আস্থার সংকটে দুর্নীতি দমন কমিশন

দীপন নন্দী
দীপন নন্দী
9 December 2025, 05:43 AM

যে প্রতিষ্ঠান দেশের দুর্নীতি দমন করবে, সেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমালোচিত হচ্ছে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির জন্য। যে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দুর্নীতি তদন্ত করা, তাদের বিরুদ্ধেই উঠছে ঘুষ, অবৈধ সুবিধা গ্রহণ ও অনিয়মের অভিযোগ। যেন যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানোর কথা, সেই সরিষার ভেতরেই ভূত বাসা বেঁধেছে!

এ অবস্থায় আজ মঙ্গলবার দুদক উদযাপন করছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস। প্রতিপাদ্য—'দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের ঐক্য: গড়বে আগামীর শুদ্ধতা।' অথচ দিবস পালনকারী প্রতিষ্ঠানটিই এখন বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে।

২০২৫ সালে এ পর্যন্ত দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে ছয়জন দুদক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরে তিনজন বরখাস্ত হন, যাদের একজন আবার পরিচালক পদমর্যাদার।

গত ১৭ বছরে ঘুষ, অবৈধ সুবিধা নেওয়া ও অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে দুদক মোট ২৪৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেকে বাধ্যতামূলক অবসরে গেছেন, কারও পদাবনতি হয়েছে, কারও বেতন কাটা পড়েছে। বর্তমানে অন্তত ১০ জন কর্মকর্তা বিভাগীয় মামলার মুখোমুখি।

দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, 'কমিশনের ভেতর দুর্নীতি অত্যন্ত দুঃখজনক। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।'

তবে দুর্নীতি বিরোধী সংগঠনগুলো বলছে—শাস্তি শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তাদের আদালতের মুখোমুখিও করতে হবে। নইলে দুদকের ওপর জনগণের আস্থা আরও কমবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক এবং দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রেখে কমিশন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।'

৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

গত ৮ সেপ্টেম্বর দুদক পরিচালক খন্দকার মিজানুল ইসলামকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অভিযোগ ছিল—যার বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করছিল, সেই বেসরকারি হাসপাতালের পরিচালকের কাছ থেকেই তিনি নিজের চিকিৎসা ব্যয়ের সুবিধা নিয়েছিলেন।

গত ৪ সেপ্টেম্বর বরখাস্ত হন উপপরিচালক মাহবুবুল আলম এবং সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জুলফিকার।

মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ—মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও এক প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়ে প্রায় ১ কোটি টাকা আদায় করেছেন। এছাড়া এসেনশিয়াল ড্রাগসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও আছে।

অভিযোগ আছে—দুদকের জুলফিকার আর্কেড রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে একটি মামলা 'সমাধান' করেছিলেন। তিনি ও তার পরিবার এমন একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন, যার ভাড়া বা ক্রয়মূল্য তিনি দেননি—এমন অভিযোগও আছে।

গত ৬ আগস্ট দুর্নীতি তদন্তে গাফিলতির অভিযোগে উপপরিচালক আহসানুল কবির পলাশকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

১৭ জুলাই ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে গাফিলতির জন্য উপপরিচালক কমলেশ মণ্ডলকেও চাকরিচ্যুত করা হয়।

৫ অক্টোবর সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অভিযোগ—তিনি একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে জাল কাগজপত্র প্রস্তুত, মিথ্যা নোটশিট তৈরি করে কমিশন সভায় পাঠানো এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও ধনী ব্যক্তিদের এসব কাগজ দেখিয়ে হয়রানি করতেন।

মার্চে সহকারী পরিচালক এস এম মামুনুর রশিদকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ভিযোগ—তিনি সাবেক স্ত্রীকে নির্যাতন ও যৌতুক দাবি করেছেন।

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, 'আমার কমিশন দুর্নীতিমুক্ত না হলে অন্যের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক অধিকার থাকে না। আমাদের ভেতরে দুর্নীতির প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।'

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মঈদুল ইসলাম বলেন, 'কমিশনের ভেতরের দুর্নীতি দুদকের কাজকর্ম ব্যাহত করে এবং জনগণের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে।'

তিনি জানান, চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি কমিটি অভিযোগ যাচাই করে ব্যবস্থা নিলেও দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি মোকাবিলায় এ কমিটিকে পুনরুজ্জীবিত করারও প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন।

সাবেক চেয়ারম্যানরা তদন্তের মুখে

ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো সাবেক দুদক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে কমিশন। ১ ডিসেম্বর দুদক নিশ্চিত করে যে সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে।

দুদক সূত্র জানায়, গত ১১ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়া তার ভাই সাদিক মাহমুদ বকুলকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ইকবালের নাম উঠে আসে। অভিযোগ—বকুলের সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের কুখ্যাত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর ব্যবসায়িক ঘনিষ্ঠতা ছিল। ইকবালের বিরুদ্ধে মিঠুর কাছ থেকে গুলশানে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

তদন্তে মানি লন্ডারিং, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।

৩ ডিসেম্বর দুদক সাবেক কমিশনার ও সাবেক বিটিআরসি চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হকের বিরুদ্ধেও একটি দুর্নীতির মামলা অনুমোদন দেয়। এটিও দুদকের ইতিহাসে প্রথম।

মামলায় বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের অনুমোদন ছাড়াই আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলরেট ০ দশমিক ০৩০ ডলার থেকে ০ দশমিক ০১৫ ডলার করা হয়। এতে সরকারের রাজস্ব আয় ৫১ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে কমে ৪০ শতাংশে নেমে যায়। আর আইজিডব্লিউ অপারেটরদের আয় ১৩ দশমিক ২৫ থেকে ২০ শতাংশে বেড়ে যায়।

এই সিদ্ধান্তে সরকারের ৩৮৩ দশমিক ৭৩ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি, কলরেট থেকে ২ হাজার ৯৪১ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা কম আয় এবং ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি তৈরি হয় বলে মামলায় উল্লেখ আছে।

সংস্কারের সুপারিশ

১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দুদক সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শনাক্ত ও শাস্তির জন্য গোয়েন্দা ও তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।

তারা বলেছে, দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটিকে বিলুপ্ত করে এর পরিবর্তে একটি স্বাধীন শৃঙ্খলাবিষয়ক বিভাগ গঠন করা উচিত। সেখানে দুদকের কর্মকর্তা ছাড়াও প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে জনবল থাকবে।

এই ইউনিটের কাজ হবে—কর্মচারীদের আচরণবিধি প্রয়োগ, গোপন অনুসন্ধান ও কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স পরিচালনা, ২০০৮ সালের দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধি অনুযায়ী সম্পদ বিবরণী পরীক্ষা করা এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।

২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর জায়গায় দুদক প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি অভ্যন্তরীণ অভিযোগে জর্জরিত। চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী তিন সদস্যের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি গঠনের ক্ষমতা দেওয়া হলেও এটি বহুদিন ধরেই অকার্যকর।