এক ফোঁটা পানির জন্য প্রতিদিনের সংগ্রাম

ওয়াসিম বিন হাবিব
ওয়াসিম বিন হাবিব
24 November 2025, 06:37 AM

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলবর্তী খুলনা জেলা। এই জেলার কয়রা উপজেলার একটি গ্রাম দক্ষিণ কালিকাপুরে থাকেন ২৭ বছর বয়সী হোসনেয়ারা। প্রতিদিন সকালে তিনি একটা কলসি হাতে নিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার হাঁটেন খাবার পানির খোঁজে।

হোসনেয়ারার গন্তব্য একটি ছোট পুকুর, সেখানে গেলে এখনো কিছুটা ঘোলা পানি মেলে। পানির ওপর ভাসে পাতলা হলদেটে স্তর। কলসি দিয়ে সেই স্তর সরিয়ে হালকা সবুজাভ সেই পানি ভরতে থাকেন হোসনেয়ারা।

দুই সন্তানের মা হোসনেয়ারা কাঁখে কলসি নিতে নিতে বলেন, 'আমরা কাপড় দিয়ে পানি ছেঁকে খাই। এই পুকুরই আমাদের একমাত্র ভরসা। এটাই আমাদের জীবন।'

আশপাশের সব পুকুরের পানির স্বাদ অনেক আগেই নোনতা হয়ে গেছে। টিউবওয়েল থেকেও আর স্বাদু পানি বের হয় না, আসে শুধু লবণাক্ত পানি। ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুদ্ধে এক ফোঁটা খাবার পানির জন্য প্রতিদিন লড়াই করতে হচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষদের।

হোসনেয়ারার পরিবারে প্রতিদিন দুই কলসি পানি লাগে। তাই দুপুরে তাকে আবার ওই পুকুরে যেতে হবে। অসুস্থতার কারণে কখনো যেতে না পারলে বিশুদ্ধ পানি কিনতে হয় এক জার ২০ টাকায়। আর রিকশাভ্যানে আনার জন্য লাগে আরও ২০ টাকা।

হোসনেয়ারার স্বামী একটি ছোট দর্জির দোকানে কাজ করেন। এই নারীর ভাষ্য, 'আমাদের মতো গরিব মানুষের পক্ষে প্রতিদিন পানি কেনা একটা বিলাসিতা। প্রতিটি ফোঁটা হিসাব করে ব্যবহার করতে হয়।'

খুলনা-সাতক্ষীরার উপকূলবর্তী বহু পরিবারের অবস্থাই হোসনেয়ারার পরিবারের মতো।

ভৌগোলিক দিক দিয়ে সাগরের কাছে অবস্থিত খুলনা-সাতক্ষীরার উপকূলবর্তী মানুষদের জন্য লবণাক্ততা একটি দীর্ঘ লড়াই। ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্ষতিকর মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।

সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, উজানে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া এবং চিংড়ি চাষের জন্য খাল-বাঁধ কেটে নোনাপানি ঢোকানোর ফলে পানির উৎসগুলো দূষিত হয়ে গেছে। ভালো পুকুরগুলো ও টিউবওয়েলের পানিও নোনতা হয়ে গেছে।

ইউএনডিপির এক জরিপ বলছে, খাল-বিলসংলগ্ন পাঁচটি উপকূলীয় উপজেলার ৭৩ শতাংশ মানুষ এখন অনিরাপদ নোনাপানি পান করেন। উপজেলাগুলো হলো—খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর।

এই অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততা প্রতি লিটারে ১ হাজার ৪২৭ থেকে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম। এটা অনুমোদিত সর্বোচ্চ সীমা এক হাজার মিলিগ্রামের চেয়ে অনেক বেশি। ২০২১ সালে করা এই জরিপটি করা হয় ৬৬ হাজার ২৩৪ পরিবারের ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৪ জনের অংশগ্রহণে।

এক ফোঁটা পানির জন্য সংগ্রাম

খুলনার ও সাতক্ষীরার এই অঞ্চলগুলোতে প্রতিদিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—নিরাপদ পানি পাওয়া। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত নারী ও কিশোরীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটেন। তারপর গিয়ে পুকুর, সরকারি বা এনজিওর পানি পরিশোধন প্ল্যান্টের সামনে লাইনে দাঁড়ান।

গোসল, ধোয়া-মোছা, রান্নার কাজে তারা নোনাপানি ব্যবহার করতে বাধ্য হন। ফলে চর্মরোগে ভোগেন অনেকে।

এই এলাকায় গভীর টিউবওয়েল বসানোও কঠিন। কারণ ভূগর্ভে প্রচুর কাদা, বালি ও পাথর। তাই ভরসা করতে হয় বর্ষার বৃষ্টির পানি, পুকুরের পানি পরিশোধন ফিল্টার (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার-পিএসএফ) আর রিভার্স ওসমোসিস (আরও) প্ল্যান্টের ওপর। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে যন্ত্রগুলোর অনেকগুলোই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বিদ্যুৎও থাকে না।

বর্ষায় ট্যাংকে জমা বৃষ্টির পানি কিছুদিন স্বস্তি দেয়। কিন্তু বৃষ্টি থামলেই আবার তৃষ্ণার লড়াই শুরু হয়। অক্টোবর থেকে মে পর্যন্ত পানির লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। গ্রীষ্মে যখন অগভীর পুকুরগুলো ছোট হয়ে আসে এবং পানি ঘোলাটে হয়ে যায়, তখন মানুষের দুর্দশা চরমে ওঠে।

দক্ষিণ কালিকাপুর গ্রামের গৃহিণী নারগিস বলেন, 'পুকুরে যে পানি থাকে, তাতেও গন্ধ ওঠে। কাপড়ে ছেঁকে ফিটকিরি দিয়ে পরিষ্কার করি। পানি ফোটানোর সামর্থ্য আমাদের নেই।'

এই গ্রামের পুকুরটিতে আগে পিএসএফ ছিল, এখন তা নষ্ট। তারপরও গ্রীষ্মকালে দূরদূরান্তের মানুষ এখান থেকে পানি নিয়ে যায়।

মহেশ্বরীপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারী জানান, ইউনিয়নের ৮০ শতাংশ মানুষের নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই। দুটি আরও পানি পরিশোধন প্ল্যান্টও বন্ধ। তিনটি পিএসএফ চালু আছে।

একই অবস্থা সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনিতেও। শ্যামনগরের পশ্চিম পোড়াকাটলার বাসিন্দা ১৪ বছরের সাথী বলে, 'চারদিকে কত পুকুর-খাল, কিন্তু কোনোটার পানি খাওয়া যায় না। সারা বছরই পানির অভাব।'

বুড়িগোয়ালিনী দারুস সুন্নাত দাখিল মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী চার সদস্যের পরিবারের জন্য প্রতিদিন পানি আনার সংগ্রামে নামে। সে প্রতিদিন বিকেলে তিন কিলোমিটার দূরের পিএসএফ প্ল্যান্টে গিয়ে দুই কলসি ভরে পানি আনে। হাঁটতে তার লাগে আধঘণ্টা। তবে প্রায়দিনই দুই ঘণ্টার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

সাথী বলে, 'কখনো ভিড় কম থাকে, তাড়াতাড়ি ফিরতে পারি। কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।'

সাথীর বাবার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে, আর মা কাজ করতে যান কাঁকড়ার ঘেরে। সাথী বলে, 'এক কলসি কোমরে, আরেকটা হাতে নেই, ব্যথায় কাবু হয়ে যাই। কিন্তু করতে তো হবেই। না হলে নোনাপানি খেতে হবে।'

এখানকার মানুষ বলছেন, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার পর সংকট বেড়েছে। জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে লবণাক্ত পানি ঢুকে দীর্ঘদিন জমে ছিল। আর এটাই স্থানীয় পানির উৎসে লবণাক্ততা স্থায়ীভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।

বেঁচে থাকার ব্যয়

অনেকে বাধ্য হয়ে বিক্রেতাদের কাছ থেকে বিশুদ্ধ পানি কেনেন। দিনমজুর পরিবারের জন্য এটি প্রায় অসম্ভব ব্যয়, প্রতি লিটার ৫০ পয়সা, ২০ লিটারের জার ১০ টাকা করে (যাতায়াত খরচ বাদে)। এর তুলনায় ঢাকা বাসিন্দারা ওয়াসার এক হাজার লিটার পানির জন্য দেন ১৬ টাকা।

পদ্মপুকুর গ্রামের এক দিনমজুরের স্ত্রী জাহানারা বলেন, 'মাসে ৪০০ টাকা শুধু পানি কিনতেই চলে যায়। ভাত-মাছ, সবজি, ওষুধপত্রের পর আর কিছুই হাতে থাকে না। কিছুদিন কম পানি খেয়ে থাকতে হয়। এমন করতে চাই বলে না, বাধ্য হয়ে করা লাগে।'

সরকার, দাতা সংস্থা ও এনজিও মিলে এসব এলাকায় বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, আরও প্ল্যান্ট, পিএসএফ—সবই আছে। কিন্তু আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের 'উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্প'১০টি উপকূলীয় জেলায় চালু আছে। এর মধ্যে খুলনা ও সাতক্ষীরাও আছে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে শুরু হয় এ প্রকল্প।

প্রকল্পটির অধীনে ডিসেম্বর নাগাদ মোট ২ লাখ ৬ হাজার ৮৭২টি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ইউনিট (ট্যাংক, ফিল্টার, বিতরণ ব্যবস্থা) স্থাপনের লক্ষ্য ছিল। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৭০ হাজার ইউনিট বসানো হয়েছে। আরও ৮ হাজার ইউনিট বসানোর জন্য টেন্ডার চলছে।

তবে সাতক্ষীরা-খুলনার মানুষ অভিযোগ করছেন, এই ইউনিট স্থাপনেও পক্ষপাতিত্ব হয়েছে। দক্ষিণ কালিকাপুরের শহিদুল গাজী বলেন, 'আমাদের একমাত্র ভরসা বৃষ্টির পানি, কিন্তু এখনো কোনো ট্যাংক পাইনি। পুরো ইউনিট লাগবে না, একটা পানি রাখার ট্যাংক পেলেই হবে।'

প্রকল্প কর্মকর্তাদের কেউ কেউ স্বীকার করেছেন যে, কোথাও কোথাও জনপ্রতিনিধিরা সুবিধাভোগীর নাম ঠিক করে দিয়েছেন। ফলে অনেকের প্রয়োজন না থাকলেও পেয়েছেন। এখনো প্রচুর চাহিদা আছে।

এনজিও প্রেরণার নির্বাহী পরিচালক শম্পা গোস্বামী জানান, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে পানির সংকট বাড়ছে। সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগগুলো বিচ্ছিন্ন।

তিনি বলেন, 'ছোট ছোট প্রকল্প নয়, বরং সরকারের নেতৃত্বে সমন্বিত কর্মসূচি দরকার। যেন বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে মানুষ সারা মৌসুমে ব্যবহার করতে পারে।'

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শারমিন নীলরম বলেন, 'শুধু বৃষ্টির পানি নয়, উপকূলে সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এতে লবণমুক্তকরণ (ডিস্যালিনেশন) প্রযুক্তিও থাকতে হবে। ব্যয় বেশি হলেও মানুষের জীবনের চেয়ে বড় কিছু নাই।'

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় পরিসরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও কমিউনিটি-স্তরের ডিস্যালিনেশন চালু হলে উপকূলবাসী টেকসই সমাধান পাবে। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের সঠিক মানচিত্র তৈরি জরুরি।

শুকনো মৌসুম আসছে। হোসনেয়ারা, সাথীসহ আরও হাজারো মানুষের পথ আরও লম্বা হবে। পুকুর আরও শুকিয়ে যাবে, লবণাক্ততা বাড়বে। আর তাদের কাঁখের কলসির ভার বাড়তে থাকবে।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের খুলনা ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি)