লাউয়াছড়া উদ্যানে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ পর্যটক, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২ বছর বিরতির পর এবার ঈদের ছুটিতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের ঢল নেমেছে। এতে করে বন বিভাগের রাজস্ব আদায় বাড়লেও হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এখানকার জীববৈচিত্র্যের।
সিলেটের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলছেন, ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একদিনে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পর্যটক ধারণক্ষমতা ৪০০ জন। কিন্তু এই ঈদের ছুটিতে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজারের বেশি পর্যটক বেড়াতে আসছেন এখানে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, পর্যটকের সংখ্যা সীমিত করা না গেলে দূষণ ও কোলাহলের কারণে বন্যপ্রাণীরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য বনের আশপাশের এলাকায় চলে যাবে। এতে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়বে।
১৯৯৬ সালে সিলেট বন বিভাগের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এ বনে বিরল প্রজাতির উল্লুক, চশমা পরা বানর, লজ্জাবতী বানর, বনরুই, মেছো বাঘ, মায়া হরিণ, বিভিন্ন জাতের সাপ ও নানা জাতের পাখির অভয়াশ্রম।
করোনা মহামারির কারণে গত ২ বছর দর্শনার্থীদের যাতায়াত বন্ধ ছিল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এবার কোনো বিধিনিষেধ নেই। এ অবস্থা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের পদভারে মুখর হয়ে উঠেছে এই এলাকা।
লাউয়াছড়া বনের বিট কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ জানান, ঈদের দিন ও পরের দিন লাউয়াছড়া উদ্যানে অন্তত সাড়ে চার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু প্রবেশ করেছে। এ থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা।
স্থানীয় সাংবাদিক ও ট্যুরিস্ট গাইড সাজু মারছিয়াংয়ের ভাষ্য, এই উদ্যান নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজির পাশাপাশি দুর্লভ পশু-পাখি ও সাপসহ কয়েক'শ প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল। এ অবস্থায় এখানে মানুষের অবাধে যাতায়াত ইকো ট্যুরিজম ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একইসঙ্গে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে দর্শনার্থী বহন করে আনা যানবাহনের শব্দে প্রাণিকূলের মধ্যে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার হচ্ছে।
এ অবস্থায় জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে বনে দর্শনার্থীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পরামর্শ দেন সাজু মারছিয়াং।
ঈদের ছুটিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আদনান বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন লাউয়াঝড়ায়। তিনি বলেন, 'আমার ধারণা ছিল এখানে আসলেই বানর, উল্লুক, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণীর দেখা পাব। কিন্তু কোনো প্রাণীর দেখা মেলেনি। হয়তো কোলাহলের কারণে তারা গভীর অরণ্যে ঢুকে পড়েছে।'
নোয়াখালী থেকে আসা পরিবেশকর্মী উম্মে সালমা বলেন, '২০১৭ সালে একবার এই উদ্যানে এসে বানর দেখেছিলাম, পাখির ডাক শুনেছিলাম। কিন্তু এবার কিছুই চোখে পড়েনি।'
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরীর বক্তব্য, ঈদের ছুটিতে লাউয়াছড়া উদ্যানে প্রতিদিন ৩ হাজারের বেশি পর্যটক আসছেন। এ কারণে উদ্যানের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রেজাউল করিম বলেন, 'বনে শব্দ দূষণ রোধে ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি র্যাব সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তারপরেও আমরা এখানে পর্যটকদের সংখ্যা সীমিত করতে চাই। তা না হলে এই বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা কঠিন হবে।'
এ ছাড়া দর্শনার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য অনলাইনের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে টিকিট দেওয়া যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অতিরিক্ত কোলাহল ও শব্দদূষণে বণ্যপ্রাণী ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে পারে। তখনই বিভিন্ন রকমের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।'
তিনি আরও বলেন, 'এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে ট্যুরিস্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থা আছে। এর মাধ্যমে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটক কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ভ্রমণের সুযোগ পায়। কিন্তু বাংলাদেশে এই ধরনের কোনো মডেল না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন ও বন্যপ্রাণী।'