যেখানেই যেতেন সঙ্গে থাকত ক্যামেরা

শাহ আলম সাজু
শাহ আলম সাজু
6 November 2025, 16:44 PM

গুণী অভিনেতা ও নির্দেশক  আলী যাকের। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ছিলেন তিনি। ঢাকার মঞ্চ নাটকে অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়ে অনন্য হয়ে আছেন। 'গ্যালিলিও' তার অভিনয় জীবনের সেরা একটি চরিত্র। 'নূরলদীন' ও 'দেওয়ান গাজী' চরিত্র দুটো তাকে অন্যরকম খ্যাতি এনে দিয়েছে।

১৯৭২ সালে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় শহীদ মুনীর চৌধুরীর 'কবর' নাটকে প্রথম অভিনয় করেন।

অভিনয়ে অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদকসহ অনেক পুরস্কার।

টেলিভিশনে 'বহুব্রিহী' ও 'আজ রবিবার' তার অভিনীত সাড়া জাগানো দুটো ধারাবাহিক নাটক। আরও অনেক আলোচিত নাটকে অভিনয় করেছেন। নন্দিত সিনেমা 'লালসালু' ও 'রাবেয়া'-তে অভিনয় করেছেন।

৬ নভেম্বর অভিনেতা-নির্দেশক আলী যাকেরের জন্মদিন।

২৩ বছর আগে আলী যাকেরের বেইলি রোডের নওরতন কলোনির অফিসে প্রথমবার মুখোমুখি হই বরেণ্য এই অভিনেতার। একদিন তারা বাসাতেও আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আরেকদিন দ্য ডেইলি স্টারের আমন্ত্রণে অফিসে এলে সেদিনও গল্প হয়েছিল।

আলী যাকেরের জন্মদিনে ডেইলি স্টারের পাঠকদের জন্য তার সঙ্গে আড্ডার কিছু স্মৃতি তুলে ধরা হলো।

২৩ বছর আগের এক শীতের বিকেল। একটি ম্যাগাজিনে কাজ করি। আলোকচিত্রী সহকর্মীর মোটরসাইকেলে করে পৌঁছে যাই বেইলি রোডের নওরতন কলোনির একটি বাড়িতে। সেটাই ছিল আলী যাকেরের অফিস।

তার অফিসে ঢোকার পর দেখতে পাই সুন্দর গোছানো একটি রুমে বসে আছেন। টেবিলে দামি একটি ক্যামেরা। হাসি মুখে বললেন, 'ইয়াংম্যান, বলো কী জানতে চাও?'

আমার সঙ্গে থাকা আলোকচিত্রী বললেন, 'আগে আপনার ছবি তুলতে চাই।'

তিনি রাজি হলেন। চা-বিস্কিট চলে এলো। চা খেতে খেতে আলী যাকের অফিসের সৌন্দর্য দেখতে থাকি, মুগ্ধ হই। দেয়ালের ছবিগুলো মুগ্ধতা দেয় বেশি।

আমরা ছাদে যাই আলী যাকেরের সঙ্গে। বেশ কিছু ছবি তোলা হয়। আমাদের ছবি তোলা শেষ হওয়ার পর তিনিও নিজের ক্যামেরায় প্রকৃতির কিছু ছবি তুললেন।

তার ছবি তোলা আরেকবার মুগ্ধ করে আমাদের। বললেন, 'ছবি তুলি শখে। যেখানেই যাই ক্যামেরা সঙ্গে রাখি। প্রকৃতির ছবি বেশি তুলি। এক ধরনের নেশা ও ভালোবাসা থেকে কাজটি করি।'

তার তোলা ছবিগুলো দেখালেন আমাদের।

আলোকচিত্রী বললেন, আরও কিছু ছবি তুলতে পারি?

হেসে সম্মতি দিলেন। আবারও কিছু ছবি তোলা হলো। এরপর বললেন, 'অনেক ছবি হয়েছে, এবার নিচে চলো। তোমাদের সঙ্গে গল্প করা যাক।'

ফের চা এলো। চা খেতে খেতে গল্প শুরু হলো। এত বড় মাপের একজন অভিনেতার কাছাকাছি ওটাই প্রথম। তার ব্যবহার ভালো না লেগে উপায় নেই। টেলিভিশনে তাকে দেখেছি, একরকম আর সামনা-সামনি দেখলাম আরেকরকম। যত দেখছি ততই ভালো লাগছে।

এক পর্যায়ে তিনি বললেন, 'কী জানতে চাও?'

প্রশ্ন করি, আপনার প্রথম অভিনীত নাটক কোনটি?

দেয়ালে চোখ রেখে বললেন, 'শহীদ মুনীর চৌধুরীর "কবর" নাটকে প্রথম অভিনয় করি। এটি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির কথা। নাট্যজন মামুনুর রশীদ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এরপর একসময় আমি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যুক্ত হই। নিজ দলের হয়ে প্রথম অভিনয় করি 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো' নাটকে। অভিনয়ে পথচলা শুরু হলো। এভাবেই চলছে এখনো।

ফের প্রশ্ন করি, এদেশের মঞ্চ নাটকে আপনার অবদান বিশাল? কীভাবে দেখেন?

আলী যাকের বললেন, 'খুব ইতিবাচকভাবেই দেখি। কেননা, আমরা নাটকে এসেছিলাম ভালোবাসা থেকে। অভিনয় টানতো। অভিনয় ভালো লাগতো। প্রচণ্ড ভালোবাসা না থাকলে কোনো কাজেই সফলতা আসে না। সেরকম তীব্র ভালোবাসা থেকেই অভিনয়ে আসি। বিনিময়ে কী পাব তা ভাবিনি। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় থেকে একটার পর একটা নাটক করে গিয়েছি। কখনো অভিনয় করেছি, কখনো মঞ্চে নির্দেশনা দিয়েছি। কতটুকু দিতে পেরেছি তা দর্শকরা বলতে পারবেন।'

জানতে চাইলাম, টেলিভিশন নাটক নাকি মঞ্চ বেশি টানে?

বললেন, 'মঞ্চ নাটকই বেশি টানে। মঞ্চে অভিনয় করে সরাসরি দর্শকদের ভালোবাসা পাওয়া যায়। দর্শকরা সরাসরি ভালোবাসার কথা জানাতে পারেন। এখানে অভিনয় করার অন্যরকম আনন্দ আছে। যারা মঞ্চে অভিনয় করেন, তারা ভালো বলতে পারেন। নূরলদীন, দেওয়ান গাজী, গ্যালিলিও—মঞ্চে এগুলো আমার প্রিয় চরিত্র।

প্রশ্ন করলাম, কোন লেখকের লেখা বেশি টানে?

তিনি বললেন, অনেক লেখক। কজনের নাম বলব? তবে, রবীন্দ্রনাথের লেখা ভীষণ টানে। বারবার পড়তে ইচ্ছে করে।

আরও অনেক কথা হয় সেদিন তার অভিনয়জীবন নিয়ে।

একসময় জানতে চাই—জীবনের সেরা প্রাপ্তি কী?

বললেন, 'বাংলাদেশ পেয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পেয়েছি ১৯৭১ সালে, এটিই জীবনের বড় পাওয়া। আর কী চাই? দেশ স্বাধীন করার পেছনে আমাদের অবদান আছে, নতুন একটি দেশের জন্ম দেখেছি। যেদিন দেশ স্বাধীন হলো সেদিন কী যে খুশি হয়েছিলাম! ওই স্মৃতি ভুলবার নয়।'

শীতের বিকেল শেষ হয়ে আসে। আমরা বেইলি রোডের তার অফিস থেকে বিদায় নিই। মোটরসাইকেল চলতে থাকে গ্রীনরোডে আমাদের অফিসের দিকে, স্মৃতিতে ভাসতে থাকল তার সেরা নাটকগুলোর বিভিন্ন দৃশ্য।

বরেণ্য এই অভিনেতার জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।