুল হক চৌধুরী বলেন, 'যখন টিকস খুব বেশি হয়, পড়াশোনা বা সামাজিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটায়, তখন রোগীকে ওষুধ দেওয়া হয়। ডোপামিন ব্লকার বা মস্তিষ্কের অতিরিক্ত ডোপামিন নিয়ন্ত্রণ করে এমন বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োজন অনুযায়ী রোগীকে দেওয়া হয়।'
তিনি বলেন, 'এডিএইচডি বা ওসিডি থাকলে সেই অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া হয়। যাদের ওষুধ বা থেরাপি কাজ করে না, তাদের ক্ষেত্রে ডিপ ব্রেইন সিমুলেশন (ডিবিএস) দেওয়া হয়।'
ট্যুরেট সিন্ড্রোম পুরোপুরি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তবে রোগীর প্রতি মানসিক ও সামাজিক সহায়তা, পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম খাবার, মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা, মানসিক চাপ কমানো, নিয়মিত রুটিনে থাকার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।


