সিরিয়ায় ‘বিপ্লব’ সংগঠিত করতে রাশিয়ায় নির্বাসিত আসাদ ঘনিষ্ঠ দুজনের মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন
মস্কোতে নির্বাসিত সাবেক সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান কামাল হাসান ও চাচাতো ভাই রামি মাখলুফ সিরিয়ায় 'বিপ্লবের' জন্য সশস্ত্র বাহিনী গঠনে ব্যয় করছেন লাখো ডলার।
সিরীয় উপকূলে অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুত করা অন্তত ১৪টি ভূগর্ভস্থ কমান্ড রুমের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
তবে, আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বে সিরিয়ার বর্তমান সরকার 'ষড়যন্ত্র' ঠেকাতে আসাদের তৈরি প্যারামিলিটারি বাহিনী 'ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সেসের' প্রতিষ্ঠাতা খালেদ আল-আহমাদকে ব্যবহার করছে।
আজ শুক্রবারের রয়টার্স প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, গত বছরের ডিসেম্বরে স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর সিরিয়া থেকে পালানো বাশারের অনুগতরা হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের আশায় অর্থের জোগান দিচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সিরিয়া ও লেবাননে আসাদ পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন আসাদের ঘনিষ্ঠ কামাল হাসান ও মাখলুফ।
আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের বসবাস মূলত সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে। বাশার আল আসাদ নিজেও এই সম্প্রদায়ের।
রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলে ৫০ হাজারের বেশি যোদ্ধাকে একত্রিত করতে অর্থের জোগান দিয়ে যাচ্ছে হাসান ও মাখলুফসহ আরও কিছু লোক।
আসাদ পরিবারের ঘনিষ্ঠ অন্তত চারজন রয়টার্সকে জানিয়েছে, গত ডিসেম্বরে রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়া আসাদ পদত্যাগ করলেও তার ভাইসহ ঘনিষ্ঠদের অনেকে হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে আগ্রহী।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, আসাদের ভাই মাহের-আল-আসাদ মস্কোতে থাকলেও এখনো সিরিয়ার হাজারো সাবেক সেনাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে তিনি এখন পর্যন্ত বিদ্রোহের জন্য অর্থ বা কোনো আদেশ দেননি।
এদিকে, হাসান ও মাখলুফ ভূগর্ভস্থ কমান্ড-রুম ও অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান।
সিরিয়ার ২ কর্মকর্তা ও একজন আঞ্চলিক গভর্নর এই গোপন কমান্ড-রুমের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। রয়টার্সও এসব রুমের ছবি পেয়েছে।
দুই পরিকল্পনাকারী
রয়টার্স জানায়, আসাদের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান হাসান নিয়মিত কমান্ডার ও উপদেষ্টাদের ফোন করে যাচ্ছেন এবং ভয়েস মেসেজ পাঠাচ্ছেন। তিনি হারানো ক্ষমতা নিয়ে তার উদ্বেগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরছেন এসব মেসেজে।
আর মাখলুফ গৃহযুদ্ধ চলাকালে স্বৈরশাসক আসাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতেন। এখন তিনি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করলেও নিজেকে 'মহান নেতা' হিসেবে উপস্থাপন করছেন।
দুজনই সিরিয়ার আলাওয়াইত সম্প্রদায় অধ্যুষিত উপকূলীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহী। এই এলাকাগুলোর ওপর বাশার আল আসাদের নিয়ন্ত্রণ সবসময়ই ছিল।
মন্তব্যের জন্য হাসান ও মাখলুফের সঙ্গে রয়টার্স যোগাযোগ করলেও তারা জবাব দেননি। বাশার ও মাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। রয়টার্স বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের মন্তব্য চেয়েও উত্তর পায়নি।
এসব ষড়যন্ত্র ঠেকাতে কাজ করছেন খালেদ আল-আহমাদ, যিনি আসাদের আধাসামরিক বাহিনীর নেতা ছিলেন। যদিও গৃহযুদ্ধের এক পর্যায়ে গিয়ে তিনি আর অনুগত থাকেননি।
তার বর্তমান কাজ হলো আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের সেনা ও বেসামরিক লোকদের বোঝানো যে তাদের ভবিষ্যৎ নতুন সিরিয়ায়।
স্বৈরশাসন বিষয়ক গবেষক আনসার শাহহুদ রয়টার্সকে বলেন, 'এরা আসাদ সরকারের ক্ষমতার সম্প্রসারিত অংশ। তবে আসাদকে খুশি করার পরিবর্তে তার বিকল্প হয়ে ওঠা এবং আলাওয়াইত সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণ করাই ওই দুজনের (হাসান ও মাখলুফ) লক্ষ্য।'
এই 'চক্রান্ত' সম্পর্কে জানেন এমন অন্তত ৪৮ জনের সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে রয়টার্স। তারা সবাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।
রয়টার্স আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড, কার্যক্রম পরিচালনার নথি এবং ভয়েস ও টেক্সট মেসেজও পর্যালোচনা করেছে।
নথি অনুযায়ী, হাসানের দাবি তার অধীনে ১২ হাজার যোদ্ধা আছে। অন্যদিকে মাখলুফের দাবি, তার অধীনে অন্তত ৫৪ হাজার যোদ্ধা আছে।
আর মাঠে থাকা কমান্ডাররা বলছেন, যোদ্ধাদের বেতন খুবই কম এবং তারা উভয়পক্ষ থেকেই অর্থ পাচ্ছেন।
রয়টার্স অবশ্য যোদ্ধার সংখ্যা বা নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিশ্চিত হতে পারেনি। নির্বাসিতরা এখনো কোনো বাহিনীকে একত্রিত করতে পেরেছে বলেও মনে হয়নি।
সিরিয়া সরকারের প্রস্তুতি
উপকূলীয় অঞ্চল টারতুসের গভর্নর আহমেদ আল-শামি বলেছেন, সম্ভাব্য যোদ্ধার সংখ্যা লাখ পর্যন্ত হতে পারে।
আল-শামি আরও বলেন, 'সিরিয়া সরকার এই পরিকল্পনার রূপরেখা সম্পর্কে অবগত এবং মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত।'
তিনি কমান্ড-রুম নেটওয়ার্কের তথ্যও নিশ্চিত করেছেন।
রয়টার্সকে তিনি বলেন, 'আমরা নিশ্চিত যে তারা কার্যকর কিছু করতে পারবে না। কারণ ভূ-গর্ভস্থ বাঙ্কারে শক্তিশালী সরঞ্জাম কম এবং সেগুলোর সক্ষমতাও দুর্বল।'
এ বিষয়ে জানতে লেবাননের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করেনি।
তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একজন কর্মকর্তা বলেন, তাদের দেশের মধ্য দিয়ে 'সব ধরনের অবৈধ আর্থিক লেনদেন' ঠেকাতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যেকোনো বিদ্রোহ সিরিয়ার নতুন সরকারকে অস্থিতিশীল করতে পারে। কারণ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো আসাদকে উৎখাত করা সাবেক আল-কায়েদা কমান্ডার শারার থেকে তাদের সমর্থন তুলে নিয়েছে। 'ষড়যন্ত্র' সফল হলে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঝুঁকি আছে।
তবে, আপাতত 'সফল বিদ্রোহ' হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ প্রধান ষড়যন্ত্রকারী হাসান ও মাখলুফের মধ্যে তীব্র বিরোধ। রাশিয়া থেকে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন পাওয়ার আশাও নেই। সিরিয়ার আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের অনেকেই এই দুজনকে বিশ্বাস করেন না। আর নতুন সরকারও তাদের পরিকল্পনা বানচালের জন্য কাজ করছে।
সাক্ষাৎকারে 'ষড়যন্ত্রকারীদের' ঘনিষ্ঠজনরা বলেন, নতুন সুন্নি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের হাজারো লোকের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা হতে পারে।
ব্যর্থ বিদ্রোহ
গত মার্চে আলাওয়াইত সম্প্রদায় অধ্যুষিত একটি শহরে 'ব্যর্থ বিদ্রোহে' সরকার-সংশ্লিষ্ট বাহিনীর হাতে প্রায় দেড় হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়।
হাসান ও মাখলুফ দুজনই মার্চ থেকে সিরীয় আলাওয়াইতদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন।
গত ২৫ নভেম্বর হোমস ও উপকূলীয় শহরে নতুন সরকারের প্রতি বিক্ষোভ দেখিয়ে আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারা স্বায়ত্তশাসন, বন্দিদের মুক্তি ও অপহৃত নারীদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানায়।
আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় এটাই ছিল প্রথম বিক্ষোভ। তবে, মাখলুফ বা হাসান কেউই এর পেছনে ছিলেন না। বরং এক ধর্মযাজক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বিক্ষোভের পরদিন মাখলুফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই ধর্মযাজককে আক্রমণ করে বলেন, 'এ ধরনের বিক্ষোভ শুধু বিপদ ডেকে আনবে।'
হাসানের এক শীর্ষ সামরিক সমন্বয়কারী রয়টার্সকে বলেন, 'আলাওয়াইতদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপায় যুদ্ধ।'
লেবাননে অবস্থানরত সাবেক এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, 'হয়তো আরও হাজার হাজার লোক মারা যাবে।'
এ বছরের জানুয়ারির একটি নথি অনুযায়ী, আসাদের বাহিনী ৫ হাজার ৭৮০ জন যোদ্ধার একটি আধাসামরিক বাহিনী তৈরির প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিল এবং ভূগর্ভস্থ কমান্ড-রুম থেকে তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছিল। এসব রুমে অস্ত্র, ইন্টারনেট, জিপিএস ইউনিট, ওয়াকি-টকি ছিল।
ওই পরিকল্পনা কাজে আসেনি। সিরিয়ার উপকূলে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই কমান্ড-রুমগুলো প্রায় অকেজো বলে রয়টার্সের পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুজনও এটা নিশ্চিত করেছেন।
একটি ছবিতে একে-৪৭ রাইফেল, কিছু গোলাবারুদ ও হ্যান্ডগ্রেনেড দেখা গেছে। ওই কক্ষে তিনটি ডেস্কটপ কম্পিউটার, দুটি ট্যাব, এক সেট ওয়াকি-টকি ও একটি পাওয়ার ব্যাংক ছিল। কক্ষের মাঝে একটি কাঠের টেবিল ছিল যার ওপর ছিল একটি বড় মানচিত্র।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আসাদের ঊর্ধ্বতন সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তারা পালিয়ে যাওয়ার পর মধ্যম মানের অনেক কমান্ডার সিরিয়ায় থেকে যান। তাদের বেশিরভাগ আলাওয়াইত অধ্যুষিত উপকূলীয় অঞ্চলে আশ্রয় নেন।
এক অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডারের মতে, পালিয়ে থাকা এই কর্মকর্তারা যোদ্ধাদের নিয়োগ দিতে শুরু করেন।
'এই সম্প্রদায়ের হাজারো যুবক সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পেয়েছিল। ডিসেম্বরে আসাদের পতনের পর হঠাৎ তারা অসহায় হয়ে পড়ে,' বলেন ওই অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডার।
এরপর ৬ মার্চ ব্যর্থ বিদ্রোহ শুরু হলে ৯ মার্চ মাখলুফ নিজেকে 'দ্য কোস্ট বয়' হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'আলাওয়াইতদের সাহায্য করার জন্য আমাকে "ঐশ্বরিক" দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি ফিরে এসেছি। প্রত্যাবর্তন শুভ হোক।'
তবে, সে সময় তিনি যে মস্কোতে অবস্থান করছিলেন, বিবৃতিতে তা উল্লেখ করা হয়নি।
আর্থিক লেনদেন
দুই দশকের বেশি সময় ধরে সিরিয়ার অর্থনীতিতে আধিপত্য ছিল মাখলুফের। ব্রিটিশ সরকারের ধারণা অনুযায়ী, মাখলুফের টেলিকম, নির্মাণ ও পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ ছিল।
২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সিরিয়ান সেনা ও মিত্র মিলিশিয়াদের অর্থের জোগানদাতা ছিলেন।
২০১৯ সালে আসাদের বিজয় নিশ্চিত হয়ে গেলে মাখলুফ প্রকাশ্যে কৃতিত্ব দাবি করেন। এরপর মাখলুফের ব্যবসা দখল করে তাকে গৃহবন্দি করেন আসাদ।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর আসাদের পতন হলে মাখলুফ একটি অ্যাম্বুলেন্সে লেবানন পালিয়ে যান। মাখলুফের ভাই এহাব পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সীমান্তের কাছে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার সঙ্গে থাকা লাখো ডলার লুট করা হয়।
তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ এবং এক কাস্টমস অফিসারের মাধ্যমে এ তথ্য জানলেও রয়টার্স সেই রাতের ঘটনা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।
ঘনিষ্ঠদের মতে, মাখলুফ এখন মস্কোর একটি বিলাসবহুল হোটেলে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে অবস্থান করছেন।
মাখলুফের ফেসবুক পোস্ট এবং সহযোগীদের কাছে পাঠানো হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা অনুযায়ী, তিনি বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর তাকে 'অর্থ ও প্রভাব' দিয়েছেন, যেন তিনি দামেস্কে যুদ্ধের সময় 'আধ্ম্যাতিক নেতার' ভূমিকা পালন করতে পারেন।
তার মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এর শুরু হবে।
রয়টার্সের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আরব আমিরাত ও রাশিয়ার ব্যবসায়িক প্রশাসকদের মাধ্যমে আলাওয়াইত কর্মকর্তাদের বেতন দেওয়াসহ অন্যন্য আর্থিক লেনদেন করেন মাখলুফ।
নথিতে দেখা যায়, মস্কোতে মাখলুফের সঙ্গে দেখা করেছেন সিরিয়ার সাবেক মেজর জেনারেল সুহাইল হাসান ও কাহতান খলিল।
হাসান ও খলিলের দাবি, তারা মাখলুফের জন্য একটি বাহিনী তৈরি করেছেন। বাহিনীর মোট সদস্য ৫৪ হাজার ৫৩ জন, যার মধ্যে ১৮ হাজার অফিসার। হোমস, হামা, টারতুস ও লাটাকিয়া শহর এবং এর আশেপাশে ৮০টি ব্যাটালিয়ন এবং দলে সংগঠিত হয়েছে এই যোদ্ধারা।
হাসান ও খলিল অবশ্য অর্থ লেনদেনের বিষয়ে রয়টার্সের প্রশ্নের উত্তর দেননি।
মাখলুফের একজন আর্থিক ব্যবস্থাপক রয়টার্সকে বলেছেন, মাখলুফ যোদ্ধাদের বেতনের জন্য অন্তত ৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন।
বেতন তালিকা ও রসিদের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে তিনি ৯ লাখ ৭৬ হাজার ৭০৫ ডলার ব্যয় করেছেন এবং ৫ হাজার যোদ্ধার একটি দল আগস্টে দেড় লাখ ডলার পেয়েছে।
অন্যদিকে, সামরিক বন্দি ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন আসাদ সরকারের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান হাসান।
২০২৪ সালের জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্দিদের পরিবার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করা হতো।
চলতি বছর রয়টার্সের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাসান ২০১৮ সালে আসাদ সরকারের নৃশংসতা লুকাতে দামেস্কের বাইরে ধুমাইর মরুভূমিতে গণকবর স্থানান্তরের প্রস্তাব করেছিলেন।
আসাদের সেনাবাহিনী ভেঙে পড়লে হাসান প্রথমে দামেস্কে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দূতাবাসে আশ্রয় নেন। এরপর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য রুশ দূতাবাসে আশ্রয় নেন।
সম্প্রতি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা এক কর্মকর্তার ভাষ্য, হাসান বর্তমানে মস্কোর শহরতলিতে একটি তিনতলা ভিলায় বসবাস করেন। এরপর থেকে তিনি একবার মাহের আল-আসাদের সঙ্গে দেখা করেছেন।
লেবাননে হাসানের কার্যক্রমের সমন্বয়কের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাসান গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত সিরিয়া ও লেবাননে ১২ হাজার যোদ্ধার জন্য দেড় মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন।
এপ্রিলে কমান্ডারদের উদ্দেশে একটি হোয়াটসঅ্যাপ ভয়েস বার্তায় তিনি বলেন, 'ধৈর্য ধরো আমার লোকেরা। অস্ত্র জমা দিও না। আমিই তোমাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করব।'
এ বছরের মাঝামাঝি দাতব্য সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত 'ডেভেলপমেন্ট অব ওয়েস্টার্ন সিরিয়া' ঘোষণা দেয়, তাদের অর্থায়ন করছে 'সিরীয় নাগরিক মেজর জেনারেল কামাল হাসান'।
হাসানের পরিচিত তিনজন কর্মকর্তা ও ওই সংস্থার এক ব্যবস্থাপক এটিকে একটি মানবিক 'ছদ্মাবরণ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যার মাধ্যমে আলাওয়াইতদের মধ্যে প্রভাব তৈরি করতে পারেন হাসান।
বিদ্রোহ মোকাবিলা
মার্চের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে 'সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র' ঠেকাতে সিরিয়া সরকার একজনের ওপর নির্ভর করেছে। তিনি বাশার আল আসাদের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ খালেদ আল-আহমাদ, যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট শারারও ছোটবেলার বন্ধু।
আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের আহমাদ বিশ্বাস করতেন, গৃহযুদ্ধে আসাদের জয়ের নেপথ্যে তিনিই ছিলেন। কিন্তু, তার সঙ্গেও মাখলুফের মতো আচরণ করেছিলেন আসাদ। তার সব সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।
পরে তিনি সাইপ্রাসে পালিয়ে যান। এক পর্যায়ে ২০২১ সালে তিনি পুরোনো বন্ধু শারার সঙ্গে দেখা করতে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ইদলিব যান বলে সংশ্লিষ্ট তিনজন রয়টার্সকে জানিয়েছেন।
তারা আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পরিকল্পনা করেন।
রয়টার্স ২০২৪ সালের শেষ দিকে আল-আহমাদের হোয়াটসঅ্যাপের ভয়েস বার্তা পর্যালোচনা করে দেখেছে, তিনি সামরিক কর্মকর্তাদের বলেন যে পরাজিত স্বৈরশাসকের সঙ্গে থাকা নিরর্থক। কর্মকর্তারা আসাদের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে যদি হত্যা বন্ধ করে, তবে তাদের ক্ষমার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
রয়টার্সকে দেওয়া এক বিবৃতিতে আল-আহমাদ বলেন, ডিসেম্বরে আসাদ সরকার পতনের সময় তার লক্ষ্য ছিল রক্তপাত বন্ধ করা।
টারতুস গভর্নর আল-শামি বলেন, 'আলাওয়াইত সম্প্রদায় এবং নতুন সরকারের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে আহমাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।'
আহমাদের অন্তত ৪ সহযোগী বলেছেন, তিনি কর্মসংস্থান তৈরি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন যে আসাদের পতনের পর সৃষ্ট বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
অক্টোবরের শেষদিকে সিরিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উপকূল থেকে মাখলুফ ও হাসানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে বলে জানান আল-শামি।
এর মধ্যে ওই উপকূলে ভূগর্ভস্থ অস্ত্রের মজুতে ধুলো জমছে বলে জানিয়েছেন এক ফিল্ড কমান্ডার। তার ভাষ্য, তারা প্রস্তুত আছেন। কিন্তু মাখলুফ ও হাসানের মধ্যে কাউকে তিনি যোগ্য মনে করেন না।