নির্বাচনের আগে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে প্রকাশ্য হত্যার ঘটনা
জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যেই দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে জনাকীর্ণ স্থানে গুলি করে হত্যার মতো ঘটনা এই উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জোর দিয়ে বলছেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির 'কোনো আশঙ্কা নেই'। তবে অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির অন্যতম কারণই হলো নির্বাচনী উত্তেজনা।
অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, দুর্বল পুলিশিং এবং গত বছরের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর মুক্তি পাওয়া শীর্ষ অপরাধীদের পুনরায় সক্রিয় হওয়া—এসব বিষয়ের কারণেই প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড ঘটছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
তারা আরও বলছেন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘাত এবং নির্বাচনের আগে আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র গ্যাং ব্যবহারের প্রবণতা সারা দেশে টার্গেটেড হামলা ও সশস্ত্র সহিংসতাকে আরও উসকে দিচ্ছে।
আগামী সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। এর মধ্যেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীরা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। দল মনোনীত প্রার্থী নিয়ে সহিংস বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের খবরও পাওয়া গেছে। কিছু জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য দলের কর্মীদের মধ্যেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ অন্যান্য স্থানে ধারাবাহিকভাবে ভয়াবহ হামলা ও প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড জননিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
গত ১৭ নভেম্বর রাজধানীর পল্লবী এলাকায় স্থানীয় যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যা করার পর হামলাকারীরা পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন গতি বাড়াতে অস্বীকৃতি জানালে তারা এক রিকশাওয়ালাকেও গুলি করে আহত করে।
একটি দোকানের ভেতরে কিবরিয়াকে হামলাকারীদের একাধিকবার গুলি করার একটি সিসিটিভি ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে তা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
চলতি সপ্তাহে খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বাইরে অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত দুই ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
দিন কয়েক আগে ঢাকার ব্যস্ততম আদালত এলাকার কাছে তালিকাভুক্ত শীর্ষ অপরাধী তারিক সাইফ মামুনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গত মাসের শুরুতে চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নেতা সরোয়ার হোসেন বাবলাকে হত্যা করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের অবস্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ১২০ জন নিহতের খবর জানিয়েছে। শুধুমাত্র নভেম্বর মাসেই ৯৬টি সহিংস রাজনৈতিক ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে যার ফলে ১২ জন নিহত এবং প্রায় ৮৭৪ জন আহত হয়েছেন। অক্টোবরে ৬৪টি ঘটনায় ১০ জন নিহত এবং ৫১৩ জন আহত হন।
সংগঠনটি উল্লেখ করেছে যে, দলের অভ্যন্তরে এবং আন্তঃদলীয় সংঘর্ষ চাঁদাবাজি, ভয় দেখানো এবং ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়ন সংক্রান্ত বিরোধ অনেক বেড়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্যও একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। গত ১৫ মাসে দেশব্যাপী কমপক্ষে চার হাজার ৮০৯টি খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসে তিন হাজার ২৩৬টি খুনের মামলা দায়ের হয়েছে। ২০২৪ ও ২০২৩ সালে একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে তিন হাজার ২৯ ও দুই হাজার ৫৬৩।
১৫ মাসের মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ৫৫১টি খুনের মামলা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো ৫ আগস্ট বা তার আগের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু সম্প্রতি দায়ের করা হয়েছে।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে মাসিক গড় খুনের মামলা ৩২২টিতে নেমেছে। গত বছরের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ৩৪৩। এর আগে ২০২৩ সালে একই সময়ে ২৫২টি, ২০২২ সালে ২৬০টি এবং ২০২১ সালে ২৬৮টি মামলা দায়ের হয়েছিল।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৩২৫টি খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ২৬১টি। তবে, গত বছর একই সময়ে গড়ে প্রতি মাসে খুনের ঘটনা বেড়ে ৩৭৪টিতে পৌঁছায়। শুধুমাত্র ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেই ৬২৬টি খুনের মামলা দায়ের হয়। সেই সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া কিছু খুনের মামলা ২০২৫ সালেও দায়ের করা হয়েছে।
২৩ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলার অবনতির 'কোনো শঙ্কা নেই'। তিনি আরও বলেন যে সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ও মিছিলের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। আমরা যখন দায়িত্ব নিই, তখন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল। গত দেড় বছরে আমাদের প্রচেষ্টা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতিতে সাহায্য করেছে।
বন্দুক সহিংসতা বেড়েছে
সিজিএসের বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগ্নেয়াস্ত্র-সম্পর্কিত অপরাধ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জুন পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ১৫০টিরও বেশি ঘটনার খবর রয়েছে। জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় থানা থেকে লুট হওয়া এক হাজার ৩০০'রও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র চলমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
যদিও সরকার চুরি যাওয়া অস্ত্র সম্পর্কে তথ্যের জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করেছে, তবুও অগ্রগতি খুব কম। নভেম্বরে বন্দুক সহিংসতার ঘটনা ছিল অবাক করার মতো।
৩০ নভেম্বর খুলনায় ফজলে রাব্বি রাজন (৩৫) ও হাসিব হাওলাদারকে (৩১) মহানগর দায়রা জজ আদালতের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়।
২ নভেম্বর বিএনপির দুই গ্রুপের বিরোধে মুন্সীগঞ্জে তুহিন দেওয়ানকে (২২) গুলি করে হত্যা করা হয়। আটদিন পর একই বিরোধ সংক্রান্ত সংঘর্ষে ৩৫ বছর বয়সী আরিফ মীর নিহত হন, আহত রায়হান খান (২২) গত ১১ নভেম্বর মারা যান।
খুলনার আড়ংঘাটায় একই দিনে বিএনপি অফিসের কাছে শিক্ষক ইমদাদুল হক (৫৫) গুলিবিদ্ধ হন।
১৫ নভেম্বর লক্ষ্মীপুরে ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়, তার স্ত্রী ছাত্রদলের এক কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন।
২৭ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাবেক ছাত্রদল নেতা সাদ্দাম হোসেনকে (৩৫) মধ্যরাতে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিহ্নিত অপরাধী সরোয়ার হোসেন বাবলা (৪৩) নিহত হন। পুলিশ বলছে, আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি গোষ্ঠীর বিরোধের জেরে তাকে হত্যা করা হয়।
গত ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় শ্রমিকদল নেতা আবদুল মান্নানকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
১৭ নভেম্বর ঢাকার মিরপুরে দুর্বৃত্তরা একটি দোকানে ঢুকে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াকে (৪৭) গুলি করে হত্যা করে।
অক্টোবরে দেশজুড়ে রাজনৈতিক বা স্থানীয় আধিপত্য সংক্রান্ত একাধিক হত্যাকাণ্ডের পর এই সহিংসতা শুরু হয়। এর মধ্যে অনেক সহিংস ঘটনা ঘটে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে।
ডিসেম্বর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বশত্রুতার কারণে ঢাকার জুরাইন এলাকায় পাপ্পু নামে ২৬ বছর বয়সী এক অটোরিকশাচালককে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সম্প্রতি অপরাধবিদ ওমর ফারুক দ্য ডেইলি স্টার বলেন, প্রত্যেক নাগরিক 'এখন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন।'
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা এবং পুলিশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ফারুক বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। কারণ, রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো শক্তি প্রদর্শন, সশস্ত্র শক্তি প্রদর্শন এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয় দেখানোর জন্য মুক্তিপ্রাপ্ত আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধীদের কাজে লাগাতে পারে।
তিনি সরকার ও পুলিশকে অভিযানের মাধ্যমে চিহ্নিত অপরাধীদের পুনরায় গ্রেপ্তার এবং অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের আহ্বান জানান।
'অন্যথায়, আসন্ন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ বা সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম, এবং হত্যাকাণ্ড ও সহিংস অপরাধের ঘটনা তীব্রভাবে বাড়তে পারে', সতর্ক করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মুনিরুজ্জামানও উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে বলেন, পুলিশের উপস্থিতি এবং কার্যকারিতা প্রত্যাশার চেয়ে কম।
'রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত এমন উদ্যোগ নেওয়া, যাতে পুলিশ বাহিনীর মনোবল বাড়ে এবং তারা আরও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে,' বলেন তিনি।
গত রাতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র এএইচএম শাহাদাত হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, জুলাই আন্দোলনের পরের কয়েক মাসের তুলনায় এখন নির্বাচনের আগে পুলিশ আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করছে।
টার্গেটেড হত্যা ঠেকানো নিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা আগে থেকে অনুমান করা কঠিন।
তিনি বলেন, 'আমরা দেখি যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা ব্যক্তিগত শত্রুতা ব্যক্তিগত বা ছোট কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে ঘটে। আর ওই স্তরে কী হচ্ছে, তা আগে থেকে শনাক্ত করা বা ঠেকানো কঠিন।'
তিনি আরও বলেন, 'তবে কোনো সংকেত পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিই। যেমন—কোনো অপরাধী জেল থেকে ছাড়া পেলে আমাদের গোয়েন্দা ইউনিট তাকে নজরদারিতে রাখে। যদি কিছু ঘটার আশঙ্কা দেখা যায়, পুলিশ দ্রুত হস্তক্ষেপ করতে পারে বা সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।'