নাব্যতা সংকটে পায়রা বন্দর, পণ্য আমদানি প্রায় অর্ধেকে নেমেছে

সোহরাব হোসেন
সোহরাব হোসেন
17 December 2025, 07:07 AM

পটুয়াখালীতে নাব্যতা সংকটে দেশের তৃতীয় পায়রা সমুদ্রবন্দরে জাহাজ চলাচল চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের পর গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দরে গত এক বছরে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বিদেশি পণ্যবাহী জাহাজ। এতে বন্দর ব্যবহারকারী ও সংশ্লিষ্ট মহল হতাশ হয়ে পড়েছেন।

পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ইটবাড়িয়া ইউনিয়নে ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বন্দর যাত্রা শুরু করে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট।

প্রথম বছর, অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাত্র ১০টি জাহাজ দিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও ধীরে ধীরে বন্দরের কার্যক্রম বাড়তে থাকে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে এখানে ১ হাজার ১৪টি জাহাজ ভিড়ে এবং ৫০ লাখ ৭৪ হাজার টন পণ্য খালাস হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি।

বন্দর চালুর পর থেকে মোট ৫ হাজার ৪০১টি জাহাজ পণ্য খালাস করেছে। এর মধ্যে ৫২৯টি বিদেশি জাহাজও ছিল। এ থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা।

তবে গত কয়েক অর্থবছরে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে পায়রা বন্দরে ১২৩টি বিদেশি জাহাজ ভিড়ে। এগুলো থেকে ৪০ লাখ ৪৮ হাজার টন পণ্য খালাস হয় এবং রাজস্ব আসে ৩৩ কোটি ২২ লাখ টাকা।

পরের ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বিদেশি জাহাজের সংখ্যা কমে ৮৫টিতে নেমে আসে। একই সময় পণ্য আমদানি কমে যায় ১২ লাখ ৭৭ হাজার টন এবং রাজস্ব আয় কমে হয় প্রায় ৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। 

বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবহারকারীদের মতে, এই অবনতির প্রধান কারণ ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্যতা কমতে থাকা।

২০২১ সালে চ্যানেলটির গভীরতা ১০ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত বাড়াতে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মূল খননের (ড্রেজিং) কাজ পায় বেলজিয়ামের প্রতিষ্ঠান জ্যান ডে নুল। এর উদ্দেশ্য ছিল বড় জাহাজগুলোকে সরাসরি বন্দরের জেটিতে ভেড়ানো।

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে খনন করা চ্যানেল হস্তান্তর করা হলেও মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই তলানিকে পলিমাটি জমে গভীরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

বন্দর রেকর্ড অনুযায়ী, ড্রেজিং শেষ হওয়ার পর প্রায় ১০০টি মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) বন্দরে ভিড়তে পেরেছিল। কিন্তু এরপর আবার নাব্যতা সংকট দেখা দেয়।

এই ডিসেম্বরে এসে চ্যানেলটির জোয়ারের সময় গড় গভীরতা প্রায় ৬ মিটার এবং ভাটার সময় ৫ দশমিক ৯ মিটার, যা বড় জাহাজ চলাচলের জন্য যথেষ্ট নয়।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, 'ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পরও দ্রুত পলি জমে চ্যানেলের গভীরতা ৬ মিটারের নিচে নেমে গেছে। বড় জাহাজ যদি সরাসরি ভিড়তে না পারে, তাহলে ব্যবহারকারীরা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেবে।'

পায়রা বন্দরের প্রধান ব্যবহারকারীদের মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড (আরএনপিএল)। এই দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন প্রায় ১২ হাজার টন কয়লা আমদানি করে।

নাব্যতা সংকটের কারণে এখন কয়লাবাহী মাদার ভেসেলগুলোকে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি কুতুবদিয়ায় নোঙর করতে হচ্ছে। সেখান থেকে ছোট লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর নিজস্ব জেটিতে খালাস করতে হচ্ছে। ফলে সময় ও খরচ দুটোর অপচয়ই বেড়েছে।

আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেডের (আরএনপিএল) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বলেন, 'প্রতি মাসে আমরা ৬ থেকে ৭টি মাদার ভেসেলে করে কয়লা আমদানি করি। প্রতিটি জাহাজে প্রায় ৬০ হাজার টন কয়লা থাকে। নাব্যতা সংকটের কারণে এখন কুতুবদিয়া থেকে কয়লা আনতে ১৫০ থেকে ১৮০টি লাইটার জাহাজ ব্যবহার করতে হচ্ছে। প্রতিটি লাইটারের আসতে অন্তত দুই দিন লাগে। এতে খরচ বাড়ছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।'

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাসুদ ইকবাল সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, 'চ্যানেলের ধারাবাহিক রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং যথেষ্ট না হওয়ায় গভীরতা কমে গেছে। ফলে বড় জাহাজ চলাচল করতে পারছে না।'

তিনি জানান, সরকারের কাছে অনুমোদনের জন্য একটি বিস্তৃত প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের জন্য একটি যোগ্য ড্রেজিং কোম্পানিকে নিযুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে টেকসই কার্যক্রম নিশ্চিত করার জন্য পায়রা বন্দরের জন্য দুটি ড্রেজার সংগ্রহ করা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্পটি এখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো. আজিজুর রহমান বলেন, 'নাব্যতা বজায় রাখা ও জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাবনাবাদ চ্যানেলে ড্রেজিংসহ কয়েকটি প্রকল্প চলছে। দীর্ঘমেয়াদে খরচ কমাতে দুটি ড্রেজার কেনার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নও এগোচ্ছে। প্রথম টার্মিনালের জেটির কাজ ৯৭ শতাংশ, ইয়ার্ড নির্মাণ ৯৬ শতাংশ এবং ছয় লেনের সড়ক ৮৬ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অন্ধারমানিক নদীর ওপর নির্মিত দুটি সেতু ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ হওয়ার কথা, যা টার্মিনালকে সরাসরি ঢাকা–কুয়াকাটা মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করবে।'

লালুয়া ইউনিয়নের চাড়িপাড়া এলাকায় রাবনাবাদ নদীতে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনালের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম শুরু হয় ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর। ২০১৯ সালে প্রথম অনুমোদনের সময় প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকায়।

একই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদও বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। ফলে যে প্রকল্পটি শুরুতে ১৮ মাসে শেষ করার পরিকল্পনা ছিল, তা এখন সাত বছরের প্রকল্পে পরিণত হয়েছে।

নদী ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, পায়রা বন্দরের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এটি একটি অপকিল্পিত প্রকল্প। সোজা কথায়, নিজেদের পকেটে পয়সা ঢোকানোর জন্যই এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের যিনি উপদেষ্টা, তিনি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ। কিন্তু তার দপ্তরেই এরকম কাজ হচ্ছে—যা অনাকাঙ্ক্ষিত।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা শুরুতেই প্রস্তাব করেছিলাম অন্তত ৫০ কিলোমিটার ভিতরে এই বন্দর স্থাপনের জন্য। কেননা মেঘনা নদীর স্রোতের মাধ্যমে এই বন্দরের দীর্ঘ চ্যানেলটি প্রতিনিয়ত পলি পড়ে ভরাট হচ্ছে।'

এ ব্যাপারে সেন্টার পলিসি ফর ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান জানান, 'পায়রা বন্দর আমাদের দেশের অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এখানকার চ্যানেলে ভরাট হওয়া পলি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ করতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হবে, সে পরিমাণ টাকা এ বন্দর থেকে পাওয়া যাবে না।'