ডলারের দর স্থির থাকলে আগামী বছর খরচ কমতে পারে নিত্যপণ্যে
আগামী বছর চিনি, গম, ডাল ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্যে বাংলাদেশের মানুষের খরচ কিছুটা কমতে পারে—এমন পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, বৈশ্বিক বাজারে এসব পণ্যের দাম ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হতে পারে।
তবে আমদানিকারকদের মতে, এই সম্ভাব্য স্বস্তি পেতে হলে ডলারের দর ১২২ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল থাকতে হবে এবং যুদ্ধ কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কোনো বড় বিপর্যয়ে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটতে পারবে না।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে টানা চতুর্থ বছরের মতো বৈশ্বিক পণ্যের দাম কমবে। ২০২৫ ও ২০২৬ সালে দাম গড়ে ৭ শতাংশ করে কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক অর্থনীতির ধীরগতি, তেলের সরবরাহ বেড়ে যাওয়া এবং নীতিগত অনিশ্চয়তাই এই দাম কমার মূল কারণ।
জ্বালানির দাম কমায় বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমছে। চাল ও গমের দামও কমে আসায় কিছু উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য এখন তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হয়েছে।
বাংলাদেশে গত তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতি উচ্চপর্যায়ে আছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশে। গত কয়েক মাসে তা কিছুটা কমে সেপ্টেম্বরে তা ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে নেমেছে, যা আগস্টে ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।
তবুও সাধারণ মানুষ এখনো পণ্য ও সেবার উচ্চমূল্যের চাপ অনুভব করছেন। স্থানীয় আমদানিকারকেরা বলছেন, আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবেই—এমন নিশ্চয়তা এখনই দেওয়া যাচ্ছে না।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দাম কিছুটা কমলেও তা এখনো মহামারির আগের চেয়ে বেশি। ২০২৫ সালে দাম ২০১৯ সালের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি। আর আগামী বছর ১৪ শতাংশ বেশি থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সংস্থাটির মতে, ২০২৫ সালে তেল বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ দেখা দিতে পারে, যা ২০২৬ সালে আরও বাড়তে পারে—এটি ২০২০ সালের সর্বশেষ অংকের চেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি হতে পারে। তেলের চাহিদার ধীরগতি, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড যানবাহনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং চীনের ক্রয়ের স্থিতিশীলতা এই উদ্বৃত্তে অবদান রাখছে।
ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ২০২৫ সালে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার থেকে ২০২৬ সালে ৬০ ডলারে নেমে পাঁচ বছরের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সামগ্রিকভাবে, জ্বালানির দাম ২০২৫ সালে ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমতে পারে।
খাদ্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে খাদ্যপণ্যের দাম ৬ দশমিক ১ শতাংশ কমবে এবং ২০২৬ সালে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ হ্রাস পাবে। এই বছর সয়াবিনের দাম রেকর্ড উৎপাদন ও বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে কমেছে, তবে আগামী দুই বছরে তা স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় কফি ও কোকোর দামও ২০২৬ সালে কমতে পারে। তবে সারের দাম ২০২৫ সালে ২১ শতাংশ বাড়তে পারে, কারণ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে এবং বাণিজ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ২০২৬ সালে তা আবার ৫ শতাংশ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে কৃষকের লাভের মার্জিন আরও সংকীর্ণ হতে পারে এবং ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে পারে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে সয়াবিনের দাম প্রায় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে।
তিনি আরও জানান, কিছু পণ্যের দাম সামান্য কমেছে— চিনির দাম কমেছে, আর ভোজ্যতেল ও গমের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। প্রতি টন গমের দাম প্রায় ২৮০ ডলার থেকে ২৭০ ডলারে নেমেছে, আর চিনি প্রায় ৪৫০ ডলার থেকে ৩৯৮ ডলারে নেমেছে।
তিনি আশা করছেন, বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন না ঘটলে, আগামী বছর ভোক্তাদের জন্য কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে।
তিনি বলেন, যদি তেলের দাম স্থিতিশীল থাকে, মূল্যস্ফীতি আরও কমতে পারে। আন্তর্জাতিক দাম এরইমধ্যে কমেছে, তাই ডলারের বিনিময় হার ১২২ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে থাকলে মূল্যস্ফীতি আরও সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম-ভিত্তিক শস্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী বলেন, দেশেরে বাজারে দাম কমার ক্ষেত্রে ডলারের হার এবং উচ্চ ব্যাংক সুদের হারের মতো অন্যান্য কারণও বিবেচনায় নিতে হবে।
আরেকটি প্রধান আমদানিকারক এবং প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের করপোরেট এবং রেগুলেটরিবিষয়ক পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, 'মূল বিষয় হলো বিশ্ব বাজারে দাম কমে গেলে এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে এবং ভোক্তারাও লাভবান হবেন।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস যদি ঠিকঠাক হয় এবং অন্যান্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকে, তবে এর প্রভাব স্থানীয় বাজারে প্রতিফলিত হবে।
বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি আশা করছেন, 'আগামী দিনগুলোতে ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকবে।'