রক্তক্ষয়ী ত্যাগ আর অদম্য সাহস থেকে এক দেশের জন্ম

মহিউদ্দিন আলমগীর
মহিউদ্দিন আলমগীর
16 December 2025, 02:37 AM
UPDATED 16 December 2025, 10:03 AM

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এসে যুদ্ধের গতিপথ চূড়ান্তভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল। ইতিহাসের ধারা বদলে গিয়েছিল। স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি আর স্বপ্নে সীমাবদ্ধ ছিল না—তা দৃঢ় বাস্তবতায় পরিণত হয়েছিল।

প্রায় নয় মাস ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী স্থানীয় সহযোগীদের সহায়তায় নির্বিচারে নৃশংসতা চালিয়েছিল। তারা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, দুই লক্ষাধিক নারীকে ধর্ষণ করেছে, গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিশ্চিহ্ন করেছে।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট—'পোড়া মাটি নীতি'তে বাংলাদেশের সবুজ ভূখণ্ডকে রক্তে রঞ্জিত করা। নদীগুলো লাশ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, মাঠগুলো নিরপরাধ মানুষের রক্তে সিক্ত হয়েছে। মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল রাতের অন্ধকারে বুটের শব্দে।

ডিসেম্বরের প্রথম দিনগুলো থেকেই মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নতুন আত্মবিশ্বাসে এগোতে থাকেন। দখলকৃত রাজধানীর ভেতরেও তাদের উপস্থিতি অনুভূত হচ্ছিল।

অন্যদিকে, ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনী শহরের চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতে থাকে। ঢাকা হয়ে ওঠে সেই মঞ্চ, যেখানে চূড়ান্ত অঙ্কটি অভিনীত হতে চলেছে।
আকাশও কথা বলছিল।

মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো ঢাকার আকাশে গর্জে উঠছিল, তাদের হামলায় কেঁপে উঠছিল মাটি। আকাশ থেকে রায় ঘোষণার মতো ঝরে পড়ছিল লিফলেট—'সময় শেষ হওয়ার আগে অস্ত্র নামিয়ে রাখো।' রেডিওতেও একই বার্তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল শহর ও গ্রামে। 

পাকিস্তানিরা ভীত হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তান সরকারের হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ৭ ডিসেম্বর গভর্নর এ এম মালিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে একটি গোপন বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি লেখেন—

'বিশ্বশক্তির কাছ থেকে কেবল কথার সহানুভূতি বা সামান্য বস্তুগত সহায়তা—সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া—কোনো কাজে আসবে না। শেষটা যখন অবশ্যম্ভাবী, তখন এত বড় ত্যাগ কি সার্থক?'

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর আর কোনো সরকার কার্যকর ছিল না। ভারতীয় বিমানবাহিনী যখন শহরে বোমাবর্ষণ করে, তখন রাস্তাঘাট পরিষ্কার বা আহতদের দেখভালের জন্য কোনো নাগরিক সংস্থা ছিল না।

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান—যিনি ১৯৭১ সালে পূর্বাঞ্চলে দায়িত্বে ছিলেন—তার বই 'হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড'-এ লেখেন, ঢাকা তখন এক ভূতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছিল। অধিকাংশ সময় শহর ছিল কারফিউয়ের অধীনে। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার ভয়ে তখন পাকিস্তানপন্থি সবাই—পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তানি—আতঙ্কে ভেঙে পড়েছিল।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক ১৪ ডিসেম্বরের পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। ইয়াহিয়া খান গভর্নর মালিক ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজিকে একটি বার্তা পাঠান।

বার্তায় বলা হয়, 'আপনারা প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেছেন। জাতি আপনাদের নিয়ে গর্বিত, বিশ্ব আপনাদের প্রশংসায় মুখর। আমি সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজতে যা সম্ভব, তার সবটুকুই করেছি।'

'আপনারা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন, যেখানে আর প্রতিরোধ মানবিকভাবে সম্ভব নয় এবং তাতে কোনো ফলও আসবে না। এটি শুধু আরও জীবনহানি ডেকে আনবে। এখন আপনাদের উচিত যুদ্ধ বন্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সব সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জীবন রক্ষা করা।'

আত্মসমর্পণের জল্পনা যখন তুঙ্গে, ১৬ ডিসেম্বর সকালে মেজর জেনারেল গন্ধর্ব সিং নাগরা—যিনি অগ্রবর্তী কমান্ডো বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন—মিরপুর সেতুর ওপারে অবস্থান নেন এবং নিয়াজির উদ্দেশে একটি চিরকুট পাঠান।

তাতে লেখা ছিল, 'প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি মিরপুর ব্রিজে আছি। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।'

সকাল প্রায় ৯টার দিকে নিয়াজি যখন চিরকুটটি পান, তখন তার সঙ্গে ছিলেন মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল ফারমান ও রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ।

ফরমান—যিনি তখনও 'যুদ্ধবিরতি আলোচনা'র আশায় ছিলেন—প্রশ্ন করেন, 'উনি (নাগরা) কি আলোচক দল?'

নিয়াজি কোনো উত্তর দেননি।

প্রশ্নটা ছিল স্পষ্ট—নাগরাকে মেনে নেওয়া হবে, নাকি প্রতিরোধ করা হবে? তিনি ইতোমধ্যেই ঢাকার দোরগোড়ায়।

ফরমান আবার জিজ্ঞেস করেন, 'আপনার কি কোনো রিজার্ভ আছে?' নিয়াজি আবারও চুপ থাকেন।

রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ প্রশ্নটি পাঞ্জাবিতে অনুবাদ করে বলেন, 'কুজ পাল্লে হ্যায়?' (হাতের কাছে কিছু আছে?)

নিয়াজি তাকান জামশেদের দিকে—ঢাকার প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা। জামশেদ মাথা নাড়িয়ে জানান—কিছুই নেই।

'যদি তাই হয়, তাহলে উনি (নাগরা) যা বলছেন, তাই করুন,' ফরমান ও শরীফ প্রায় একসঙ্গে বলেন। এমনটাই সালিক তার বইতে লিখেছেন।

এরপর নিয়াজি জামশেদকে নাগরাকে অভ্যর্থনা জানাতে পাঠান এবং মিরপুর ব্রিজে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধবিরতি মানতে ও নাগরাকে নিরাপদে প্রবেশ করতে নির্দেশ দেন।

অল্প কয়েকজন সৈন্য নিয়ে ভারতীয় জেনারেল ঢাকায় প্রবেশ করেন, আর সঙ্গে ছিল অগাধ গর্ব। সেটিই ছিল ঢাকার কার্যত পতন।

সালিক লেখেন, শহরটি হৃদরোগীর মতো নীরবে ভেঙে পড়ে। তার অঙ্গচ্ছেদ হয়নি, শরীর ছিন্নভিন্ন হয়নি—সে কেবল একটি স্বাধীন শহর হিসেবে অস্তিত্ব হারায়।

এদিকে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের ট্যাকটিক্যাল সদর দপ্তর গুটিয়ে নেওয়া হয়। সব অপারেশনাল মানচিত্র সরিয়ে ফেলা হয়।

দুপুরের একটু পর ব্রিগেডিয়ার বাকার বিমানবন্দরে যান ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবকে অভ্যর্থনা জানাতে। এ সময় নিয়াজি নাগরাকে নিয়ে হাস্যরস করছিলেন—যার কোনোটিই ছাপার অযোগ্য!

এরপর জ্যাকব দুপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সদর দপ্তরে পৌঁছান আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা করতে। নিয়াজি তাকে অভ্যর্থনা জানান।

'কর্নেল এম এইচ খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে শোনান। কক্ষে নীরবতা নেমে আসে। নিয়াজির গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল, অন্যরা অস্থির হয়ে উঠেছিল,' জ্যাকব তার বই 'সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা ন্যাশন'-এ এভাবেই বর্ণনা দেন।

পাকিস্তানি কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, এটি হবে যুদ্ধবিরতি ও জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রত্যাহারের দলিল। ফারমান আলী ভারত ও বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণে আপত্তি জানান। নিয়াজি স্বীকার করেন, এটি ছিল নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।

জ্যাকব আশ্বস্ত করেন যে তাদের সম্মানের সঙ্গে বন্দি হিসেবে রাখা হবে, জেনেভা কনভেনশন কঠোরভাবে মানা হবে এবং সব জাতিগত সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

নিয়াজি দলিলটি অন্যদের পড়তে দেন। তারা কিছু সংশোধন চায়। জ্যাকব বলেন, 'শর্তগুলো ইতোমধ্যেই অত্যন্ত উদার'—এবং কক্ষ ত্যাগ করেন।

পরে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আলোচনা হয়। নিয়াজি চান এটি তার দপ্তরে হোক।

জ্যাকব জানান, অনুষ্ঠান হবে রমনা রেসকোর্সে—বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

তিনি মনে করেন, ঢাকার মানুষ—যারা এত ভোগান্তি সহ্য করেছে—তাদের সামনে প্রকাশ্য আত্মসমর্পণ হওয়াই উপযুক্ত।

নিয়াজি আপত্তি জানান।

জ্যাকব বলেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা গার্ড অব অনার গ্রহণ করবেন, তারপর দুজন দলিলে স্বাক্ষর করবেন। নিয়াজি তার তরবারি সমর্পণ করবেন।

নিয়াজি বলেন, তার তরবারি নেই। জ্যাকব বলেন, তাহলে পিস্তল সমর্পণ করবেন।

নিয়াজি অসন্তুষ্ট হলেও নীরব থাকেন। 'আমি এটাকেই সম্মতি হিসেবে ধরলাম,' জ্যাকব লেখেন।

'দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান'-এ নিয়াজি লেখেন, কিছু আলোচনা শেষে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা প্রস্তাব মেনে নেন। 'ব্যক্তিগতভাবে আমি ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত ছিলাম, কারণ প্রস্তাবটি বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা যথাযথভাবে উল্লেখ করেনি।'

এরপর নিয়াজি ঢাকায় বিমানবন্দরে যান অরোরাকে অভ্যর্থনা জানাতে।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানির অনুপস্থিতিতে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, উপ-প্রধান এ কে খন্দকার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।

এ কে খন্দকার তার লেখা '১৯৭১: ভেতরে বাইরে' বইতে লিখেছেন, 'আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যোগদানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর ড. ফারুক আজিজ খান এবং প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি লিয়াজোঁ অফিসার মেজর নূরুল ইসলাম আমাকে চারদিকে খুঁজতে শুরু করেন। এঁদের সঙ্গে আমার নিউ মার্কেটের কাছে দেখা হয়। তাঁরা আমাকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদানের বিষয়টি জানান।'

'তাঁরা আরও জানান যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ কে খন্দকারকে সরাসরি দমদম বিমানবন্দরে যেতে বলেছেন।'

'সে সময় আমার পরনে বেসামরিক পোশাক, অর্থাৎ একটা শার্ট আর সোয়েটার ছিল। আমি এগুলো বদলে সামরিক পোশাক পরারও সময় পেলাম না। এ অবস্থাতেই আমি দমদম বিমানবন্দরের দিকে রওনা হই।'

'সেখানে গিয়ে দেখি যে একটি সামরিক যাত্রীবাহী বিমান দাঁড়ানো আছে। আমি আমার সফরসঙ্গীদের বিদায় জানিয়ে টারমাকে দাঁড়িয়ে থাকা সামরিক বিমানে আরোহণের জন্য বিমানের দু-তিন সিঁড়ি ওঠার পর লক্ষ করলাম, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি জিপ বিমানের দিকে আসছে। জিপ থেকে নামছেন পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা ও তার স্ত্রী।'

খন্দকার জায়গা করে দিতে সরে দাঁড়ালে অরোরা তার পিঠে হাত রেখে মৃদু হাসি দিয়ে বলেন, 'আপনি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। আপনি আগে যাবেন।'

ঢাকায় পৌঁছে তারা একসঙ্গে জিপে করে রমনা রেসকোর্সে যান। 'রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, মানুষজন উৎফুল্ল—সবার মুখে হাসি এবং প্রশান্তির ছায়া।'

সেই মাঠেই নয় মাস আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন।

নিয়াজি অরোরাকে সামরিক সালাম দেন এবং করমর্দন করেন। 'এটি ছিল এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য। বিজয়ী ও পরাজিতরা দাঁড়িয়ে ছিলেন বাঙালিদের সামনে, যারা অরোরা ও নিয়াজির প্রতি যথাক্রমে তাদের গভীর ভালোবাসা ও ঘৃণার অনুভূতি প্রকাশে কোনো গোপনীয়তা রাখেননি,' সালিক লিখেছেন।

নতুন ইতিহাসের সূচনা আর স্বাধীন দেশের জন্মের মাহেন্দ্রক্ষণে মঞ্চ যেন প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সময়ের প্রবাহ থমকে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে—যেন পৃথিবী নিঃশ্বাস ধরে অপেক্ষা করছিল এক নতুন ভোরের আগমনের জন্য।

খন্দকার স্মরণ করেন, 'রমনার চারপাশে মানুষের ব্যাপক ভিড়। এমন পরিস্থিতিতে ভিড় ঠেলে আমরা উপস্থিত হলাম রমনা ময়দানের সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে। ভিড়ে অতিথিদের দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন ছিল।'

'আমি, ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান রিয়াল এডমিরাল এস এম নন্দা ও পূর্বাঞ্চল বিমানবাহিনীর কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর পাশেই ছিলেন পূর্বাঞ্চল সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল এফ আর জ্যাকব। আমি জেনারেল অরোরার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।'

'অনুষ্ঠানটি ছিল অনাড়ম্বর এবং এটি অল্প সময়ে শেষ হয়।'

'অনুষ্ঠানে মাত্র দুটি চেয়ার আর একটি টেবিল ছিল। একটি চেয়ারে জেনারেল নিয়াজি ও অন্যটিতে জেনারেল অরোরা বসলেন। ৫টা ১ মিনিটে নিয়াজি প্রথমে দলিলে স্বাক্ষর করেন, তারপর অরোরা।'

'স্বাক্ষরের জন্য নিয়াজিকে কলম এগিয়ে দেন অরোরা। প্রথম দফায় কলমটি দিয়ে লেখা যাচ্ছিল না। অরোরা কলমটি নিয়ে কিছু ঝাড়াঝাড়ি করে পুনরায় নিয়াজিকে দেন। এ দফায় কলমটি আর অসুবিধা করেনি।'

'পরে জেনেছি, ওই দিন শুধু আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার জন্যই অরোরা কলকাতা থেকে কলমটি কিনে এনেছিলেন। স্বাক্ষর শেষ হলে উভয়েই উঠে দাঁড়ান। তারপর আত্মসমর্পণের রীতি অনুযায়ী জেনারেল নিয়াজি নিজের রিভলবারটি কাঁপা কাঁপা হাতে অত্যন্ত বিষণ্ণতার সঙ্গে জেনারেল অরোরার কাছে হস্তান্তর করেন।'

নিয়াজি নিজেই বলেন, কাঁপা হাতে তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন—চোখে জমে উঠেছিল হতাশার অশ্রু। একজন ফরাসি সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেন, 'টাইগার, কেমন লাগছে?' নিয়াজি উত্তর দেন, 'হতাশ।'

সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে, যার মধ্য দিয়ে ২৪ বছরের নিপীড়নের অবসান ঘটে।

এ কে খন্দকার লিখেছেন, 'আত্মসমর্পণের পর ঢাকায় নয় মাস ধরে অবরুদ্ধ থাকা জনতা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে; কয়েকজন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আমরা কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না। আবেগে সবাই বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর অনেকে বলল, 'আহ! আজ থেকে আমরা শান্তিতে, নির্ভয়ে ঘুমাতে পারব।'

সালিক লেখেন, যখন নিয়াজি তার রিভলভার অরোরার হাতে তুলে দেন, 'তার সঙ্গে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকেও তুলে দিয়েছিলেন।'