আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চ্যালেঞ্জ: পুলিশ ব্যারাকে অমানবিক জীবনযাপন
রাজধানী ঢাকার অন্যতম অভিজাত এলাকা বনানী। এখানে চারপাশ জুড়ে আলিশান সব আবাসন চোখে পড়বে। কিন্তু, পুরোই উল্টো চিত্র দেখা যায় কেবল বনানী থানার ব্যারাকে।
গগনচুম্বি ভবন ও বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ভরা এই এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা এমন পরিবেশে থাকেন, যা বসবাসের উপযুক্তই নয়।
বনানীর ৭ নম্বর রোডের একটি তিনতলা ভবনের নিচতলায় ওসি, ডিউটি অফিসার ও দুইজন পরিদর্শকের বসার কক্ষ, অস্ত্রাগার এবং হাজতখানা। নারী আসামিদের জন্য আলাদা কোনো জায়গা নেই।
সিঁড়িতে স্তূপ করে রাখা হয়েছে ট্রাঙ্ক ও ব্যাগ। দ্বিতীয়তলায় হাতে লেখা রয়েছে 'এএসআই ও এসআই কার্যালয়'। কিন্তু ভেতরে কোনো ডেস্ক বা চেয়ার নেই। শুধু কয়েকটি ছোট ছোট ক্যাম্প খাট, যার ওপর ঝুলছে ছেঁড়া মশারি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক উপপরিদর্শক (এসআই) বলেন, 'এটাই আমাদের অফিস। আমরা এখানে বসেই মামলার প্রতিবেদন বানাই, প্রমাণ রাখি। অন্য থানার মতো এখানে কোনো ডেস্ক নেই। খাটে বসেই নথিপত্র নিয়ে কাজ করতে হয়।'
এক কনস্টেবল বলেন, 'এখানে মশার চেয়ে বড় সমস্যা হলো ছারপোকা।'
তৃতীয়তলায় ফ্লোর থেকে ৭-৮ ফুট উঁচু টিনের ছাদের নিচে ৪২টি বিছানা। এই তলায় মাত্র দুটি টয়লেট ও একটি গোছলখানা আছে। প্রায় ৬০০ বর্গফুটের এই জায়গায় ২০ জনের মতো কনস্টেবল গাদাগাদি করে ঘুমান—মাঝে কোনো জায়গা থাকে না।
তাদের স্যুটকেস, ট্রাঙ্ক এবং তোয়ালে ও লুঙ্গির মতো অন্যান্য জিনিসপত্র এক কোণে স্তূপ করে রাখা। সেখানে কোনো সিলিং ফ্যান নেই। ভেতরে ঢুকলেই দমবন্ধ লাগে।
গত ৫ অক্টোবর থানাটি ঘুরে দেখার সময় এক কনস্টেবল দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, 'ছাদের উচ্চতা কম থাকার কারণে সিলিং ফ্যান লাগানো যায় না। একটা স্ট্যান্ড ফ্যান আছে শুধু রুমে।'
আরেক কনস্টেবল বলেন, 'এখানে কোনো পরিচ্ছন্নতা কর্মী নেই। আমরা ডিউটির পরে নিজেরাই ভাগ করে মেঝে ঝাড়ু দিই, মুছি। তারপর একটু বিশ্রাম নিতে পারি।'
কনস্টেবল রশিদুল হক জানান, গত বছরের অক্টোবরে এই থানায় যোগ দেওয়ার পর তিনিসহ আরও ১০ জন পুলিশ সদস্যকে তৃতীয়তলায় প্রায় ২০০ বর্গফুটের নামাজের রুমের মেঝেতে ঘুমাতে হয়েছে।
তিনি বলেন, 'তৃতীয়তলার বিছানায় জায়গা পাওয়ার জন্য আমার প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু সেখানেও তো গাদাগাদি করেই থাকতে হয়।'
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাসেল সারোয়ার স্বীকার করেছেন যে তাদের এই ব্যারাকে থাকার জায়গার অবস্থা ভয়াবহ।
তিনি বলেন, 'এই থানার মোট ১৩০ জন সদস্য। সবার জন্য এখানে থাকার জায়গাই নেই।'
ওসি জানান, এই ব্যারাকে ৮৫ জন পুলিশ সদস্য থাকেন, যাদের বেশিরভাগই কনস্টেবল। এসআই ও এএসআইরা বাড়ি ভাড়া করে পরিবার নিয়ে থাকেন।
সারোয়ার আরও জানান. তার থানায় পুলিশ সদস্যেরও ঘাটতি আছে। যার ফলে বাধ্য হয়ে মাত্র দুইজনের টহল দল গঠন করতে হচ্ছে, যেখানে এই ধরনের দলে অন্তত ৩-৪ জন থাকা প্রয়োজন।
থাকার জায়গা কম হওয়ার কারণেই কর্তৃপক্ষ এই থানায় পুলিশ সদস্যও কম রাখতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সারোয়ার বলেন, 'ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত। তারা নতুন ভবন বানানোর জন্য বিকল্প জায়গা খুঁজছেন। কিন্তু এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।'
মিরপুর ১ নম্বরে শাহ আলী থানার পরিস্থিতিও প্রায় একই। একটি ছোট তিনতলা ভবনে কোনো রকমে কনস্টেবলদের রাখা হয়।
শাহ আলী থানার ওসি গোলাম আজম জানান, সেখানে মোতায়েন ১৪৫ জন সদস্যের বেশিরভাগই দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলায় অথবা অস্থায়ী শেডে থাকেন। বনানীর মতো, শাহ আলীর এসআই ও এএসআইরা তাদের পরিবারের নিয়ে বাড়ি ভাড়া করে থাকছেন।
থানার বাইরের ফুটপাতে টিনের ঘর তুলে অস্থায়ী কোয়ার্টার বানানো হয়েছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম, কিংবা মশা—সবকিছুর মধ্যেই সেখানে থাকতে হয় কনস্টেবলদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাহ আলী থানার এক কনস্টেবল বলেন, 'রান্নাঘর নেই। আমরা আশেপাশের হোটেলে খাই। খাওয়ার পেছনেই একেক জনের প্রায় ৬ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। রান্না করতে পারলে খরচ তো কমানো যেতো।'
তারপরও এখানে যারা ঘুমানোর জায়গা পান না তারা পাশের একটি কমিউনিটি সেন্টারে যান।
ওই কনস্টেবল বলেন, 'যখন কমিউনিটি সেন্টারেও বেশি ভিড় হয়ে যায়, অনেকে পাশের মসজিদের বারান্দায় ঘুমাতে চলে যায়।'
আরেকজন কনস্টেবল জানান, এই অবস্থায় তাদের ঘুম ঠিকমতো হয় না। যার প্রভাব পরে তাদের কাজে। বলেন, 'রাতে কাজ থেকে ফিরে যে পরিবারের সঙ্গে একান্তে কথা বলব, সেই অবস্থাও এখানে নেই।'
ওসি আজম বলেন, থানার রিজার্ভ পুলিশ সদস্যদের জন্য বিশ্রামের কোনো জায়গা নেই। তারা ডিউটি শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে।
গত ৬ অক্টোবর সরেজমিনে থানার সামনে গিয়ে দ্য ডেইলি স্টার দেখতে পায়, ইউনিফর্ম পরা বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ফুটপাতে, পার্ক করা রিকশায় বা চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে ২৫টি ভাড়া করা ভবনে, আর বাকিগুলো পুলিশের মালিকানাধীন জমিতে। অনেক থানার অবস্থা খারাপ এবং বনানী ও শাহ আলী থানার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
তাদের ভাষ্য, রক্ষণাবেক্ষণের কিছু কাজের পর সম্প্রতি পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু, তারপরও অনেকের জন্য প্রতিদিনের এই জীবনযাত্রা যেন এক সংগ্রাম।
বেশ কয়েকজন পরিদর্শক বলেছেন, ১২-১৪ ঘণ্টা ডিউটির পরে যখন তারা ঠিকভাবে বিশ্রামটাও নিতে পারেন না, তখন পরদিন জননিরাপত্তার জন্য কাজ করার অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়।
গত ৬ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) সরদার নুরুল আমিনের কাছে এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে ১০৭টিতে ব্যারাক উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।'
তিনি বলেন, '৫২টি থানার নির্মাণ ও মেরামত চলতি অর্থবছরের মধ্যে এবং বাকিগুলো আগামী অর্থবছরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।'
গত বছরের ২ জুলাই একনেকে ১০৭টি থানার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করে।
নুরুল আমিন বলেন, 'আমরা আরও ১১৬টি পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছি। সেটার অনুমোদনের জন্য শিগগির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।'
