ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়াল
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (আইবিবিএল) খেলাপি ঋণ এ বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দীর্ঘদিনের ঋণ কেলেঙ্কারি, অনিয়ম ও এস আলম গ্রুপের জালিয়াতি একসময়কার সবচেয়ে লাভজনক এই ব্যাংককে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে।
সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের মোট ঋণ ছিল ১ লাখ ৮১ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকের মোট ঋণের অর্ধেকেরও বেশি এখন অনাদায়ী, যা নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) হিসেবেই ধরা হচ্ছে।
মাত্র এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮৮ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ছিল ১৭ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা (মোট ঋণের ১১ শতাংশ)।
ব্যাংকটি এখন ৮৫ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকার প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতিতে আছে। লোকসান সামাল দিতে ব্যাংকগুলো যে নিরাপত্তা সঞ্চয় রাখে, সেখানে এমন বিশাল ঘাটতি ব্যাংকের ক্ষতির ব্যাপকতা দেখায়।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, আগের সরকারের সময় এস আলম গ্রুপ ব্যাংকের বোর্ড নিয়ন্ত্রণে এনে নিজেদের নামে ও প্রক্সি বা ছায়া কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল ঋণ নেয়, যার বড় অংশই পরবর্তীতে খেলাপি হয়।
তাদের ভাষায়, মাত্র একটি গোষ্ঠীর অনিয়মই ব্যাংককে আজকের এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রুপটির প্রভাব থাকা বোর্ড ভেঙে দেয়।
এর পরই ব্যাংকের বহুদিনের গোপন ক্ষতি ও অনিয়ম একে একে প্রকাশ পেতে শুরু করে। শেয়ারহোল্ডার হিসাবও দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে।
২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। কিন্তু সরকারের পতনের এক মাসের মধ্যেই তা বেড়ে হয় ১৭ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা (১১ শতাংশ)।
গত বছরের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয় ৩২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা (২১ শতাংশ), আর চলতি বছরের মার্চ শেষে তা হয় ৪৭ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা (২৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ)।
এস আলম গ্রুপই নিয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা
প্রায় সাত বছর ধরে ইসলামী ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল এস আলম গ্রুপ। ২০১৭ সালে গোষ্ঠীটি ব্যাংকের মালিকানা ও সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার শুরু করার পর থেকেই ব্যাংকটি আর্থিকভাবে দুর্বল হতে থাকে।
২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত এস আলম গ্রুপ নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ও ছায়া কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়। এর মধ্যে প্রায় ৬৬ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, এই ঋণগুলো নেওয়া হয় গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, তার পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নামে।
সাইফুল আলম ও গ্রুপের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা বর্তমানে পলাতক। মন্তব্যের জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি।
এস আলমের ঘনিষ্ঠ নাবিল গ্রুপ নিজেদের নামে ও অজ্ঞাত প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়। এর একাংশ বিশেষ নীতিতে সম্প্রতি পুনঃতফসিল করা হয়েছে।
যোগাযোগ করলে নাবিল গ্রুপের এমডি মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, 'নাবিল গ্রুপের নামে নেওয়া ঋণগুলো নিয়মিত। অজ্ঞাত ঋণ সম্পর্কে আমি জানি না। আমি ঋণখেলাপি নই।'
ইসলামী ব্যাংকের অন্যান্য বড় ঋণগ্রহীতার মধ্যে রয়েছে নাসা গ্রুপ, নোমান গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ, যমুনা টায়ার, জিএমএস গ্রুপ, মুরাদ এন্টারপ্রাইজ, এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ডেল্টা গ্রুপ, বসুন্ধরা মাল্টিফুড গ্রুপ ও মাহমুদ ডেনিমস লিমিটেড।
ঋণগ্রস্ত অন্য ব্যাংকেও আটকে আছে ইসলামী ব্যাংকের বিপুল অর্থ
ইসলামী ব্যাংক আরও পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংককে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যার এক টাকাও ফিরে আসেনি।
এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় জনতা ব্যাংকের কাছে ১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে।
ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, যে পাঁচ ব্যাংক একীভূত হচ্ছে, সেগুলো নগদ অর্থ পরিশোধ না করবে না। তবে এর পরিবর্তে ইসলামী ব্যাংক নতুন একীভূত ব্যাংকের শেয়ার পাবে—এমন আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আগের সরকারের সময় ইসলামী ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়ে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষ্পত্তি হিসাবেও ঘাটতি তৈরি হয়। বর্তমানে তারল্য কিছুটা স্থিতিশীল এবং আমানতকারীরা টাকা তুলতে পারছেন। তবে খেলাপি ঋণের বোঝা রয়ে গেছে।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচারক (এমডি) ও সিইও ওমর ফারুক খান বলেন, ব্যাংকের তারল্য এখন খুবই শক্তিশালী। তিনি জানান, আইনগত পদক্ষেপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ঋণ পুনরুদ্ধার জোরদার করা হয়েছে।
ব্যাংকটি খেলাপিদের বিরুদ্ধে ৪৮৮টি মামলা করেছে। ৩৪টি মামলা হয়েছে অর্থ ঋণ আদালতে, এসব মামলায় দাবির পরিমাণ ৬৬ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ৩৭৭টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। আরও ১ হাজার ৮৮১টি মামলায় মোট দাবি ১৯ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। ১০টি মামলা রয়েছে স্টক/সম্পদ বিক্রি সংক্রান্ত, যেগুলোর মূল্য ২৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।
ওমর ফারুক বলেন, নগদ অর্থ পুনরুদ্ধারই এখন প্রধান অগ্রাধিকার। তবে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনঃতফসিলে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকটির লক্ষ্য খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশে নিয়ে আসা।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম মন্থর হয়ে পড়েছে, ফলে ঋণ পুনরুদ্ধারও ধীরগতির। বিদেশে থাকা সম্পদ উদ্ধারে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে চুক্তি করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৬৩৫ কোটি টাকা, যা চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরের বছর তা নেমে আসে ১০৯ কোটি টাকায়। চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের মুনাফা ৯৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের ২৬৭ কোটি টাকার তুলনায় অনেক কম।
এস আলমের নিয়োগ করা কর্মীদের ছাঁটাই
ইসলামী ব্যাংক এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৬৮৫ জন কর্মীকে বরখাস্ত করেছে। এই কর্মীদের এস আলম গ্রুপ যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই নিয়োগ দিয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। পরে ব্যাংকটি নতুন করে ২ হাজার ৫৭১ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ অডিটে দেখা গেছে, ব্যাংকের ২১ হাজার কর্মীর মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি নিয়োগ করা হয় ২০১৭ সালের পর। মানে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়ে।
ব্যাংকের নথি বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত কেবল চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকেই ৭ হাজার ২২৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০০–এর বেশি নিয়োগ হয়েছে সাইফুল আলমের এলাকা পটিয়া থেকে।
ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল উদ্দিন জসিম বলেন, ওই সময়ের প্রায় ১১ হাজার নিয়োগই ছিল অস্বচ্ছ। অনেক ক্ষেত্রে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়নি।
তিনি জানান, যাদের নিয়োগ নিয়ে সবচেয়ে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ ছিল, তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।
ব্যাংকটি সম্প্রতি পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ১ হাজার ৪০০ জন ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার (ক্যাশ), ৮০৬ জন মেসেঞ্জার–কাম–গার্ড এবং ৩৬৫ জন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিয়েছে।