৫০ বছরে ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের অর্জন কী
৫০ বছরেরও বেশি আগে ১৯৭১ সালের গ্রীষ্মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন মাদককে 'এক নম্বর গণশত্রু' ঘোষণা করে এর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন, যা পরবর্তীতে 'মাদকবিরোধী যুদ্ধ' নামে পরিচিত হয়।
এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তাঘাটকে মাদকমুক্ত করা, পাচার নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং মার্কিন নাগরিকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির অঙ্গীকার করেছিল।
কিন্তু বাস্তবে দশকের পর দশক ধরে শাস্তিমূলক পুলিশি ব্যবস্থা ও সামরিক ধাঁচের দমনপীড়নের পরও যুক্তরাষ্ট্র রেকর্ড মাত্রায় মাদকের ওভারডোজজনিত মৃত্যু, পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ কারাবন্দির দেশ এবং মাদক সরবরাহ বা চাহিদা কমানোর তেমন কোনো প্রভাব ছাড়াই মাদকের পেছনে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এসব তথ্য সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের।
যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মাদকবিরোধী যুদ্ধে পুলিশিং ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে নতুন রূপ দেয়, যেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের অসমভাবে কারাগারে ঠেলে দেওয়া হয়। দেশের বাইরে লাতিন আমেরিকাজুড়ে সমান্তরাল এক সংঘাত তারা উস্কে দেয়, যেখানে মার্কিন সমর্থিত অভিযানের মাধ্যমে দুর্নীতি ও সংগঠিত অপরাধ আরও গভীর হয়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিলের ওভারডোজের কারণে মৃত্যুর হার ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং বহু অঙ্গরাজ্য গাঁজাকে বৈধ করার পথে এগিয়েছে।
বর্তমানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুতি নিয়েছে। দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচারের অভিযোগ আনলেও এর পক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করেনি ওয়াশিংটন। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে, মাদকবিরোধী যুদ্ধ কীভাবে শুরু হয়েছিল এবং তা যুক্তরাষ্ট্রসহ আঞ্চলিক কী প্রভাব ফেলেছে।
যেভাবে শুরু
যুক্তরাষ্ট্রের এক অস্থির রাজনৈতিক সময়ে মাদকবিরোধী যুদ্ধ শুরু করেন নিক্সন। ষাটের দশকের শেষ দিকে ভিয়েতনামফেরত সেনাদের মধ্যে হেরোইন ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, তরুণদের মধ্যে মাদকের ব্যবহার বাড়ে এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়।
নিক্সন প্রশাসন নতুন ফেডারেল সংস্থা তৈরি করে, কঠোর শাস্তি আরোপ করে এবং মাদক ব্যবহারে জাতীয় স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়—এমন বর্ণনা তুলে ধরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে।
এর রাজনৈতিক যুক্তি পরে প্রকাশ করেন নিক্সনের সহকারী জন এরলিকম্যান। তিনি ২০১৬ সালে এক সাংবাদিককে বলেন, প্রশাসন যুদ্ধবিরোধী বামপন্থী আন্দোলনকারী ও কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের প্রধান 'শত্রু' হিসেবে দেখতো।
সরকার যেহেতু ভিন্নমতাবলম্বী বা জাতিসত্ত্বাকে অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করতে পারেনি, তাই তারা 'হিপ্পিদের' সঙ্গে গাঁজা ও কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে হেরোইনকে যুক্ত করে উভয় গোষ্ঠীকেই ব্যাপকভাবে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে।
এরলিকম্যানের মতে, লক্ষ্য ছিল ওই সম্প্রদায়গুলোকে ভেঙে দেওয়া, তাদের বাড়িতে অভিযান চালানো, নেতাদের গ্রেপ্তার করা এবং সংবাদমাধ্যমে তাদের অপরাধী হিসেবে তুলে করা।
তিনি বলেন, 'আমরা জানতাম যে, মাদক নিয়ে মিথ্যা বলছি।'
১৯৮০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সময় এই অভিযান নাটকীয়ভাবে তীব্র হয়। ১৯৮৪ সালের কমপ্রিহেনসিভ ক্রাইম কন্ট্রোল অ্যাক্ট গাঁজা রাখার শাস্তি আরও কঠোর করে।
১৯৮৬ সালের অ্যান্টি-ড্রাগ অ্যাবিউজ অ্যাক্ট ন্যূনতম সাজা নির্ধারণ করে এবং এমন শাস্তিমূলক কাঠামো তৈরি করে, যা শেষ পর্যন্ত কারাবন্দিদের মধ্যে বড় ধরনের বর্ণগত বৈষম্য সৃষ্টি করে।
এই আইন অনুযায়ী ৫ গ্রাম ক্র্যাক কোকেন পাওয়া গেলে ন্যূনতম পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হতো। অথচ অনেক বেশি দামি পাউডার কোকেনের ৫০০ গ্রাম পাওয়া গেলেও ন্যূনতম একই শাস্তি নির্ধারিত ছিল।
আইনটি পাস হওয়ার পর কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের কারাবন্দির হার পাঁচগুণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ, প্রতি এক লাখে ৫০ জন থেকে বেড়ে ২৫০ জন হয়ে যায়।
১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকের প্রশাসন এই নীতিগুলো অব্যাহত রাখে। বিল ক্লিনটনের ১৯৯৪ সালের ক্রাইম বিল কারাগারে ফেডারেল অর্থায়ন বাড়ায়, আরও আক্রমণাত্মক পুলিশিং চালু করে এবং বিতর্কিত 'থ্রি-স্ট্রাইকস' নীতি প্রবর্তন করে—যেখানে তৃতীয়বার কোনো সহিংস অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বাধ্যতামূলক ছিল।
বুশ বা ওবামা প্রশাসনের সময়ও তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
২০১০-এর দশক পর্যন্ত মাদক ব্যবহারের আলোচনায় কোনো বড় পরিবর্তন আসেনি। গাঁজা বৈধকরণের প্রসার এবং প্রেসক্রিপশন পেইন কিলারের কারণে তৈরি ওপিওয়েড সংকট দেখিয়ে দেয় যে, শাস্তি দিয়ে আসক্তি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
এখন ট্রাম্প গত অর্ধশতকে চালু হওয়া বহু অভ্যন্তরীণ নীতি বজায় রেখেও দৃষ্টি দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের দিকে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার জলসীমার কাছে ক্যারিবিয়ানে ডজন ডজন নৌকায় মার্কিন সামরিক হামলার অনুমোদন দেন এবং এটিকে 'মাদক পাচার দমনে নতুন অভিযান' হিসেবে উপস্থাপন করেন। তবে সমালোচকরা বলছেন, এটি মূলত ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ট্রাম্পের কূটকৌশল।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কোনো প্রকাশ্য প্রমাণ দেখাতে পারেনি যে, যেসব নৌকায় তারা হামলা চালিয়েছে সেগুলো মাদক বহন করছিল বা তাদের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
গণগ্রেপ্তার
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে মাদক অপরাধীরা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকহারে কারাবন্দি হতে থাকেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে বছরে ১৬ লাখ মাদক-সংশ্লিষ্ট গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে।
ফেডারেল তথ্য অনুযায়ী, এভাবে গ্রেপ্তারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কারাবন্দি সংখ্যা ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে তিন লাখ থাকলেও চার দশক পরে হয়ে যায় দুই মিলিয়নেরও বেশি।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে মাদকের ব্যবহার থাকলেও কৃষ্ণাঙ্গদের গ্রেপ্তারের হার বহু বছর ধরেই বেশি।
সেন্টেন্সিং প্রজেক্টের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশেরও কম কৃষ্ণাঙ্গ, অথচ মাদক-সংক্রান্ত অভিযোগে মোট গ্রেপ্তারের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি তারাই।
২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, গাঁজা রাখার অভিযোগে কৃষ্ণাঙ্গদের গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় ৩ দশমিক ৭ গুণ বেশি ছিল।
সান্তা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কুলা সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালের অ্যান্টি-ড্রাগ অ্যাবিউজ অ্যাক্ট এবং ক্র্যাক ও পাউডার কোকেন রাখার শাস্তির মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি এই বর্ণগত বৈষম্যের অন্যতম কারণ।
ক্র্যাক কোকেন তুলনামূলক সস্তা এবং প্রধানত কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকার দরিদ্রদের জন্য সহজলভ্য হওয়ায়, সেসব এলাকার বহু কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবহারকারী কারাগারে গিয়েছেন। অন্যদিকে ধনী শ্বেতাঙ্গদের পাউডার কোকেন ব্যবহারের শাস্তি ছিল অনেক কম।
এর পাশাপাশি মাদক দমনের মাধ্যমে সামগ্রিক অপরাধ কমবে, এমন যুক্তিও কার্যকর ফল দেয়নি।
রিগ্যানের ১৯৮৪ সালের অপরাধবিষয়ক আইন পাসের পর যুক্তরাষ্ট্রে হত্যার হার বরং বাড়ে এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তা বাড়তেই থাকে।
একই সময়ে আসক্তিকে জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে বিবেচনা করতেও যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে।
আইনের প্রয়োগ বাড়লেও চিকিৎসা ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তায় বিনিয়োগ কমে যায়। ব্যবহার কমার পরিবর্তে পরিবেশ-পরিস্থিতি মানুষকে মাদকের আরও জটিল রূপের দিকে ঠেলে দেয়।
এ সংক্রান্ত অপরাধ কমাতে 'মাদক রাখার' অপরাধকে দমনের ওপর জোর দেওয়ার সেই প্রবণতা এখনো বদলায়নি।
২০২০ সালে পুলিশ ১১ লাখেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করে, অধিকাংশকেই মাদক রাখার অভিযোগে।
প্রিজন পলিসি ইনিশিয়েটিভের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ মাদক-সংক্রান্ত অভিযোগে কারাবন্দি এবং আরও কয়েক লাখ মানুষ প্রবেশন বা প্যারোলে রয়েছেন।
এতে কোনো সুফল আসেনি। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র এখন ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মাদক সংকটের মুখোমুখি। প্রতি বছর এক লাখেরও বেশি মানুষ মাদকের ওভারডোজে মারা যাচ্ছে, যার প্রধান কারণ ফেন্টানিলের মতো সিনথেটিক ওপিওয়েড।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সী আমেরিকানদের মৃত্যুর প্রধান কারণ এখন মাদকের ওভারডোজ।
মাদকবিরোধী যুদ্ধ যেভাবে লাতিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে
মাদকবিরোধী যুদ্ধ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৯৮০-এর দশকে ওয়াশিংটন লাতিন আমেরিকার সামরিক ও পুলিশ বাহিনীকে অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ দেয়, যাতে উৎস থেকেই মাদক পাচার দমন করা যায়।
লাতিন আমেরিকা ওয়ার্কিং গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র 'প্ল্যান কলম্বিয়া' নামে পরিচিত কর্মসূচির অধীনে কলম্বিয়ায় অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, যার বড় অংশ ব্যয় হয় নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য এবং কোকা ফসল ধ্বংসে।
কলম্বিয়ার মানবাধিকার সংগঠন ও ট্রুথ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এতে কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী দুর্বল হলেও কোকা চাষ আবারও রেকর্ড পরিমাণে ফিরে আসে, আর সাধারণ মানুষকে এর চরম মূল্য দিতে হয়। ১৯৮৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষ এই সংঘাতে নিহত হন।
মেক্সিকোর সরকার ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সহায়তা ও সরঞ্জাম নিয়ে যে অভিযান শুরু করে, তা মাদক কার্টেলে ভাঙন ও প্রভাবক্ষেত্র দখলের লড়াইয়ে ঢেউ তোলে।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের তথ্য অনুযায়ী, এরপর থেকে ৪ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং আরও কয়েক হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন।
কার্টেলগুলো চাঁদাবাজি, জ্বালানি চুরি ও মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি পুলিশ ও স্থানীয় সরকারেও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তর (ইউএনওডিসি) জানায়, এসব দমনপীড়নের ফলে মাদক পাচারের রুট বদলে হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা ও এল সালভাদরসহ মধ্য আমেরিকার দেশগুলো মধ্যদিয়ে নতুন পথ তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এখনো সন্দেহভাজন মাদক পাচারকারীদের লক্ষ্য করে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্যারিবিয়ান সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে মাদক পাচারকারী সন্দেহে পরিচালিত ২১টি সামরিক হামলায় ৮৩ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।