‘বৃন্দাবন-কুরুক্ষেত্রে’ চিকেন প্যাটিস বিতর্ক

By স্টার অনলাইন ডেস্ক
14 December 2025, 06:09 AM
UPDATED 14 December 2025, 12:51 PM

ঘটনাটি ৭ ডিসেম্বরের। স্থান: ব্রিগেড, কলকাতা। সেদিন সেখানে আয়োজন করা হয়েছিল 'পাঁচ লাখ কণ্ঠে' পবিত্র গীতাপাঠ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রচারিত সংবাদে দেখা গেল, অনেক গীতাভক্ত আনন্দে অভিভূত হয়ে ব্রিগেডকেই 'বৃন্দাবন' আর কলকাতাকে 'কুরুক্ষেত্র' বলে মন্তব্য করলেন।

তবে সেই 'পবিত্র স্থানে' সেদিন সেই 'মহাপবিত্র অনুষ্ঠান' চলাকালে ঘটেছে এক অমানবিক ঘটনা। কলকাতার ব্রিগেডে অনুষ্ঠানস্থলের কাছে কয়েকজন 'গীতাভক্ত' চিকেন প্যাটিস বিক্রি করার কারণে অন্তত চার হকারকে হেনস্থা করেন।

অভিযোগ—চিকেন প্যাটিস বিক্রি করে তারা গীতাপাঠের পবিত্রতা নষ্ট করেছিলেন।

ঘটনার পরপরই সরগরম হয় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। অনেকে বলছেন—গীতাপাঠের আসরে কেন আমিষ নিয়ে ঢুকবে? কেউ কেউ প্যাটিস বিক্রেতার বিরুদ্ধে 'ধর্মনাশের' অভিযোগও তুলেছেন। ঘটনাটিকে 'চক্রান্ত' হিসেবেও দেখছেন অনেকে।

চার হকারের তিনজন মুসলমান হওয়ায় 'ষড়যন্ত্র' তত্ত্বটিকে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরার চেষ্টাও হয়েছে।

অন্যদিকে, ঘটনার নিন্দা করে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন—শ্রীমদ্ভগবদ গীতা কী শিক্ষা দেয়? এটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায়। অধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শিক্ষা দেয়। আর গীতাভক্তরাই কিনা অন্যায়-অধর্মের নজির গড়লেন?

কারো মন্তব্য: ময়দান খোলা জায়গা। সেখানে অনেক মানুষ অনেক রকম পণ্য বিক্রি করেন। চিকেন প্যাটিস বিক্রেতাদের অনায়াসে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া যেত।

কেউ আবার আক্ষেপ করে বলেছেন—মহাত্মা গান্ধী গীতাভক্ত ছিলেন; আবার তার হত্যাকারী নাথুরাম গডসেও গীতাভক্ত ছিলেন। গীতা থেকেই নাকি তিনি গান্ধীজীকে হত্যার প্রেরণা পেয়েছিলেন।

আসলে গীতা থেকে কে যে কী শিক্ষা নেবে তা বলা মুশকিল—বলেও মন্তব্য করেন কেউ কেউ।

অনেকে রসিকতা করে বলেন—বিনা পয়সায় তো চিকেন প্যাটিস খাওয়াচ্ছিল না। অথবা, জোর করে মুখে ঠেসে দিচ্ছিল না, যে 'ধর্মনাশ' হবে। আর পাঁচ লাখ মানুষের ধর্ম নষ্ট করতে মাত্র দুই-তিন মুসলিম হকার ময়দানে গেলেন, এ কেমন 'ষড়যন্ত্র'?

geeta_chanting_in_kolkata.jpg
কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে 'পাঁচ লাখ কণ্ঠে' গীতা পাঠের আসর। ছবি সৌজন্য: দ্য হিন্দু

কী ঘটেছিল?

গত ১০ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—'কলকাতায় গীতাপাঠ অনুষ্ঠান চলাকালে মুসলিম চিকেন প্যাটিস বিক্রেতাকে মারধরের অভিযোগ'।

এতে বলা হয়, গত ৭ ডিসেম্বর সনাতন সংস্কৃতি সংসদের আয়োজনে কলকাতার ব্রিগেড গ্রাউন্ডে গীতাপাঠের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলাকালে চিকেন প্যাটিস বিক্রি করায় বিক্রেতাকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে।

সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চিকেন প্যাটিস বিক্রির কারণে শেখ রিয়াজুলকে মারধর করা হয়, কান ধরে ওঠবস করানো হয় এবং বাক্সে থাকা খাবার মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি চিকেন প্যাটিসের পাশাপাশি ভেজিটেবল প্যাটিসও বিক্রি করেন।

প্রায় তিন হাজার টাকার খাবার বাক্সে ছিল বলে রিয়াজুল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

মহম্মদ সালাউদ্দিন নামে আরেক বিক্রেতাকেও একইভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের বাংলা সংস্করণের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সালাউদ্দিন ও মুনতাজ মালিক অভিযোগ করেন—শুধু নন-ভেজ নয়, পেঁয়াজ মেশানো স্ন্যাকস বিক্রির জন্যও তাদের আক্রমণ করা হয়। মুনতাজের বক্তব্য—'ওরা বলছিল, হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নন-ভেজ বিক্রি করা চলবে না। এমনকি, আমার আধার কার্ড দেখতে চেয়েছিল।'

একইদিনে সংবাদ প্রতিদিনের এক ভিডিও প্রতিবেদনে বলা হয়, সেদিন মুসলিম প্যাটিস বিক্রেতা রিয়াজুলের সঙ্গে হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন হিন্দু প্যাটিস বিক্রেতা শ্যামল মণ্ডলও।

সংবাদমাধ্যমটিকে সেই ভুক্তভোগী জানান, জামার কলার ধরে টানাটানি করা হয়। জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে ধমক দেওয়া হয়।

ধর্মীয় পরিচয় জানতে চাইলে শ্যামল বলেন, 'হিন্দু'। তারা চ্যালেঞ্জ করে বলে, 'না, তুমি হিন্দু না, তুমি মুসলিম আছো'। তার ভাষ্য, 'কিছুতেই বিশ্বাস করছিল না যে আমি হিন্দু। আমি ভয়ে তখন থরথর করে কাঁপতে শুরু করি।'

যারা হকারদের ওপর চড়াও হয়েছিলেন, তারা গীতাপাঠ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বলেও সংবাদ প্রতিবেদনগুলোয় বলা হয়েছে।

'মাঠ কোনো মন্দির নয়'

গীতাপাঠের সেই অনুষ্ঠানটি বিজেপির আয়োজনে না হলেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা।

সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়—অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। আরও ছিলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ও বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার, বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ, তথাগত রায় ও রাহুল সিনহা।

আয়োজক সনাতন সংস্কৃতি সংসদের পক্ষ থেকে হকার হেনস্থার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুসারে, ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সনাতন সংস্কৃতি সংসদ বলেছে—'আমরা কোনো সহিংসতাকে সমর্থন করি না। মাঠ কোনো মন্দির বা আশ্রম নয়। কে কী খাবার বিক্রি করবে যে নিয়ে আমরা কোনো নির্দেশ দিইনি। যারা হামলা করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।'

প্রতিক্রিয়া

হকার হেনস্থার সেই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুখ খুলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ১১ ডিসেম্বর জি ২৪ ঘণ্টার এক প্রতিবেদনের শিরোনামে মমতার কথার বরাত দিয়ে বলা হয়—'এটা বাংলা, এটা ইউপি নয়!' বাংলায় 'গা-জোয়ারি'র রাজনীতি চলবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগ দেন তৃণমূল নেতারাও। গত ১৩ ডিসেম্বর সংবাদ প্রতিদিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, 'আমিষ খাবার যারা খান না, তারা কিনবেন না। কিন্তু, বিক্রেতাকে মারধর করবে কেন? ওরা ওখানে নানা জিনিস বিক্রি করে আয় করেন। এ রকম করা যায় না। তীব্র নিন্দা করছি।'

গত ১১ ডিসেম্বর আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়—গীতাপাঠের দিন প্যাটিস বিক্রেতাদের মারধরের অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভিডিও দেখেই পুলিশ তাদেরকে শনাক্ত করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এতে আরও জানানো হয়, ৯ ডিসেম্বর মহম্মদ সালাউদ্দিন ও শেখ রিয়াজুল নামে ওই দুই প্যাটিস বিক্রেতা ময়দান থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে দুটি এফআইআর রুজু করে পুলিশ।

তবে অভিযুক্তরা দ্রুত জামিন পেয়ে যান। তাদের আইনজীবী বলছেন—'নিরামিষের নামে আমিষ বিক্রি করা হচ্ছে শুনে ক্রেতারা ক্ষুব্ধ হন। সেই উত্তেজনা থেকেই ঝগড়া এবং হাতাহাতি হয়।'

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ এইটিন বাংলাকে রিয়াজুল জানান, তিনি ২২ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। কখনোই এমন ঘটনা ঘটেনি। আইনজীবী ও বাম নেতা সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, 'গো বলয়ের' উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে সংখ্যালঘু মানুষ হত্যার সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

কেউ কেউ বলছেন, আমিষভোজী বাঙালিদের ওপর নিরামিষ 'চাপিয়ে' দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

এখন দেখার বিষয়—'বৃন্দাবন-কুরুক্ষেত্রে' চিকেন প্যাটিস বিক্রিকে ঘিরে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তথা আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলে।