‘হুমায়ুন ভাই বলতেন, সাবধানে চালাও, আমার কিছু হলে বাংলা সাহিত্যের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে’
ফরিদ আহমেদ দেশের নামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সময় প্রকাশনের কর্ণধার। তিনি বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির দুইবার নির্বাহী পরিচালক ও দুইবার সভাপতি ছিলেন। ৩৫ বছর ধরে তিনি দেশের অনেক খ্যাতনামা লেখকের বই প্রকাশ করে আসছেন। নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের অনেকগুলো বইয়ের প্রকাশকও তিনি।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ফরিদ আহমেদের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। ১৩ নভেম্বর কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। বিশেষ এই দিনটিকে ঘিরে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজের স্মৃতিচারণা করেছেন ফরিদ আহমেদ।
তিনি বলেন, 'হুমায়ূন আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট থাকাকালীন আমি সেখানে যেতাম। মাঝে মাঝে বাংলাবাজার যাওয়ার প্রয়োজন হলে আমাকে নিয়ে যেতে বলতেন। তারপর আমার মোটরসাইকেলের পেছনে বসে যেতেন, আমি তাকে বাংলাবাজার নিয়ে যেতাম। এটা কয়েকবার হয়েছে। ফেরার সময়ও তাকে নামিয়ে দিতাম।'
সেই সময় হুমায়ূন আহমেদ বই-সংক্রান্ত কাজ ও প্রকাশকদের সঙ্গে আড্ডা দিতে নিয়মিত বাংলাবাজার যেতেন। কখনো মাওলা ব্রাদার্সে, কখনো অন্য কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে বসে গল্প করতেন।
স্মৃতি রোমন্থন করে ফরিদ আহমেদ বলেন, 'একবার প্রয়াত প্রকাশক আলমগীর রহমানকে পাঁচটি বই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন হুমায়ূন ভাই। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে আলমগীর ভাই কাজ শুরু করলেন। একদিন তার স্ত্রী হুমায়ূন ভাইকে ফোন করে বললেন, "এত কাজ সে কীভাবে করবে?" এরপর হুমায়ূন ভাই আমাকে বললেন, "চলো, বাংলাবাজার যাই।"'
'তাকে নিয়ে বাংলাবাজার রওনা দিই। তখন যানজট কম থাকায় দ্রুতই পৌঁছে যাই। আলমগীর ভাইয়ের অফিস ছিল ডালপট্টিতে। সেখানে গিয়ে দেখা করার পর হুমায়ূন ভাই বললেন, "আলমগীর সাহেব, আপনি তো একসঙ্গে এত বই প্রকাশ করতে পারবেন না। কম বয়সী কেউ পারবে। আপনি বই ছাপাবেন, ফরিদ মার্কেটিং করবে।"'
সেদিন সেখান থেকে মাওলা ব্রাদার্সে যান হুমায়ূন আহমেদ। আরও কয়েকজন প্রকাশককে ডাকা হয়, হয় তুমুল আড্ডা। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় তাকে নামিয়ে দেন ফরিদ আহমেদ।
তিনি বলেন, 'মোটরসাইকেলে আসা-যাওয়ার সময় হুমায়ূন ভাই বলতেন, "অ্যাকসিডেন্টে আমার কিছু হলে বাংলা সাহিত্যের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। সাবধানে চালাও।"'
পরিচয়ের শুরুর গল্পও শোনান ফরিদ আহমেদ। 'বেশ আগে আমি অধুনা নামে সাহিত্যপত্রিকা বের করতাম। প্রকাশক ছিলাম আমি, কবি শামসুর রাহমান ছিলেন উপদেষ্টা সম্পাদক। সেই আড্ডায় দুইবার এসেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি অধুনায় "শীত" নামে একটি গল্প লিখেছিলেন। ধানমন্ডির চার নম্বরের অধুনার অফিসেই প্রথম পরিচয়। পরে আমি ও আমীরুল ইসলাম তার বাসায় যাই। সেদিনই তিনি আমার নাম ধরে ডাকেন। ভেবেছিলাম চিনবেন না, কিন্তু দেখলাম নাম মনে রেখেছেন।'
মান-অভিমান নিয়ে ফরিদ আহমেদ বলেন, 'অনেকবার মান-অভিমান হয়েছে। প্রচণ্ড রাগী মানুষ ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে ভালোবাসাও ছিল।'
হুমায়ূন আহমেদের জোছনাপ্রীতি নিয়ে তিনি বলেন, 'জোছনা কীভাবে দেখতে হয়, গায়ে মাখতে হয়, তা হুমায়ূন আহমেদই শিখিয়েছেন। জোছনার ফুল এবং তার আমার ছেলেবেলা বইয়ে সেই অনুভূতি পড়েছি।'
পাণ্ডুলিপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'হুমায়ূন ভাই কাউকেই পুরো পাণ্ডুলিপি একসঙ্গে দিতেন না। কয়েক পৃষ্ঠা করে দিতেন। তবে আমাকে একবার "ছেলেটা" নামে একটি উপন্যাসের পুরো পাণ্ডুলিপি একসঙ্গে দিয়েছিলেন।'
'লেখা শেষ হওয়ার পর ছাপা বই দেখার জন্য তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। আমরা তখনকার প্রকাশকরা জানতাম যতটুকু লেখা শেষ, ততটুকুই মেকআপ করে প্রেসে পাঠিয়ে দিতাম। বইয়ের প্রচ্ছদ আগেই ছাপিয়ে রাখা হতো।'
সবশেষে দেশে বই বিক্রির বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, 'গত দেড় বছরে বই বিক্রি আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে প্রকাশনা শিল্প বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে ভবিষ্যতে।'