ধ্বংসস্তূপে লুকিয়ে থাকা আভিজাত্যের এই জমিদার বাড়িতে গেছেন?

By সাজেদুর আবেদীন শান্ত
2 October 2025, 12:40 PM

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগর গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়ে ধ্বংসপ্রায় এক অট্টালিকা। ভাঙা দেয়ালে আগাছার দাপট, দোতলার বারান্দায় ভেঙে পড়া সিঁড়ি, করিডরের ফাটল আর ঝাপসা রঙ যেন নীরব ভাষায় বলে এখানে একদিন ছিল গৌরব, ছিল আভিজাত্য, ছিল রাজকীয় আসর। এটিই হেমনগর জমিদার বাড়ি।

প্রথম দেখায় মনে হতে পারে পরিত্যক্ত কোনো প্রাচীন স্থাপনা। কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায়, এখানে রয়েছে ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়। শতাব্দীর বেশি সময় আগে নির্মিত এই প্রাসাদ এক সময় ছিল উত্তরবঙ্গের জমিদারির শান-শওকতের প্রতীক।

ইতিহাস বলে হেমচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন পুখুরিয়া পরগণার জমিদার। তার বংশ উত্তরবঙ্গের প্রভাবশালী জমিদার পরিবারের মধ্যে অন্যতম। যমুনা নদীর ভাঙনে পুরোনো রাজবাড়ি বিলীন হয়ে গেলে তিনি নতুন করে হেমনগরে নির্মাণ করেন এই জমিদার বাড়ি। প্রায় ৬০ একর জমিজুড়ে গড়ে তোলা হয় এই প্রাসাদ।

hemnagar1_2oct25.jpg
ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

তৎকালে ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরের এই জনপদে এমন অট্টালিকা গড়া সহজ ছিল না। তবুও জমিদারের ঐশ্বর্য আর উচ্চাভিলাষ মিলেই তৈরি হয়েছিল এ বাড়ি। চারপাশে ছিল বিস্তীর্ণ মাঠ, পুকুর, বাগান, অতিথিশালা। মূল ভবন ছিল দোতলা—বড় দরবার হল, অন্দর মহল আর বারান্দা।

স্থানীয়রা বলেন, এই বাড়ির কারুকাজ ছিল অনন্য। দরজায় ফুল-লতা-পাতার নকশা, কাঁচের অলংকরণ, ভেতরে আয়নার টুকরো দিয়ে সাজানো ছাদ, আর এর সঙ্গে বাংলার গ্রামীণ রূপের মেলবন্ধন। আর এ কারণেই অনেকে একে "পরীর দালান" নামেও ডাকেন।

কথা হয় স্থানীয় বৃদ্ধ আবুল হোসেনের সঙ্গে। বয়স তার প্রায় আশির কাছাকাছি। তিনি জানান, এককালে পূজার সময় আলো-ঝলমলে হয়ে উঠতো পুরো এলাকা। নাটকের আসর বসতো, পালাগান হতো, দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসতো।

তার মতে শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, সামাজিক উৎসব, আড্ডা, অতিথি আপ্যায়ন সব কিছুতেই জমিদার বাড়ি ছিল কেন্দ্রবিন্দু।

তবে স্বাধীনতার অনেক আগেই জমিদার প্রথার পতন ঘটে। জমিদার পরিবার দেশ ছেড়ে চলে গেলে বাড়িটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। সরকারি তত্ত্বাবধান না থাকায় ধীরে ধীরে এর করুণ পরিণতি হয়।

বাড়ির ছাদ ধসে পড়ে, দরজার কাঠ খসে যায়। চারপাশে জমে ওঠে আগাছা, ভেতরের কক্ষগুলোতে জমে ওঠে আবর্জনা।

তবে ভগ্ন হলেও হেমনগর জমিদারবাড়ির আকর্ষণ কমেনি। টাঙ্গাইল শহর থেকে সরাসরি গাড়ি করে আসা যায় এখানে। স্থানীয়রা বলেন, প্রতি সপ্তাহেই বিভিন্ন জায়গা থেকে বেড়াতে আসেন লোকজন।

সম্প্রতি ঢাকা থেকে এখানে বেড়াতে এসেছেন মেহেজাবিন আক্তার মিম নামে এক দর্শনার্থী। তিনি জানান, পরিবারসহ ঘুরতে এসেছিলাম গোপালপুরের ২০১ গম্বুজ মসজিদে। সেখানে শুনতে পেলাম, কাছেই নাকি এক জমিদার বাড়ি রয়েছে। এটার লোভ সামলাতে পারলাম না, তাই চলে আসলাম।

তিনি বলেন, জমিদার বাড়িটি অনেক সুন্দর। তবে ভেতরে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। পরিবেশ নোংরা। পরিচর্যা করা হলে ভ্রমণের দারুণ এক জায়গা হতো।

তবে তরুণ প্রজন্মের কাছে জায়গাটি রহস্য ঘেরা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত আসে। হেমনগরের কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার বলেন, 'আমরা বন্ধুদের নিয়ে মাঝে মাঝে আসি। ভেতরে ঢুকে ছবি তুলি, গল্প করি। জায়গাটা খুব ভয়েরও, আবার রোমাঞ্চকরও।'

স্থানীয় যুবক রাশেদ বলেন, 'আমরা চাই এই জমিদার বাড়িটি মেরামত করা হোক। এখানে যদি পর্যটক আসে, তাহলে গ্রামের মানুষও উপকৃত হবে। দোকানপাট, সবকিছু তৈরি হবে। অথচ অবহেলায় পড়ে আছে।'

পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথ সংস্কার ও প্রচারণা চালানো গেলে হেমনগর জমিদার বাড়ি অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হতে পারে। চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, স্থানীয় খাবার, আর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সব মিলে দেশি-বিদেশি ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে।

১৯৮৯ সালে জমিদার বাড়ির মূল ভবনে শুরু হয় হেমনগর ডিগ্রি কলেজের কার্যক্রম। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মেহের মাকসুদ জানান, বর্তমানে কলেজের নতুন ভবন হওয়ায় জমিদার বাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বাড়িটির অবস্থা খুবই ভঙ্গুর। একদম পরিত্যক্ত।

তিনি আরও বলেন, 'এই স্থাপনা এ অঞ্চলের সামাজিক ইতিহাসের দলিল। অথচ কোনো সংরক্ষণ নেই। অবহেলার কারণে প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। যদি এটা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় নিয়ে সংস্কার করা হয় তাহলে এটা গুরুত্বপূর্ণ এক দর্শনীয় স্থান হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'সংস্কার করা হলে প্রতিদিন এখানে অনেক দর্শনার্থী আসবে, ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে।'

এই অধ্যক্ষের মতে যদি বাড়িটি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে হেমনগর জমিদার বাড়ি শুধু টাঙ্গাইলের নয়, গোটা বাংলাদেশের ইতিহাস ও পর্যটনের মানচিত্রে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।