ইচ্ছাকৃত খেলাপির ট্যাগ বাদ, ব্যাংক কোম্পানি আইনে আরও যেসব পরিবর্তন

রেজাউল করিম বায়রন
রেজাউল করিম বায়রন
আসিফুর রহমান
আসিফুর রহমান

সরকার ব্যাংক কোম্পানি আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ২০২৩ সালে প্রবর্তিত 'ইচ্ছাকৃত খেলাপি' সংক্রান্ত বিধান অপসারণ এবং ব্যাংকের বোর্ড ছোট করার প্রস্তাব।

বিদ্যমান আইনে, খেলাপিদের মধ্যে যারা ঋণ পরিশোধে অনিচ্ছুক বলে বিবেচিত হয়, তাদের পৃথক তালিকা করতে হয় ব্যাংকগুলোকে। এই তালিকার খেলাপিদের 'ইচ্ছাকৃত খেলাপি' হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। শুধু খেলাপিদের একটি তালিকা থাকবে এবং খারাপ গ্রাহকরা সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তি পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকা তৈরি করার ফলে শুধু যে বাড়তি কাজের চাপ তৈরি হয় তাই নয়, বরং ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার সুযোগ থাকায় দুর্নীতিরও পথও খোলা থাকে।

আর্থিকখাতের ব্যাপক সংস্কারের অংশ হিসেবেই আইনের এসব প্রস্তাবিত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই এসব সংশোধনী খসড়া তৈরি করেছে এবং সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সেগুলোর অনুমোদন দিয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, খসড়াটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের উপস্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই এ বিষয়ে অধ্যাদেশ আসতে পারে।

খসড়ায় ব্যাংকের পরিচালকের সংখ্যা ২০ থেকে কমিয়ে ১৫ জন করার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকতে পারেন। তবে খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে, বোর্ডের অর্ধেক সদস্য হবেন স্বতন্ত্র পরিচালক।

কর্মকর্তারা বলেন, এর মানে দাঁড়াবে সাত বা আটজন স্বতন্ত্র পরিচালক হবেন। এর মাধ্যমে ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে যাচাইকৃত প্রার্থীদের তালিকা থেকে স্বতন্ত্র পরিচালক নির্বাচন করা হবে।

কর্মকর্তারা আরও জানান, অনেক দেশের ব্যাংকের বোর্ডে মুনাফালোভী শেয়ারহোল্ডারদের পরিবর্তে পেশাজীবীরাই প্রাধান্য পান।

একই পরিবারের পরিচালকের সংখ্যা সীমিত করার প্রস্তাবও রয়েছে। বিদ্যমান আইনে একই পরিবারের তিনজন সদস্য এবং আত্মীয়দের মনোনয়নে আরও দুজন পরিচালক হিসেবে থাকতে পারেন।

খসড়ায় বলা হয়েছে, একটি পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজনকে পরিচালক হিসেবে রাখা যাবে। পাশাপাশি, 'পরিবার'র সংজ্ঞায় কেবল স্বামী-স্ত্রী, সন্তান ও ভাই-বোনের জায়গায় আওতা বাড়িয়ে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

অভিযোগ রয়েছে, বোর্ড পরিচালক পদে প্রায়শই শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নিয়োগ দেওয়া হয় এবং বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সেটা ঠেকানো যায় না।

খসড়ার মতে, পরিবারের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্য হলো এ ধরনের প্রথা রোধ করা।

আরেকটি প্রস্তাবিত পরিবর্তন হলো, পরিচালকের মেয়াদ ১২ বছর থেকে কমিয়ে ছয় বছর করা।

বর্তমান আইনে, কোনো ব্যবসায়িক গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হলেও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক ঋণ পেতে পারে।

সংশোধনীর মাধ্যমে এই সুযোগ বন্ধ করা হবে। অর্থাৎ, একটি প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হলে ওই গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও আর ঋণ নিতে পারবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মো. নজরুল হুদা এসব প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিধান ব্যাংকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে উৎসাহিত করতে পারত।

তিনি বলেন, 'খেলাপিকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত—এভাবে সংজ্ঞায়িত করার মতো কোনো মানদণ্ড নেই।'

বোর্ডের আকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছোট বোর্ডই বেশি কার্যকর। বোর্ডে বেশি সদস্য মানে বাড়তি বোঝা, অতিরিক্ত এজেন্ডা আর অনিয়ম। পরিচালকের সংখ্যা নয় থেকে ১১-এর মধ্যে হওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, পরিচালকের সংখ্যা নয়, বরং ব্যাংকার ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের মতো যোগ্য পেশাদার নিয়োগই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।