‘দেয়ালে শত শত লেখা ছিল, সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে’

জায়মা ইসলাম
জায়মা ইসলাম
মুনতাকিম সাদ
মুনতাকিম সাদ
13 February 2025, 05:55 AM
UPDATED 13 February 2025, 13:31 PM

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল যে তিনটি আয়নাঘর পরিদর্শন করেছেন সেসব ছবি যখন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় তখন সেখান থেকে বেঁচে ফেরা মানুষগুলো তাদের বন্দি করে রাখা জায়গাগুলো দেখে সহজেই চিনতে পারেন।

মুক্তি পাওয়ার পর (বিভিন্ন সময়ে) তাদের কোথায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল তারা আর জানতে পারেননি, কারণ এসব আয়নাঘর ছিল প্রবেশাধিকারের বাইরে।

এমনকি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্তকারী কমিশনকেও আয়নাঘরের ছবি তুলতে নিষেধ করা হয়েছে বলে এর আগে প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা এক চিঠিতে অভিযোগ জানিয়েছিলেন তারা।

২০১৬ সালের ৪ আগস্ট সাদা পোশাকের লোকজন হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। পরের বছর ২ মার্চ তিনি মুক্তি পান।

গতকাল আগারগাঁও, কচুক্ষেত এবং উত্তরায় যে তিনটি আয়নাঘর পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা ও তার দল তাদের সঙ্গে ছিলেন হুম্মাম।  

বননিবাস হিল রিসোর্ট

কচুক্ষেতে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স সদরদপ্তরের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলের (জেআইসি) নিচতলায় তাকে যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল সেই জায়গাটা চিনতে পারেন হুম্মাম।

'আমি যে সেলে ছিলাম শুধু সেটাই খুঁজে পাইনি, দেয়ালের যে জায়গায় আমি আমার নামের আদ্যক্ষর ও তারিখ খোদাই করেছিলাম সেটাও খুঁজে পেয়েছি। সেটা নিচের দিকে ছিল। দেয়ালে রঙ করলেও সেই জায়গাটা মিস করে গেছে তারা।'

হুম্মাম বলেন, 'যখন আমাকে আমার সেল শনাক্ত করতে বলা হয় আমি বলেছিলাম যে আমি চোখ খোলা রেখে এটি করতে পারব না, কারণ আমাদের সবসময় চোখ বেঁধে রাখা হতো। তাই আমি স্টেপ গুণতে শুরু করি, তারপর ওই সেল খুঁজে পাই।'

২০১৮ সালের ৭ মে থেকে ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত জেআইসির ভেতরে আয়নাঘরে ছিলেন ইকবাল চৌধুরী। তিনি দুটি কামরা শনাক্ত করতে পারেন, সম্ভবত সেখানেই তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।

তিনি বলেন, একটা ঘর উঁচু দেয়ালসহ ছিল, যেটা এখন গোলাপি রং করা হয়েছে সেটা সম্ভবত মূল ঘর ছিল। দেয়ালে অজস্র লেখা ছিল, সব রঙে ঢাকা পড়ে গেছে।

এর আগে ২০২২ সালে ইকবাল চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'আমার ঘরে একটি লোহার খাট ছিল এবং তোষকের জন্য আমাকে চারটা কম্বল দেওয়া হয়েছিল। সারাক্ষণ ঘরে একটা একটা বাল্ব জ্বলত, আর দরজার কোণে একটা এক্সজস্ট ফ্যান ঘুরত।'

অন্য ঘরটি ছিল একটি ছোট ঘর। যার দেয়াল ছিল রুক্ষ, সাদা। এই ঘরটি গতকাল চিনতে পারেন ইকবাল। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এখানে তাকে একটানা তিন সপ্তাহ রাখা হয়েছিল।

১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে আয়নাঘরে গুমের শিকার ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ছবিগুলো দেখে তিনি ডিজিএফআইয়ের হেফাজতে থাকা তিনটি কক্ষ ও টয়লেট শনাক্ত করতে পেরেছেন।

'একটি রুমে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা এখনও দেখা যাচ্ছে কিন্তু তারা আগের চারটি ফ্যান সরিয়ে ফেলেছে। তারা টয়লেটের পাশের দেয়াল ভেঙে রুমগুলো নতুন করে রঙ করেছে।'

'দেয়ালে শত শত লেখা ছিল, কিন্তু সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। তারা সমস্ত প্রমাণ ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে।'

হতাশা প্রকাশ করে মারুফ জামান আরও বলেন, 'কয়েকদিন যাদের আটকে রাখা হয়েছিল সেই ছাত্রনেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। অথচ আমাদের সেখানে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছিল, তবুও আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে আয়নাঘরে বন্দি এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর মুক্তি পাওয়া মাইকেল চাকমাও তাকে বন্দি করে রাখা কক্ষ চিনতে পারেন।

তিনি দুটি কক্ষের ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে তার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, যে তাকে প্রায় দুই বছর ধরে রুক্ষ সাদা দেয়াল এবং লোহার গেটসহ একটি সেলের ভেতরে রাখা হয়েছিল এবং পরে পাশের একটি সেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।

এই কক্ষগুলো ২৪ ঘণ্টা সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে মনিটর করা হতো, বলেও জানিয়েছেন তিনি।

মাইকেল চাকমা যে অন্য কক্ষটি শনাক্ত করেন সেই একই উঁচু দেয়ালযুক্ত সেলটি চিনতে পেরেছিলেন ইকবালও। মাইকেল জানান, ওই ঘরে তাকে এক বছর বন্দি রাখা হয়।

এই রুমের পর আরও একটি রুম ছিল। এরপর টয়লেট, বাথরুম ও চুল কাটার সেল। এছাড়া আরও অনেকগুলো রুমে তাকে রাখা হয় বলেও জানান তিনি।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ব্যক্তি ছবিগুলো দেখে উত্তরায় র‍্যাব সদর দপ্তরের ভেতরে টাস্কফোর্স ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের সেলগুলো চিনতে পারেন।

'আমাকে যে সেলে রাখা হয়েছিল তার মেঝেতে স্পাইকসহ একটি ধাতব স্ল্যাব ছিল। সেই স্পাইকগুলো এখন সরিয়ে ফেলা হয়েছে।'

stone_jenni_garner.jpg
বন্দিদের রাখার একটি কক্ষ। ছবি: পিআইডি

তিনি আরও বলেন, বন্দিদের ঝুলিয়ে রাখতে ও নির্যাতন করার জন্য দেয়ালে শিকল লাগানো ছিল।

তবে সব ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারকে আয়নাঘর পরিদর্শনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী প্ল্যাটফর্ম মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলী শাহিনবাগে কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে বলেন, ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

'আমাদের দাবি ছিল যে সমস্ত আয়নাঘর ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের জন্য উন্মুক্ত করা হোক। কিন্তু আমাদের এখনও বাধা দেওয়া হচ্ছে। যারা অপরাধ করেছে, তাদের এখনও সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে।'