ইউক্রেনের কতটুকু দখলে নিল রাশিয়া, দেখুন ছবিতে

By স্টার অনলাইন ডেস্ক
2 December 2025, 20:26 PM
UPDATED 3 December 2025, 12:24 PM

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে বৈঠকের আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, 'ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চাই না, কিন্তু ইউরোপ যদি চায় এবং শুরু করে, আমরা এখনই প্রস্তুত।'

রাশিয়া তিন বছরেরও বেশি সময় আগে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু করার পর থেকেই ইউক্রেনে লড়াই চলছে। গত এক বছরে রুশ বাহিনী ধীরে ধীরে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা বাড়িয়েছে—বিশেষত পূর্ব ইউক্রেনে এবং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কিয়েভসহ অন্যান্য শহরে ধারাবাহিক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একটি শান্তি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চালাতে ইউক্রেন ও মার্কিন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন—যা আগে রাশিয়ার পক্ষে সুবিধাজনক বলে দেখা হচ্ছিল। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন আলোচনাগুলো 'গঠনমূলক' ছিল।

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে আলোচনা হওয়ার কথা থাকায় ইউক্রেনের স্থল পরিস্থিতি এখানে তুলে ধরা হলো।

war-2.jpg
ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার ধীরে ধীরে অগ্রসর

পূর্ব ইউক্রেনে রুশ সেনারা লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক, যা মিলিয়ে দনবাস নামে পরিচিত—সেসব অঞ্চলের বিস্তৃত মাঠ পেরিয়ে ধীরে ধীরে গ্রাম ও শহর ঘিরে দখল করছে।

রাশিয়া দনবাসের পাশাপাশি পশ্চিম দিকে থাকা আরও দুটি অঞ্চল—জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন সম্পূর্ণ দখল করতে চাইছে। আক্রমণ শুরুর পরপরই রাশিয়া এই চারটি অঞ্চলকে সংযুক্ত করতে গণভোটের চেষ্টা করেছিল, ঠিক যেমনটি তারা ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রে করেছিল। তবে কখনোই পুরো এলাকায় তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ কর্মকর্তাদের খসড়াকৃত প্রাথমিক শান্তি প্রস্তাব অনুযায়ী—ইউক্রেনকে লুহানস্ক, দোনেৎস্ক ও ক্রিমিয়া সম্পূর্ণভাবে রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে হবে, এছাড়া জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত অংশও মস্কোকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল।

দোনেৎস্কের যেসব অংশ এখনো ইউক্রেনের সেনাদের নিয়ন্ত্রণে আছে সেগুলো ছেড়ে দিতে হবে এবং এই অঞ্চল কার্যত রুশ নিয়ন্ত্রণাধীন এক অসামরিক জোনে পরিণত হবে। রাশিয়ান বাহিনীও ওই চার এলাকার বাইরে যে অল্প কিছু এলাকা দখলে রেখেছে সেখান থেকে সরে আসবে।

জেলেনস্কি বারবার বলেছেন যে শান্তির বিনিময়ে ইউক্রেন দনবাস ছেড়ে দেবে না, কারণ এভাবে ছাড় দিলে রাশিয়া ভবিষ্যৎ আক্রমণের জন্য এটাকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকের পর জেলেনস্কি বলেন, শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে 'সীমান্তের প্রশ্নই সবচেয়ে কঠিন' বিষয়।

war-3.jpg
ছবি: সংগৃহীত

গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোই লক্ষ্য

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের (আইএসডব্লিউ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে পশ্চিম দোনেৎস্ক জুড়ে ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি 'দুর্গ বেষ্টনীর' কথা বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'গত ১১ বছর ধরে ইউক্রেন এই বেষ্টনীকে শক্তিশালী করতে এবং প্রতিরক্ষা শিল্প ও অবকাঠামো গড়ে তুলতে সময়, অর্থ ও শ্রম ব্যয় করেছে।'

গ্রীষ্মকালীন আক্রমণে পোকরোভস্ক শহরের উত্তরে দ্রুত অগ্রসর হয়েছিল রাশিয়া। সম্প্রতি তারা শহরের দক্ষিণ অংশেও এবং কাছের কোস্ত্যান্টিনিভকার পূর্ব দিকেও অগ্রগতি অর্জন করেছে।

রুশ কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, তারা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ক্রাসনোআরমেইস্ক নামে পরিচিত শহরটি দখল করেছেন, যা মস্কোকে আরও উত্তরে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত দোনেৎস্ক অঞ্চলের বড় দুটি শহর ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্কের দিকে এগোনোর সুযোগ দিতে পারে। তবে ইউক্রেন এই দাবি অস্বীকার করেছে।

মঙ্গলবার সকালে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড এক বিবৃতিতে জানায়, 'পোকরোভস্কে যুদ্ধ এখনো চলছে।'

যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষণকারী ওপেন-সোর্স গোয়েন্দা প্রকল্পগুলোর বিশ্লেষণও বলছে যে, পোকরোভস্ক এখনো সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ার দখলে যায়নি।

আইএসডব্লিউর মতে, পুরো অঞ্চল দখল করতে রাশিয়ার 'কয়েক বছর' লেগে যাবে।

তবে তারা আরও উল্লেখ করেছে যে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাশিয়ার হতাহতের হার কমেছে, যদিও অগ্রগতি তুলনামূলক দ্রুত। এর কারণ হিসেবে বাড়তি ড্রোন ব্যবহারের বিষয়টিকে তারা উল্লেখ করেছে।

war-4.jpg
ছবি: সংগৃহীত

খারকিভের উত্তরে রুশ আগ্রাসন

আরও উত্তরের সীমান্ত শহর ভভচানস্ক দখলের দাবিও করেছে রাশিয়া—যদিও ইউক্রেন তা স্বীকার করেনি এবং বিভিন্ন ওপেন-সোর্স বিশ্লেষণ বলছে শহরটি এখনো সম্পূর্ণ পতিত হয়নি।

আইএসডব্লিউর বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া ইউক্রেনের উত্তর সীমান্তের ভেতরে একটি বাফার জোন তৈরি করতে এবং ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভকে আর্টিলারি রেঞ্জের মধ্যে আনতে চাইছে।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, এই বাফার জোন রাশিয়াকে সুরক্ষা দিতে প্রয়োজন, কারণ ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে ইউক্রেনের বাহিনী আরও উত্তরে কুরস্ক অঞ্চলে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পরে উত্তর কোরিয়ার সেনাদের সহায়তায় রাশিয়া সেখানে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

কুরস্ক অঞ্চলে পাল্টা আক্রমণের পাশাপাশি, ইউক্রেন রাশিয়ার গভীর ভেতর পর্যন্ত বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। এমন একটি হামলায় পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম দূরপাল্লার বোমারু বিমানকে লক্ষ্য করে ১০০টি ড্রোন ব্যবহার করা হয়।

রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে যে মুরমানস্ক, ইরকুতস্ক, ইভানোভো, রিয়াজান ও আমুর—এই পাঁচটি অঞ্চলে হামলা হয়েছে। তবে তারা বলেছে, বিমানের ক্ষতি হয়েছে কেবল মুরমানস্ক ও ইরকুতস্কে, অন্য এলাকায় হামলা প্রতিহত করা হয়েছে।

কিয়েভ দাবি করেছে যে, এই ড্রোন হামলায় রুশ সামরিক বাহিনীর ৭ বিলিয়ন ডলার (৫ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ড) ক্ষতি হয়েছে। তবে উভয় পক্ষের দাবিই স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

সম্প্রতি মস্কো কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী শহর সোচির কাছে বিশাল তেল ডিপোতে আগুন লাগার জন্য ইউক্রেনের ড্রোনকে দায়ী করেছে। সোচিতেই বসেছিল ২০১৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের আসর।

war-5.jpg
ছবি: সংগৃহীত

যুদ্ধবিরতি আলোচনা

২০২৫ সালের শুরুতে ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র চতুর্থ বছরে প্রবেশ করা এই যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে আলোচনার পথে এগোচ্ছে।

ট্রাম্পকে তার পূর্বসূরি জো বাইডেনের তুলনায় রাশিয়ার প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল হিসেবে দেখা হতো এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসে সরাসরি সম্প্রচারে ট্রাম্প ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স জেলেনস্কির সঙ্গে তীব্র বাক্যবিনিময় করলে দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রকাশ্যে আসে।

তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জেলেনস্কির সঙ্গে সম্পর্ক অনেকটাই ভালো হয়েছে এবং ইউক্রেন এখনো যুক্তরাষ্ট্রের উন্নতমানের অস্ত্র—বিশেষ করে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ওয়াশিংটন সরবরাহকৃত গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

জেলেনস্কি সতর্ক করেছেন যে, এই শান্তি প্রস্তাবে সম্মতি না দিলে কিয়েভ যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কারণ প্রস্তাব অনুযায়ী ভূখণ্ড ছাড়ার পাশাপাশি ইউক্রেনকে সেনাবাহিনীর আকার উল্লেখযোগ্যভাবে ছোট করতে হবে এবং ন্যাটোতে যোগ না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।

গত সপ্তাহে পুতিন বলেন যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শান্তি খসড়া দেখেছেন এবং এটি ভবিষ্যতে যুদ্ধের অবসানের ভিত্তি হতে পারে।

তবে পরে ক্রেমলিন কর্মকর্তারা বলেন যে, কিয়েভ ও ইউরোপীয় মিত্ররা খসড়ায় পরিবর্তন এনেছে, তাই রাশিয়া এটি গ্রহণ করবে কি না তা এখন অনিশ্চিত।

war-6.jpg
ছবি: সংগৃহীত

তিন বছরের যুদ্ধ

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইউক্রেনজুড়ে অসংখ্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু হয়।

রুশ স্থলবাহিনী দ্রুত অগ্রসর হয়ে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ইউক্রেনের বড় এলাকায় দখল নেয় এবং কিয়েভের উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়।

রাশিয়া খারকিভে গোলাবর্ষণ করছিল, পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে বিশাল এলাকা দখল করেছিল এবং মারিউপোল বন্দর শহরকে ঘিরে ফেলেছিল।

কিন্তু তারা প্রায় সর্বত্রই ইউক্রেনীয়দের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। রুশ সেনাদের মনোবলহীনতা এবং খাদ্য, পানি ও গোলাবারুদ সংকটের কারণে লজিস্টিক সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে।

ইউক্রেনীয় বাহিনী দ্রুত পশ্চিমা সরবরাহকৃত অস্ত্র—যেমন: এনএলএডব্লিউ ট্যাংক-বিধ্বংসী সিস্টেম ব্যবহার শুরু করে, যা রাশিয়ার অগ্রযাত্রা থামাতে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়।

২০২২ সালের অক্টোবরের দিকে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। কিয়েভ দখলে ব্যর্থ হয়ে রাশিয়া সম্পূর্ণভাবে উত্তর ইউক্রেন থেকে সরে যায়। পরের মাসে ইউক্রেন খেরসন শহর পুনরুদ্ধার করে।

এরপর থেকে যুদ্ধ মূলত পূর্ব ইউক্রেনে সীমাবদ্ধ, যেখানে রুশ বাহিনী ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। সামরিক বিশ্লেষকদের অনুমান অনুযায়ী, আক্রমণ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার ১ লাখ ৬৫ হাজার থেকে ২ লাখ ৩৫ হাজার সেনা নিহত হয়েছে।

ইউক্রেন সর্বশেষ হতাহতের সংখ্যা জানায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, সেসময় জেলেনস্কি বলেন, এখন পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সেনা ও অফিসারদের ৪৩ হাজার জন নিহত হয়েছে। তবে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ সংখ্যা বাস্তবের চেয়ে কম।