ইসরায়েল ১২০০, ফিলিস্তিন ৬৭০০০

মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
7 October 2025, 09:13 AM
UPDATED 7 October 2025, 16:59 PM

গাজায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘাত যদি একটি ক্রীড়া হতো, তাহলে স্কোরকার্ডটি এই লেখার শিরোনামের মতই দেখাত। আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে, 'দুর্ভেদ্য' ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে একদল হামাস যোদ্ধা। ইসরায়েলের ভাষায়, এই 'অসভ্য ও বর্বর', 'পশুসম' বাহিনীর হাতে নিহত হন এক হাজার ২০০ মানুষ। সেখান থেকেই শুরু 'গাজা যুদ্ধ'।

প্রতিশোধের নেশায় মত্ত ইসরায়েলিদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে এক ভয়াবহতম আগ্রাসন শুরু করেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। পরের দুই বছরে ইসরায়েলি সেনাদের নিরবচ্ছিন্ন, নির্মম ও নির্দয় হামলায় একে একে ঝরেছে ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণ। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। আহতের সংখ্যা এক লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি। অনেকে চিরতরে পঙ্গু।

সন্ত্রাসী সন্দেহে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর এ ধরনের নির্বিচার হামলার নজির আধুনিক বিশ্বে নেই বললেই চলে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইসরায়েল দাবি করে, 'প্রতি তিন নিহত ফিলিস্তিনির মধ্যে দুই জনই হামাস সদস্য।'

BYD
হামাস সদস্যদের কড়া প্রহরায় মরদেহ হস্তান্তর শেষ হয়। ছবি: এএফপি

তবে এই 'তত্ত্বের' পক্ষে বাস্তবসম্মত প্রমাণ দেয়নি দেশটি।

এই যুদ্ধে দুই দফায়, অল্প কয়েকদিনের বিরতি এসেছিল। কিন্তু, টেকসই যুদ্ধবিরতি বা শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিটি উদ্যোগ দুই পক্ষের অনমনীয় অবস্থানের কারণে ভেস্তে গেছে।

তবে সেই ঘোষণা আসার আগে গত দুই বছরের এই যুদ্ধের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ফিরে দেখা যাক।

এসব তথ্য আল জাজিরা, রয়টার্স, এএফপি ও বিবিসিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে নেওয়া।

যেভাবে সংঘাতের শুরু

দুই বছর আগে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস অতর্কিত হামলা চালায়। তাদের সঙ্গী হয় সমমনা কয়েকটি সংগঠন।

'আল-আকসার বন্যা' অভিযানের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে। সে সময় ইসরায়েলের অত্যাধুনিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কিব্বুৎজ নামে পরিচিত ইসরায়েলিদের গ্রামসদৃশ থাকার জায়গা ও নোভা মিউজিক ফেস্টিভ্যালে হামলা চালায় হামাসের যোদ্ধারা।

strike_on_israel.jpg
ইসরায়েলের আয়রন ডোম হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করছে। ফাইল ছবি: রয়টার্স

পাশাপাশি, ইসরায়েলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যস্ত রাখতে তিন থেকে পাঁচ হাজার রকেট নিক্ষেপ করে হামাস।

এসব হামলায় সব মিলিয়ে প্রায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, নিহতদের ৮১৫ জন বেসামরিক ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ৩৬ শিশুও আছে।

সেসময় হামাসের হাতে জিম্মি হন ২৫১ জন।

সেদিনই হামাসকে নির্মূলের ঘোষণা দেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। দ্রুততম সময়ে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা যোগাড় করা হয় এবং গাজায় বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।

গাজা অবরোধ ও বিমান হামলা

সারাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে গাজাকে ৮ থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে ফেলে ইসরায়েল। বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি সরবরাহ আংশিক বা একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১২০ মেগাওয়াট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে ২০ মেগাওয়াটে নেমে আসে।

ইসরায়েল 'জবাব' দিতে শুরু করার পর প্রথম ২০ দিনে বিমান হামলায় অন্তত সাত হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হন।

আইডিএফ উত্তর গাজার ১১ লাখ বাসিন্দাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। জাতিসংঘ এই সময়সীমাকে অবাস্তব বলে আখ্যা দেয়।

ইসরায়েলের বেঁধে দেওয়া 'নিরাপদ' করিডর দিয়ে যাওয়ার সময় ইসরায়েলের হামলায় ৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হন।

আল-আহলি হাসপাতালে হামলা

সেই বছর ১৭ অক্টোবর গাজা সিটির আল-আহলি আরব হাসপাতালে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪৭১ জন নিহত ও আরও অন্তত ৩৪২ জন আহত হন। ইসরায়েল এই হামলার দায় অস্বীকার করে। তাদের দাবি ছিল, ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে হাসপাতালে আঘাত হানে।

1CdHn8EeF4RYF_76wjiUPIpdZgBEoNAKPjCsnrktMhk.jpg
ইসরায়েলের আল-আহলি হাসপাতালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। ছবি: এএফপি

আইডিএফের স্থল অভিযান

২৭ অক্টোবর থেকে গাজায় স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। এক লাখ সেনা উত্তর গাজায় ঢুকে পড়ে। তাদের লক্ষ্য ছিল হামাসের অবকাঠামো। এ সময় আল-কুদস হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। সেখানে ১৪ হাজার বেসামরিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন।

জাবালিয়া আশ্রয় শিবিরে বোমা হামলা

৩১ অক্টোবর জাবালিয়া আশ্রয় শিবিরে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। বিমান হামলায় অন্তত দুইটি দুই হাজার পাউন্ডের বিধ্বংসী জেডিএএম বোমা ব্যবহার হয়। গাজার সবচেয়ে বড় আশ্রয় শিবির জাবালিয়ার একটি আবাসিক ব্লক লক্ষ্য করে হামলা চালায় ইসরায়েল। ওই হামলায় বেশ কয়েকটি ভবন মাটিতে মিশে যায়।

হামলায় ৬৮ শিশুসহ ১২৬ জন নিহত হন। আহত হন ২৮০ জন।

Israeli Airstrike
ইসরায়েলি বিমান হামলায় বিধ্বস্ত গাজা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলের দাবি, সেখানে হামাসের কমান্ডার ইব্রাহিম বিয়ারি লুকিয়ে ছিলেন। আল আকসা ফ্লাড অভিযানের পরিকল্পনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে হামাস তা প্রত্যাখ্যান করে জানায়, জাবালিয়ায় বিয়ারি ছিলেন না—তাকে হত্যার প্রশ্নই ওঠে না।

পরবর্তীতে বিয়ারির গতিবিধি সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি, যা ইসরায়েলের দাবির সত্যতা কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠা করে।

আল-শিফা হাসপাতালে অভিযান

নভেম্বরের ১৫ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে আইডিএফ গাজার সবচেয়ে বড় চিকিৎসাকেন্দ্র আল-শিফা হাসপাতালে অভিযান চালায়। তাদের অভিযোগ, ওই হাসপাতালটি হামাসের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়। হাসপাতালের নিচে সুড়ঙ্গ, অস্ত্র ও জঙ্গিদের লুকিয়ে থাকার দাবি জানায় তারা।

২৬ নভেম্বর অভিযান শেষ করে ইসরায়েলি বাহিনী সেখান থেকে চলে যায়। অভিযান চলার সময় হাসপাতালের ভেতর চিকিৎসাধীন হাজারো অসুস্থ ও মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজতে আসা বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা চরম দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যান।

অভিযান চলাকালে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকায় বেশ কয়েকজন রোগী মারা যান বলে সংবাদমাধ্যমগুলো উল্লেখ করে।

deir_al_balah_ramadan_0.jpg
দেইর আল বালাহ এলাকায় ধ্বংসস্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে ইফতার করছে এক ফিলিস্তিনি পরিবার। ফাইল ছবি: এএফপি

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আইডিএফের এই অভিযানের তীব্র সমালোচনা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন বলে আখ্যা দেয়। ওই আইনে যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও চিকিৎসাকেন্দ্র সুরক্ষিত থাকার কথা বলা আছে।

পাশাপাশি, অভিযান শেষে হাসপাতালে 'হামাসের কার্যক্রমের' অস্তিত্ব নিয়ে যেসব তথ্যপ্রমাণ ইসরায়েল উপস্থাপন করে (অস্ত্র ও ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ পথের ভিডিও), তা 'বিশ্বাসযোগ্য নয়' এবং 'অপর্যাপ্ত' বলে মন্তব্য করে দ্য গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোস্টের মতো গণমাধ্যম।

আল-শিফা হাসপাতালকে হামাসের আঁতুড় ঘর বলে প্রচারণা চালিয়েছিল ইসরায়েল। কিন্তু দুই সপ্তাহের অভিযান শেষে এই দাবির পক্ষে গ্রহণযোগ্য যুক্তিপ্রমাণ দিতে পারেনি দেশটি।

প্রথম যুদ্ধবিরতি

মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ কাতারের মধ্যস্থতায় ২৪ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দেয় হামাস-ইসরায়েল। চুক্তি অনুসারে হামাসের হাতে বন্দি থাকা ১০৫ জিম্মি মুক্তি পান। এর বদলে ইসরায়েলের কারাগারে আটক ২৪০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হয়।

Netanyahu
তেল আবিবে নেতানিয়াহুর মাস্ক পরে বিক্ষোভ করছেন এক ইসরায়েলি। ছবি: এএফপি

মিসরে পরোক্ষ বৈঠকের পর দুই পক্ষ এতে সায় দিয়েছিল। চুক্তির শর্ত ছিল সাত দিন যুদ্ধ বন্ধ থাকবে যাতে গাজায় মানবিক ত্রাণের প্রবাহ বাড়ানো যায়। পরবর্তীতে অল্প কয়েকদিনের জন্য চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব হলেও জিম্মি-বন্দি মুক্তিতে অনিয়ম ও অন্যান্য শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে উভয় পক্ষ। ফলে চুক্তি ভেস্তে যায় এবং আবারও যুদ্ধ শুরু হয়।

ইসরায়েলি সেনাদের দুর্যোগের দিন

২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারিকে ইসরায়েলি সেনাদের 'দুঃস্বপ্ন' দিবস বলা যেতে পারে। গাজার যুদ্ধে সেদিনই এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছিলেন। ফিলিস্তিনি আরপিজির আঘাতে একটি ভবন ধসে পড়লে সেখানে ২১ ইসরায়েলি সেনা নিহত হন।

ময়দা হত্যাকাণ্ড

২৯ ফেব্রুয়ারি গাজা সিটিতে ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর হামলা চালায় ইসরায়েলি সেনা। এতে ১১২ জন নিহত ও ৭৫০ জন আহত হন।

গাজার হারুন আল-রশিদ সড়কে ট্রাকে করে নিয়ে আসা ময়দার বস্তা সংগ্রহ করতে ফিলিস্তিনিরা জমায়েত হয়েছিলেন। কয়েকজন ক্ষুধার্ত গাজাবাসী লাইন ভেঙে ট্রাক থেকে সরাসরি ময়দা ও ক্যানজাত খাবার নিতে গেলে তাদের ওপর গুলি চালায় ইসরায়েলি সেনারা।

rafah_food.jpg
রাফায় ফিলিস্তিনিরা খাবার সংগ্রহ করছেন। ফাইল ছবি: এএফপি

আল জাজিরার সাংবাদিক ইসমাইল আল-ঘৌল ঘটনাস্থল থেকে জানান, 'গুলি শুরুর পর ইসরায়েলি ট্যাংক এগিয়ে আসে। রাস্তায় পড়ে থাকা অসংখ্য আহত মানুষ ও নিহতদের মরদেহের ওপর দিয়ে সেগুলোকে চলে যেতে দেখি।'

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এই মর্মান্তিক ঘটনার নাম দেয় 'ময়দা হত্যাকাণ্ড'।

ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনে হামলা

২০২৪ সালের ১ এপ্রিল ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন দাতব্য প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের সাত কর্মী। গাজাবাসীদের বিনামূল্যে রান্না করা খাবার খাওয়ার মহৎ উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিল প্রতিষ্ঠানটি। ওই হামলার পর গাজায় কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় প্রতিষ্ঠানটি।

আলোচিত রাফা অভিযান

২০২৪ সালের মে মাসে মিশর-গাজা সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর রাফা দখল করে ইসরায়েল। পূর্ব রাফা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আইডিএফ স্থল অভিযান শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় ছয় লাখ ফিলিস্তিনি বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।

এ সময় হামাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির সব শর্ত মেনে নিলেও ইসরায়েল তা প্রত্যাখ্যান করে।

নুসেইরাত শিবিরে উদ্ধার অভিযান

২০২৪ সালের ৮ জুন গাজার নুসেইরাত আশ্রয় শিবিরে জিম্মি উদ্ধারের এক দুর্ধর্ষ অভিযান চালায় ইসরায়েল। যদিও শিবিরে মূলত বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা অবস্থান করছিলেন, তবুও এই অভিযানে চার জিম্মিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় আইডিএফ। উদ্ধারকৃতরা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর অপহরণের শিকার হয়েছিলেন।

ওই অভিযানের জন্য ফিলিস্তিনিদের বড় মূল্য চুকাতে হয়—আইডিএফের গুলিতে অন্তত ২৭৪ জন নিহত ও প্রায় ৭০০ জন আহত হন।

hopeless_in_gaza.jpg
গাজায় নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

অভিযানের নিন্দা জানান জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জোসেপ বোরেল একে সম্ভাব্য 'যুদ্ধাপরাধের' আখ্যা দেন।

অভিযানের যৌক্তিকতা ও যুদ্ধাপরাধের তদন্তের দাবি এলেও এ বিষয়ে নতুন তথ্য জানা যায়নি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা

১০ আগস্ট গাজার আল-তাবাঈন স্কুলে হামলা চালায় ইসরায়েল। স্কুলটি সে সময় গাজাবাসীদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল।

ওই হামলায় ৮০ বেসামরিক মানুষ নিহত হন।

ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা

২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর গাজায় হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হন। তিনি ওই বছরের আগস্ট থেকে হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। রাফার তেল আল-সুলতান এলাকায় ইসরায়েলি হামলায় তিনি নিহত হন।

৭ অক্টোবরের হামলার 'মূল পরিকল্পনাকারী' হিসেবে পরিচিত সিনওয়ার ছিলেন ইসরায়েলের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকার শীর্ষে। তার বিরুদ্ধে চার লাখ ডলারের পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। তার মৃত্যুতে হামাসের নেতৃবৃন্দ বড় সংকটে পড়ে।

ত্রাণ ও চিকিৎসা অবকাঠামোর ওপর হামলা

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে উত্তর গাজায় সামরিক অভিযানের তীব্রতা বাড়ায় ইসরায়েল। বিশেষ করে, বেইত লাহিয়া ও জাবালিয়া এলাকায়। এ সময় বারবার চিকিৎসাকেন্দ্র ও ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে হামলা চালায় দেশটি।

ডিসেম্বরের শুরুতে গাজার ৩৬ হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৭টি আংশিকভাবে চালু ছিল। ২০২৩ এর অক্টোবরের পর থেকে ওই মাস পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি চিকিৎসাকর্মী নিহত হন।

gaza_devastation.jpg
গাজার ধ্বংসযজ্ঞ আধুনিক ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

২৩ ডিসেম্বর ত্রাণকর্মী বহনকারী গাড়িবহরে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ১৩ জন নিহত হন।

এ ছাড়া, মাসজুড়ে একাধিক হামলায় কামাল আদওয়ান হাসপাতালে পাঁচ চিকিৎসাকর্মীসহ মোট ৫০ জন নিহত হন।

দ্বিতীয় যুদ্ধবিরতি

গত জানুয়ারিতে কাতারের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে সম্মতি দেয় ইসরায়েল-হামাস। ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিরতির মধ্যে হামাস ৩০ জিম্মি ও অপর আট জিম্মির মরদেহ হস্তান্তর করে। বিপরীতে প্রায় এক হাজার ৯০০ ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পান।

সেসময় হাজারো মানুষ উত্তর গাজায় ফিরে আসেন।

দুই পক্ষের চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়।

নতুন করে হামলা

ওই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল প্রথম ধাপের ৩০ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা ও গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু, এ বিষয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি। নানা টালবাহানায় আলোচনা পেছাতে থাকে ইসরায়েল। ফলে, ১৮ মার্চে যুদ্ধবিরতির এক মাস শেষ হলেও দুই পক্ষের নতুন চুক্তি হয়নি।

সেদিনই কোনও ধরনের পূর্ব-ঘোষণা না দিয়ে নতুন উদ্যমে গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

রমজান মাসে পরিচালিত ওই 'অপ্রত্যাশিত' হামলায় ৪০০ জনেরও বেশি নিহত হন। হামাসের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা নিহত হন। বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। হামাস এই হামলাকে 'বিশ্বাসঘাতকতা' বলে অভিহিত করে।

গাজার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ইসরায়েল। নতুন করে নেতজারিম করিডরের দখল নেয় আইডিএফ।

আইডিএফ জাতিসংঘ ভবনে বিমান হামলা চালালে সাত ত্রাণকর্মী নিহত হন।

মানবিক ত্রাণ সংকট

জাতিসংঘসহ সব ধরনের সংস্থাকে ইসরায়েলে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় ইসরায়েল। ২৬ মে থেকে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট গাজা হিউম্যানিট্যারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) গাজাবাসীদের ত্রাণ দেওয়ার দায়িত্ব নেয়।

কিন্তু, শুরু থেকেই এই উদ্যোগে ঝামেলা দেখা দেয়। ত্রাণ নিতে আসা গাজাবাসীদের ওপর আইডিএফের সেনা হামলা চালালে এক হাজার ৩০০ জন নিহত হন।

পরবর্তীতে বিচ্ছিন্নভাবে প্রায় প্রতিদিনই ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের হতাহত করতে থাকে আইডিএফ।

গণমাধ্যম কর্মী হত্যা

আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে সংবাদকর্মীদের জন্য নির্ধারিত তাঁবুর ওপর বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে আল-জাজিরার ছয় সাংবাদিক নিহত হন।

গাজার যুদ্ধে মোট ১৯২ সংবাদকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।

গাজা সিটি অভিযান

সারাবিশ্ব যখন গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে, সে সময় 'শান্তি প্রতিষ্ঠার' উদ্যোগ হিসেবে গাজার সবচেয়ে জনবহুল বসতি, গাজা সিটিতে সামরিক অভিযানের উদ্যোগ নেন নেতানিয়াহু।

৬০ হাজার রিজার্ভ সেনা গাজার বিভিন্ন এলাকা দখল করে নেয়। এ সময় নাসের হাসপাতালে পাঁচ সাংবাদিকসহ ২২ জন নিহত হন।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা

গত ৩০ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে খাবার, ওষুধ ও অন্যান্য জরুরি উপকরণ নিয়ে ২০টিরও বেশি নৌযান গাজার দিকে রওনা হয়। উদ্দেশ্য, গাজায় ইসরায়েলের একতরফা অবৈধ অবরোধ উপেক্ষা করে দুর্দশাগ্রস্ত গাজাবাসীদের কাছে ত্রাণ নিয়ে যাওয়া। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নামের এই উদ্যোগে পরবর্তীতে আরও প্রায় ২৫টি নৌযান ইতালি ও তিউনিশিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে যোগ দেয়।

gaza-global-sumud-flotilla.jpeg
ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙতে গাজার দিকে ছুটছে বৈশ্বিক মানবাধিকারকর্মীদের নৌকা। ছবি: তুরস্কের আইনপ্রণেতা জেহরানুর আয়দেমি এক্স থেকে নেওয়া

সুইডিশ মানবাধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের নেতৃত্বে প্রায় ৫০০ রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও সেলিব্রিটি ফ্লোটিলার যাত্রী হন। তাদের নৌকাগুলো গাজায় পৌঁছানোর আগেই ইসরায়েলি নৌবাহিনী জাহাজগুলোকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাধা দেয়। আটক হন সব যাত্রী। তাদের মহৎ উদ্দেশ্য সফল না হলেও গোটা বিশ্ব গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পায়। দেশে দেশে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব বেড়ে যায়।

ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা

গত ২৯ সেপ্টেম্বর গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ২০ দফা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটি ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই মেনে নেয়। এরপর, গত ৪ অক্টোবর থেকে হামলার মাত্রা কমিয়ে আনে ইসরায়েল।

গতকাল ৬ অক্টোবর থেকে মিশরের শার্ম-এল শেখ শহরে ট্রাম্পের ২০ দফা বাস্তবায়নের উদ্দেশে পরোক্ষ আলোচনায় বসেন হামাস ও ইসরায়েলের প্রতিনিধিরা।

Trump and Netanyahu
ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনায় সায় দিয়েছেন নেতানিয়াহু। ফাইল ছবি: রয়টার্স

সবার প্রত্যাশা, এই আলোচনা থেকেই উঠে আসবে যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা।