ধুঁকতে থাকা আবাসন খাতের ভরসা মাঝারি আকারের ফ্ল্যাট

জাগরণ চাকমা
জাগরণ চাকমা
7 December 2025, 08:12 AM

প্রায় তিন বছর ধরে চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে টিকে থাকার লড়াই করছে দেশের আবাসন খাত। এই পরিস্থিতিতে মাঝারি আকারের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সংকট মোকাবিলা করছে আবাসন ব্যবসায়ীরা।

আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক সময় তারা বছরে প্রায় এক হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি করতেন। কিন্তু বছর পর বছর ধরে বিক্রি কমতে কমতে এখন প্রায়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে।

এই পরিস্থিতিতে উচ্চ-মধ্যম আয়ের মানুষেরা ১ কোটি থেকে ২ কোটি দামের ফ্ল্যাট কিনতে এখনো আগ্রহ দেখাচ্ছে। এগুলো মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থিত এবং আকারে প্রায় ১ হাজার ২০০ বর্গফুট।

বিটিআই রিয়েল এস্টেটের ব্র্যান্ড ও কমিউনিকেশন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আয়শা সিদ্দিকা বলেন, 'উচ্চ-মধ্যম আয়ের মানুষেরা এখনও কিছুটা আগ্রহ দেখাচ্ছে।'

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তথ্য বলছে, এই শ্রেণির ক্রেতাদের কারণে গৃহ ঋণের আবেদন ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।

শান্তা হোল্ডিংসের চিফ সেলস অফিসার শিহাব আহমেদ জানান, প্রিমিয়াম বা উচ্চমূল্যের অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা ব্যাপক কমেছে।

তিনি বলেন, এই শ্রেণির প্রধান ক্রেতা রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা এবং বিক্রি ৬০ শতাংশের বেশি কমেছে।

প্রিমিয়াম ফ্ল্যাট সাধারণত দুই হাজার বর্গফুটের বেশি হয়ে থাকে এবং দাম ২ কোটি ৫০ লাখের ওপর।

ডেভেলপাররা বলছেন, গত বছরের আগস্টে সরকারের পতনের পরে ধনী ক্রেতারা লুকিয়ে আছেন বা চুপ আছেন।

তারা আরও জানান, অন্তর্বর্তী সরকার যখন অঘোষিত আয়কে বৈধ করার সুযোগ বন্ধ করেছে, তখন এখানে বিনিয়োগ আরও কমেছে। আগে ওই সুবিধা ধনী শ্রেণির কিছু মানুষকে বড় ফ্ল্যাট কিনতে উৎসাহী করত।

আয়শা সিদ্দিকা বলেন, 'বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষ খরচ করতে চান না। এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে সরাসরি ফ্ল্যাট বিক্রির ওপর।'

এদিকে কম দামি ফ্ল্যাটের চাহিদাও কমেছে। এগুলোর আকার আকার ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৫০ বর্গফুট এবং এগুলোর দাম ১ কোটি টাকার কম। কারণ কয়েক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকের উচ্চ সুদহারের কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে।

এর আগে, করোনা মহামারির পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছিল। তবে তার পরের বছর আবার কমে যায়।

মাঝারি আকারের বাজারেও প্রভাব পড়েছে

বর্তমানে আবাসন খাতকে কিছুটা টিকিয়ে রেখেছে মাঝারি আকারের ফ্ল্যাট। তবে এই সেগমেন্টেও প্রভাব পড়েছে।

শান্তা হোল্ডিংসের শিহাব আহমেদ বলেন, মাঝারি আকারের ফ্ল্যাট বিক্রি ২০২৩ অর্থবছরের চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে।

তার ভাষ্য, 'এই সেগমেন্টটি ডেভেলপারদের নগদ আয়ের প্রধান উৎস এবং পুরো শিল্পেও অবদান রাখে। তাই এই সেগমেন্ট সমস্যায় পড়ার মানে পুরো খাত সমস্যায় পড়া।'

বিটিআইয়ের আয়শা সিদ্দিকা বলেন, ফ্ল্যাটের চাহিদা শেষ হয়ে যায়নি, এটি মাঝারি আকারের ক্রেতাদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। আবার কম দামের গ্রাহকের সংখ্যাও বাজারে কিছুটা কমেছে।

তিনি আরও বলেন, মাঝারি আকারের ফ্ল্যাটের ক্রেতারা কম দামের প্রত্যাশায় থাকেন। কিন্তু জমি ও নির্মাণ সামগ্রীর উচ্চ মূল্যের কারণে ডেভেলপাররা জন্য সেই প্রত্যাশা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

'কিছু ছাড় থাকে, যেগুলো প্রকাশ করা হয় না। সাধারণত গ্রাহকের সঙ্গে দাম বা বিক্রি সংক্রান্ত আলোচনা ব্যক্তিগতভাবে করা হয়,' যোগ করেন তিনি।

এদিকে কম দামি ও বেশি দামি ফ্ল্যাটের বিক্রি কমলেও গৃহ ঋণের চাহিদা স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের মর্টগেজ প্রধান জানান, মাঝারি আকারের ফ্ল্যাটের ক্রেতারা এখন সক্রিয়। এছাড়া গ্রুপ হাউজিং দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে, যেখানে অনেকে একসঙ্গে জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করছেন।

তিনি জানান, বর্তমান গৃহ ঋণের সুদের হার ১১ থেকে ১২ শতাংশ। সর্বোচ্চ মেয়াদ ২৫ বছর এবং লোনের সর্বোচ্চ সীমা ২ কোটি টাকা।

নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমেছে

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, এ শিল্পে বিক্রি অনেক কমেছে। বর্তমান অনিশ্চয়তাগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি এমনই থাকতে পারে।

নতুন ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানও (ড্যাপ ২০২২-২০৩৫) এই শিল্পের ওপর প্রভাব ফেলেছে। কারণ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অনেক জায়গায় ভবনের উচ্চতা এবং ফ্লোর এরিয়া রেশিও কমিয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, এর ফলে নতুন প্রকল্প কমেছে এবং কিছু চলমান প্রকল্পও স্থগিত হয়ে আছে।

শান্তা হোল্ডিংসের শিহাব আহমেদ বলেন, বিক্রি কমায় ছোট ও মাঝারি ডেভেলপাররা আর্থিক চাপে পড়েছেন।

'পাশাপাশি উচ্চ সুদের হার ও ব্যাংকে নগদ টাকার ঘাটতির কারণে কোম্পানিগুলোর জন্য পুঁজির যোগান বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে,' বলেন তিনি।

কনকর্ড গ্রুপের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অনুপ কুমার সরকার বলেন, যেসব কোম্পানির বহুমুখী ব্যবসা আছে তারা পরিস্থিতি ভালোভাবে মোকাবিলা করছে। কিন্তু যাদের ব্যবসার পরিধি কমানো কোম্পানিগুলো বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।

অনুপ কুমার সরকার বলেন, এই খাত কবে ঘুরে দাঁড়াবে তা কেউ বলতে পারবে না। তবে চাহিদা বাড়লে দাম বাড়তে পারে।

রিহাবের লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমায় সরবরাহও কমছে। প্রতিবছর বাজারে একটি স্বাভাবিক চাহিদা থাকে। কিন্তু সরবরাহ সেই সীমার নিচে নেমে গেলে চাপ তৈরি হয়, যা শেষ পর্যন্ত দামের ওপর প্রভাব ফেলে।'