ছোটবেলার প্রিয় সেই কটকটি এখনো বিখ্যাত যে শহরে
বগুড়ার নাম শুনলেই যেমন সবার আগে মনে আসে দইয়ের কথা, তেমনি মহাস্থানগড়ের নাম শুনলেই আসে কটকটির কথা। এক সময় এই নগরী ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী। এখনো প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক এখানে আসেন ইতিহাসের টানে। আর সেই ইতিহাস ভ্রমণের শেষ হয় মহাস্থানগড়ের কটকটি দিয়ে। শত বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা এই কটকটি বগুড়ার আরেক ঐতিহ্য।
স্থানীয় প্রবীণদের মুখে শোনা যায়, প্রায় দেড়শত বর্ষ আগে বগুড়া সদর উপজেলার গোকুল ইউনিয়নের পলাশবাড়ী উত্তরপাড়ার জয়নাল আলী মণ্ডল, ভোলা মণ্ডল আর গেদা মণ্ডল প্রথম কটকটি বানানো শুরু করেন। গ্রামের মেলা কিংবা বিয়ের আসরে তখন পরিবেশন করা হতো এই নতুন ধরনের খাবার। মচমচে স্বাদ আর সহজলভ্য উপকরণের কারণে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে জনপ্রিয়তা।
তবে কটকটির নামের উৎপত্তি নিয়ে স্থানীয়দের মুখে শোনা যায় নানান উপকথা। কেউ কেউ বলেন, এটা খেতে অনেকটা শক্ত। দাঁতে পড়লে কটকট শব্দ হয়, তাই এর নাম কটকটি। আবার কেউ বলেন ভিন্ন কথা। তবে নাম যাই হোক, মহাস্থানগড় ঘুরতে গেলে কটকটির স্বাদ নেন না—এমন লোক নেই বললেই চলে। শুধু নিজেই স্বাদ নেন না, বাড়ি ফেরার সময় আত্মীয়স্বজনের জন্য ব্যাগভর্তি কটকটি নিয়ে যান।
মহাস্থানের কটকটি তৈরির কৌশল আলাদা। স্থানীয় কারিগর জানালেন কটকটি বানানোর রেসিপি। শুরুতে কটকটির মূল উপাদান ছিল গমের আটা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উপকরণে এসেছে নানা পরিবর্তন।
বর্তমানে এর প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেদ্ধ সুগন্ধি চাল। প্রথমে চালটি দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। চাল পুরোপুরি নরম হয়ে গেলে তা ছেঁকে নিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট শুকাতে দেওয়া হয়। এরপর ঢেঁকি, মেশিন বা অন্য কোনো উপায়ে চালকে খুব মিহি গুঁড়ায় পরিণত করা হয়।
কটকটি বানানোর কারিগর আরও জানায়, এই মিহি চালের আটার সঙ্গে পরিমাণমতো মসলা ও সয়াবিন তেল ভালোভাবে মিশিয়ে ঘন খামির তৈরি করা হয়। এরপর ছাঁচের সাহায্যে খামির থেকে নির্দিষ্ট আকৃতির টুকরো কেটে নেওয়া হয়।
কাটার পর সেগুলো বড় কড়াইয়ে গরম ভোজ্যতেল, ঘি ও ডালডার সংমিশ্রণে লালচে রঙ হওয়া পর্যন্ত ভাজা হয়। ভাজা হয়ে গেলে কটকটিগুলো গুড়ের রসে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এর এভাবেই তৈরি হয় মহাস্থানের কটকটি।
তবে এক্ষেত্রে আরও একটু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কারিগর। কারিগরের হাতের অভ্যাস না থাকলে কটকটি নরম হয়ে যাবে, শক্ত ও খাস্তা হবে না। তাই কারিগরের ভাজার কৌশলটাই আসল।
কারিগরের কথা অনুযায়ী, কটকটি মূলত তিন ধরনের—তেল ভাজা, ডালডা মিশ্রিত ও ঘিয়ে ভাজা। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় কটকটি হলো ঘিয়ে ভাজা, যা স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। সাধারণত প্রতিটি কটকটির আকৃতি হয় এক থেকে দেড় বর্গইঞ্চির মতো। আর উপকরণ অনুযায়ী দামেও তারতম্য রয়েছে।
মহাস্থানগড়ে বর্তমানে অর্ধশত কটকটির দোকান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে লাল মিয়া কটকটি হাউস, নাসির কটকটি প্যালেস, জিন্নাহ ভাণ্ডার অন্যতম।
লাল মিয়া কটকটি হাউসের মালিক লাল মিয়া প্রামাণিকের হাত ধরে এই কারবারে এসেছেন তার নাতি সামিউল ইসলাম। তিনি জানান, প্রায় পাঁচ প্রজন্ম ধরে তারা কটকটি বানায়। তাদের দোকানই মহাস্থানগড়ের সবচেয়ে পুরোনো দোকান।
সামিউল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন আমরা প্রায় চার-পাঁচ মণ কটকটি বিক্রি করি। চাহিদা সব সময় থাকে। দেশের বাইরে থাকা অনেকে ফোন করে কটকটি পাঠাতে বলেন। অনেকে বিমানবন্দরে ওঠার আগে আমাদের দোকান থেকে কিনে নেন।
সামিউল আরও বলেন, মহাস্থানের শেষ বৈশাখীর মেলায় কটকটির চাহিদা হয়ে যায় আকাশচুম্বী। তখন দিনে প্রায় ৯০ থেকে ১০০ মণ কটকটি বিক্রি হয়ে থাকে।
অন্যদিকে নাসির কটকটি প্যালেসের নাসির উদ্দিন জানান, বর্তমানে কেজি প্রতি কটকটির দাম ১৪০ থেকে ২০০ টাকা। এর মধ্যে শাহী কটকটি আছে, যার দাম ৩৫০ টাকা কেজি। তবে ঘিয়ে ভাজা কটকটির দাম বেশি হলেও সেটার চাহিদাই সবচেয়ে বেশি।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন মহাস্থানে প্রায় ২৫০ মণ কটকটি বিক্রি হয়। ঈদ, পূজা কিংবা উৎসবের সময় এই চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোস্তফা কামাল সরকার মনে করেন, মহাস্থানের কটকটি শুধু খাবার নয়, এটি এ অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। বাংলার অন্যতম প্রাচীন নগরীর ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া এই মিষ্টি আজ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে আছে। প্রত্ননগরী দেখতে আসা মানুষজন দইয়ের মতো কটকটিকেও এখন মহাস্থানের প্রতীক হিসেবে দেখেন।
'এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রামের অনেক মানুষ এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন এবং জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন', বলেন তিনি।


