রোগী ভর্তি বন্ধ রংপুরের একমাত্র বক্ষব্যাধি হাসপাতালে

এস দিলীপ রায়
এস দিলীপ রায়
25 November 2025, 07:11 AM
UPDATED 25 November 2025, 13:38 PM

রংপুর বিভাগের একমাত্র ২০ শয্যার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে খাবার সরবরাহ বন্ধ করায় গত জুন থেকে রোগী ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ আছে। তবে বক্ষব্যাধির রোগীরা হাসপাতাল চত্বরে পরিচালিত বক্ষব্যাধি ক্লিনিক থেকে আউটডোর চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। 

চিকিৎসকরা বলছেন, যক্ষ্মায় জটিলভাবে আক্রান্ত অনেক রোগীর ইনডোর চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু রোগী ভর্তি বন্ধ থাকায় তারা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

রংপুর নগরের তাজহাট এলাকায় ১৯৬৫ সালে স্থাপিত বক্ষব্যাধি হাসপাতালটি একতলা ভবনের ছয়টি কক্ষ নিয়ে গঠিত। এখানে আলাদা একটি নারী ও দুটি পুরুষ ওয়ার্ড রয়েছে। নারী রোগীদের জন্য চারটি এবং পুরুষ রোগীদের জন্য ১৬টি শয্যা রয়েছে। আর বাকি তিনটি কক্ষ ব্যবহৃত হয় চিকিৎসক ও কর্মচারীদের বসার ঘর এবং অফিস কার্যক্রমে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, বর্তমানে হাসপাতালে দুজন মেডিকেল অফিসার, পাঁচজন নার্স, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন ওয়ার্ডবয় ও একজন মশালচি রয়েছেন। আধুনিক এক্স-রে মেশিন, জিন এক্সপার্ট মেশিন ও মাইক্রোস্কোপ থাকলেও এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে রোগ নির্ণয়ের পর চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া যায় না।

নগরের আমবাড়ি এলাকার আব্দুল কুদ্দুস (৬৫) ও তার স্ত্রী রওশন আরা বেগম (৬০) দুজনই যক্ষ্মায় আক্রান্ত। জটিল অবস্থায় থাকা এই দম্পতি চিকিৎসার আশায় রবিবার হাসপাতালে এলেও ভর্তি হতে না পারায় হতাশ হন। পরে তারা আউটডোর ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওষুধ নেন।

আব্দুল কুদ্দুস বলেন, 'আমি দিনমজুর মানুষ। এখন ঠিকমতো কাজও করতে পারি না। উপার্জন নেই। অনাহারে-অর্ধাহারে চলতে হয়। ডাক্তার বলেছেন পুষ্টিকর খাবার খেতে। কিন্তু সামর্থ্য কোথায়? হাসপাতালে ভর্তি হলে ভালো চিকিৎসা পেতাম, কিন্তু এখন তো ভর্তিই হতে পারছি না।'

রওশন আরা বলেন, 'যক্ষ্মা নিয়ে খুব কষ্টে আছি। ক্লিনিক থেকে ওষুধ পেলাম, কিন্তু পুষ্টিকর খাবার পাব কোথায়? ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেব—এই আশা নিয়েই এসেছিলাম।'

চানমারী এলাকার নুরনবী মিয়াও (৬০) ভর্তি হতে না পেরে হতাশ। তিনি বলেন, 'শুনেছিলাম হাসপাতালে ভর্তি হলে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়। কিন্তু এসে শুনলাম ভর্তি বন্ধ। বাধ্য হয়ে ক্লিনিক থেকে ওষুধ নিলাম।'

হাসপাতাল ও ক্লিনিক সূত্র জানায়, গত ছয় মাসে রংপুর জেলায় বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে এক হাজার ৬২১ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৮২৮ জনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যক্ষ্মা পাওয়া যায়। নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা।

বর্তমানে ৬৬ জন রোগীর অবস্থা জটিল। একজন রোগী এমডিআর (মাল্টিপল ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট) টিবিতে আক্রান্ত—যার চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত ইনডোর সেবা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু ভর্তি না হওয়ায় তারা সবাই বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সিনিয়র স্টাফ নার্স শামছুল আলম জানান, 'হাসপাতালে কোন রোগী নেই। তাই আমাদের কাজও নেই। আমরা এখন অলস সময় পার করছি। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যে রোগীরা চিকিৎসা নিতেন, তারা সবাই প্রান্তিক মানুষ। পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। হাসপাতালে থেকে তারা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরতেন।'

হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার মাহমুদুল হাসান বলেন, 'শুধু ওষুধ সেবন করলে হবে না পুষ্টিকর খাবারও খেতে হবে নিয়মিত। তাহলেই যক্ষ্মা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু প্রান্তিক মানুষজনের পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। হাসপাতালে ভর্তি হলে তারা পুষ্টিকর খাবার পান। কিন্তু খাবার সরবরাহ বন্ধ করায় আমরা কোনো রোগী ভর্তি নিচ্ছি না।'

তিনি বলেন, 'যক্ষ্মা আক্রান্ত অনেক প্রান্তিক মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হতে আসেন। আগে হাসপাতালে সবসময়ই ছয়-সাতজন রোগী ভর্তি থাকতেন। এখনো চাহিদা রয়েছে।'

তিনি জানান, আউটডোর ক্লিনিক থেকে রোগীদের নিয়মিত সেবা দেওয়া হচ্ছে এবং জাতীয় টিবি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) আওতায় বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।

রংপুরের সিভিল সার্জন শাহীন সুলতানা বলেন, 'হাসপাতালে রোগী ভর্তি না হওয়ায় খাবার সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে। যক্ষ্মা রোগীরা এখন বাড়িতে চিকিৎসা নিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। তবে ভর্তি চিকিৎসার চাহিদা দেখা দিলে পুনরায় খাবার সরবরাহ চালু করা হবে।'