নরওয়ের নারীর ‘মায়ের তরি’ শিশুদের শেখাচ্ছে লোকগান

এস দিলীপ রায়
এস দিলীপ রায়
13 November 2025, 05:29 AM

দূর থেকে ভেসে আসছে শিশুদের গলা মিলিয়ে গাওয়া গানের সুর—মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার সোনারহাট ইউনিয়নের চলবলা গ্রামের মাটিতে এমন চেনা-অচেনা অনেক সুরই যেন প্রাণ পায়।

এই প্রাণচাঞ্চল্যের পেছনে আছে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ, 'মায়ের তরি' নামে একটি সংগঠন। নরওয়ের নাগরিক কবি, আলোকচিত্রী ও গবেষক উয়েরা সেথের বাংলা লোকসংস্কৃতির প্রতি গভীর প্রেম থেকে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এই সঙ্গীতালয়।

2.jpg
ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

বাংলাদেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে এখন ছয় শতাধিক শিশু এই সংগঠনে এসে শিখছে লালনগীতি, মারফতি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি ও অন্যান্য লোকগান। তাদের হাতে আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে দোতারা, একতারা, সারিন্দা, খমক, তবলা, বাঁশি, ঢোল, বেহালা—গ্রামীণ সুরের চিরচেনা বাদ্যযন্ত্রগুলো।

আধুনিক মেলোডি ব্যান্ডের যুগেও মায়ের তরির এই উদ্যোগ সংস্কৃতি অঙ্গনে এক অনন্য আলো জ্বেলে দিয়েছে।

3.jpeg
ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

চলবলা গ্রামের "কর্মলয় গুরুগৃহ"-এ সপ্তাহে দুদিন শেখানো হয় লোকগান ও বাদ্যযন্ত্র। গুরু নিত্যানন্দ রায় বলেন, 'আমাদের গুরুগৃহে শুক্রবার ও শনিবার লোকগান ও লোকবাদ্য শেখানো হয়। গ্রামাঞ্চলের এসব শিশুরা সাধারণত শহরে গিয়ে সাংস্কৃতিক শিক্ষা পায় না। তাই আমরা চেষ্টা করছি তাদের লোকসংগীত ও বাদ্যযন্ত্র শেখানোর সুযোগ করে দিতে।'

কর্মলয় গুরুগৃহের জীর্ণ টিনশেড ঘরের ভেতর বসে প্রায় ৬০-৭০ জন শিশুকে শিক্ষা নিতে দেখা যায়। কেউ হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে, কেউ দোতারা হাতে তালের অনুশীলনে ব্যস্ত। গান গাইছে শিশুরা, সঙ্গে বাজছে বাঁশি, মন্দিরা, একতারা। উপস্থিত গ্রামবাসীরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে সেই সুর।

কথা হয় কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারা জানায়, এখানে তারা লালনগীতি, পল্লীগীতি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া, বাউলসহ নানা ধারার লোকগান শেখে। শুধু গান নয়, বাদ্যযন্ত্র বাজানোর প্রশিক্ষণও পাচ্ছে এই গুরুগৃহে।

4.jpg
ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

একই চিত্র দেখা যায় লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার "সুরালয় গুরুগৃহ"-এও। সুরালয়ের গুরু লিপি দেবনাথ বলেন, 'আমাদের শিক্ষার্থীরা আন্তরিক। তারা শুধু গান নয়, শেখে মানবিক মূল্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা ও সহভাগিতার শিক্ষা। আমরা বিশ্বাস করি তারা শুধু শিল্পী নয়, আদর্শ মানুষ হিসেবেও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।'

5.jpeg
ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার মাঝিপাড়া গ্রামে গুরুগৃহের গুরু ফকিরুল ইসলাম জানান, 'আমাদের এখানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান। তারা লোকগান শেখার মধ্য দিয়ে নতুন উদ্যমে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছে। আমরা তাদের নিয়ে গর্বিত।'

নরওয়ের নাগরিক উয়েরা সেথের প্রথম বাংলাদেশে আসেন ১৯৯৮ সালে। সে সময় কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার উত্তর নামাজেরচর এলাকায় ভয়াবহ বন্যার পর তিনি স্থানীয় মানুষের জীবন দেখেছিলেন কাছ থেকে। তাদের মুখে শোনা মারফতি ও মুর্শিদি গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি।

6.jpeg
ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

সেই মুগ্ধতাই পরিণত হয় আজকের "মায়ের তরি"-তে। ২০১৬ সালে স্থানীয় শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সহায়তায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এই সংগঠন। এরপর থেকে শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে লোকগানের আলো।

বর্তমানে দুই জেলায় ৯টি গুরুগৃহে ৪৬০ জন শিশু নিয়মিত লোকগান শিখছে। আর দুটি বাদ্যযন্ত্র প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আরও ১২৫ জন শিক্ষার্থী শিখছে লোকবাদ্যের সুর।

উচ্চতর শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বিশেষ "তরীর ক্লাস", যেখানে তারা লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারায় গভীর জ্ঞান অর্জন করে।

উয়েরা সেথের বলেন, 'আজকের পৃথিবীতে যুদ্ধ, লোভ আর প্রকৃতির ধ্বংসের মধ্যে মানুষকে সুস্থ রাখা খুব কঠিন। তখন আমার মনে হয়, লালন, বাউল, মারফতি, মুর্শিদি গানই পারে মানুষকে প্রকৃত প্রেম ও শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে। তাই আমি উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে মিলে মায়ের তরির যাত্রা শুরু করেছি। এখানে আমরা শিশুদের সংগীতশিক্ষার পাশাপাশি মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।'

একই সঙ্গে তিনি ৫৩টি লালনগান নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনুবাদ করে একটি বইও প্রকাশ করেছেন বলে জানান।

মায়ের তরির পরিচালক সুজন কুমার বেদ বলেন, 'মায়ের তরি কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়—এটি একটি আন্দোলন। ভবিষ্যতে প্রবীণ শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের জন্যও মায়ের তরি হবে এক আশ্রয়স্থল, যেখানে প্রবীণরা তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ভাগ করবেন নতুন প্রজন্মের সঙ্গে।'

সংগঠক ইউসুফ আলমগীর বলেন, 'লোকসংগীতচর্চার মাধ্যমে আত্মসিদ্ধি ও জীবনবৃদ্ধি—এই ধারণা নিয়ে মায়ের তরি কাজ করছে। হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ সুর ও শব্দকে পুনরুজ্জীবিত করা আমাদের লক্ষ্য।'