বিদেশি বিনিয়োগ কেন আমাদের প্রয়োজন
বেশ কিছুদিন হলো বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিদেশি বিনিয়োগ কেন আমাদের প্রয়োজন? কারণ, বড় বিনিয়োগ করার মতো আমাদের নিজস্ব সম্পদ, প্রযুক্তি বা প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তি নেই। অপরদিকে উন্নত দেশের অন্যত্র বিনিয়োগের জন্য সম্পদ আছে, বড় প্রকল্পের অভিজ্ঞতা আছে, নিজস্ব প্রযুক্তি আছে।
দেশের বড় ও জটিল অবকাঠামো নির্মাণে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। আবার বিদেশি বিনিয়োগ দিয়ে উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানা স্থাপন করে পণ্য উৎপাদন করে দেশের বাজারের চাহিদা মেটানো ও আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা প্রয়োজন।
এসব বিনিয়োগ হলে টেকনোলজি ট্রান্সফার হয়, বিপুল পরিমাণ স্থানীয় জনবলের কর্মসংস্থান হয়, দক্ষ কর্মী তৈরি হয়, কর্মসংস্থান হলে অর্থ সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়।
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বিদেশি বিনিয়োগকারী আছে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের গ্লোবাল বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি (প্রাইভেট বা পাবলিক), ভেনচার ক্যাপিটাল ফার্ম, উন্নয়ন সহযোগী উন্নত দেশ বা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, জি-টু-জি ইত্যাদি।
বিনিয়োগকারীরা এখানে কেন বিনিয়োগ করবে? বিনিয়োগকারীরা কখনোই চ্যারিটি করার জন্য এ দেশে আসবে না। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবে তখনই, যখন তারা দেখবে যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিজ দেশ বা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি লাভজনক।
বিনিয়োগ করার জন্য আরও বেশ কিছু বিষয় বিনিয়োগকারীরা বিবেচনা করে থাকে। যেমন: উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য যাতায়াত অবকাঠামো, ভূমি, বিভিন্ন ইউটিলিটির (গ্যাস/বিদ্যুৎ/পানি) সহজলভ্যতা, স্থানীয় বাজারে তাদের পণ্যের চাহিদা, বাজারের আকার, বিনিয়োগ প্রণোদনা, স্থানীয় বাজারে মানবসম্পদ বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক সম্পদের সহজলভ্যতা ইত্যাদি।
দেশি বা বিদেশি উৎপাদনমুখী বিনিয়োগকারীদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য বড় দেশগুলোতে এক প্রদেশের সঙ্গে অন্য প্রদেশ প্রতিযোগিতা হয়। বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের নিয়ে আসতে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের প্রতিযোগিতা চলে। বিনিয়োগ আনতে হলে বাংলাদেশকে সেই প্রতিযোগিতায় অবশ্যই এগিয়ে থাকতে হবে।
পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশকে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে বিনিয়োগকারীদের জন্য সবকিছু সহজলভ্য করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের জন্য অবকাঠামো সুবিধা তৈরি করতে হবে। শুল্ক ও ট্যাক্সসহ সংশ্লিষ্ট সব নীতির স্থায়িত্ব দীর্ঘমেয়াদী করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর জোড় দিয়ে কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে।
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগকারীদের প্রতি সরকারি দপ্তরের মানসিকতা পরিবর্তন করা। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি দিয়ে তাদেরকে অতিথির মর্যাদা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে হবে।
গ্লোবাল কোম্পানির—প্রাইভেট বা পাবলিক লিস্টেড যাই হোক না কেন—ব্যবসায়িক মূল উদ্দেশ্যেই হচ্ছে ব্যবসায় মুনাফা করা এবং শেয়ারের মালিকদের কাঙ্ক্ষিত ডিভিডেন্ড বুঝিয়ে দেওয়া। তাদের হয়তো সামাজিক দায়বদ্ধতার ফান্ড থাকতে পারে, কিন্তু সামাজিক ব্যবসা মডেলে ব্যবসা করে না।
সুতরাং এটা বুঝতে হবে, বিনিয়োগ করে মুনাফা করতে না পারলে তারা বেশি দিন ব্যবসা করবে না। তবে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, এসব কোম্পানি ঠিকমত কর দিচ্ছে কি না, মুনাফা প্রত্যাবাসন সঠিক প্রক্রিয়ায় আইন মেনে করছে কি না।
উন্নয়ন সহযোগী দেশ বা আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাদের আর্থিক ঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার বড় অবকাঠামো উন্নয়ন বাস্তবায়ন করে থাকে। যেমন: আধুনিক মহাসড়ক, বড় সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, রেলওয়ে, মেট্রোরেল, বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারও একটা ছোট অংশ বিনিয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব যেকোনো বিনিয়োগ প্রস্তাবকে অতি সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করা।
প্রথমত দেখতে হবে সেই অবকাঠামো দেশের অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখবে, উভয়পক্ষের জন্য লাভজনক হবে কি না, খরচ কেমন হবে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রতি ইউনিট খরচ ঠিক আছে কি না, টেকনোলজি ট্রান্সফারে সুবিধা বাংলাদেশ পাবে কি না। সেইসঙ্গে আর্থিক সমীক্ষা করে দেখতে হবে প্রকল্পটা কতটুকু টেকসই বা অন্য কোনো সুলভ কিন্তু টেকসই বিকল্প আছে কি না, কোন মডেলে কোন প্রকল্প করলে দেশ লাভবান হবে। কর্ণফুলী টানেল বা চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি টুরিস্ট গ্লাস ট্রেনের (শেষ পর্যন্ত বাদ হয়েছে) মত উচ্চাভিলাষী প্রকল্প দিয়ে জনগণের করের টাকা নষ্ট করার মতো উদ্যোগ প্রতিহত করতে হবে।
উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোতে বিনিয়োগ বা বিভিন্ন প্রকল্পে সাহায্য করে থাকে। উন্নয়ন সহযোগী দেশের উল্লেখযোগ্য সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (ইউএসএইড), যুক্তরাজ্য (ডিএফআইডি), জাপান (জাইকা), কোরিয়া (কইকা), চীন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিট, ডেনমার্ক (ড্যানিডা), সুইডেন (এসডিসি) ইত্যাদি।
জাইকা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে থাকে। এসব সংস্থা সরকারের বিভিন্ন খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে সহজ বা কঠিন শর্তে ঋণ ও অনুদান দিয়ে থাকে। সেসব প্রকল্প সমাজের মৌলিক চাহিদাসহ অবকাঠামোগত সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকেই বেশি জোড় দেয়—বড় অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু ও নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি।
সহজ শর্তের ঋণ হলো স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদের ঋণ, যেখানে গ্রান্ট এলিমেন্ট ২৫ শতাংশের কম। আবার জাইকার মতো প্রতিষ্ঠান অন্য প্রকল্পে অর্থ ব্যবহারের শর্তে প্রকল্প ঋণ মওকুফও করে দেয়।
বিদেশি এসব অর্থ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে প্রক্রিয়া করা হয়ে থাকে। প্রাথমিক সমঝোতার ভিত্তিতে বা বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবনাগুলো আসে। অনুদান, সহজ শর্তের ঋণ বা সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিটের বিভিন্ন রকম শর্ত থাকে।
বেশিরভাগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্তের মধ্যে অন্যতম শর্ত হয় প্রকল্পের কনসালট্যান্ট, সাপ্লাইয়ার বা ভেন্ডার সেই দেশ থেকেই নিতে হবে। ওপেন টেন্ডার করলেও সেই দেশের ভেন্ডারদের মধ্যে করতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। উল্লেখ্য, ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ বাংলাদেশকে বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়।
সাধারণত এসব সংস্থা বা প্রকল্পের পেছনে একটা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কাজ করে। কোনো কোনো দেশের বড় ভেন্ডার বা সাপ্লাইয়ার স্থানীয় অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে এসব প্রকল্প ও বিনিয়োগের জন্য দেশের উচ্চপর্যায়ে প্রতিনিয়ত সুপারিশ করে যায়। যেহেতু বড় প্রকল্প, মোট প্রকল্পের ১-২ শতাংশ পেলেই তাদের মিলিয়ন ডলার আয় হয়ে যায়।
উন্নত দেশের দাতা সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, আইডিবি ইত্যাদি সংস্থা বড় অবকাঠামো প্রকল্পে ঋণ দিয়ে থাকে।
আইএমএফ বিদেশি মুদ্রায় ঋণ দিয়ে থাকে বাজেট সহায়তা হিসেবে। এ ধরনের ঋণে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের শর্ত থাকে। এ ধরনের ঋণেও তারা বিভিন্ন শর্তারোপ করে।
তাদের সবচেয়ে বড় শর্ত প্রাইভেটাইজেশন ও লিবারালাইজেশন। কার্যকর রেগুলেশন ও রেগুলেটরি বডি তৈরি করতে পারলে প্রাইভেটাইজেশন ব্যাপারটা খারাপ না। সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যবসার বেহাল অবস্থা আমরা তো অনেক দেখলাম।
জাতিসংঘের সদস্য দেশ হিসেবে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রকল্প সহায়তা দিয়ে থাকে।
দেশের উন্নতি চাইলে আমাদের মতো দেশের জন্য অবশ্যই বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে সেই বিনিয়োগ থেকে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বেশি লাভবান হবে, নাকি দেশ ও দেশের জনগণের লাভ হবে, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।
মো. হাসিবুর রশিদ, আইটি ও টেলিকম প্রফেশনাল