জুলাই সনদের ঘাটতি ও সুস্থ রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় ছোট দলগুলোর করণীয়

সাইফুর রহমান
সাইফুর রহমান
28 November 2025, 11:39 AM
UPDATED 28 November 2025, 18:28 PM

একটি সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে প্রায়ই এমন হয় যে সোজা পথটি চোখে পড়ে না। জুলাই সনদে নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় সরকারসহ দেশের নানা সমস্যার সমাধানে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অতীতের প্রতিটি সংস্কার উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল তার কোনো উল্লেখ সেখানে নেই। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট পুটনাম বলেছেন, 'কেবল প্রতিষ্ঠানই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে পারে না; গণতন্ত্র টিকে থাকে নাগরিক সংস্কৃতির ওপর।' তার উল্লেখ কোথায় এই জুলাই সনদে?

পুটনামের বক্তব্যের সারমর্ম হলো—প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নাগরিক নজরদারি না থাকলে সেগুলো স্বৈরাচারী চরিত্র ধারণ করে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে জবাবদিহির আওতায় রাখা সম্ভব কেবল তখনই, যখন জনগণ নিজ দায়িত্বে সে ভূমিকা পালন করে। নাগরিকেরা যত বেশি সচেতন ও দায়িত্বশীল হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তত বেশি জবাবদিহিমূলক হবে—সমীকরণটি অত্যন্ত সহজ ও সরলরৈখিক। জুলাই সনদে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব থাকলেও, কীভাবে দেশের মানুষকে সত্যিকার নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যাবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

জুলাই সনদের মূল উদ্দেশ্য হলো—ভবিষ্যতে যেন দেশে আর কোনো স্বৈরাচারী শাসনের পুনরুত্থান না ঘটে। এ লক্ষ্যেই সনদে এমন বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে স্বৈরাচারের পুনরাবৃত্তি কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সনদটি যদি গণভোটে অনুমোদন পায়, তাহলে এর বাস্তবায়নের পক্ষে শক্তিশালী গণইচ্ছার প্রতিফলনও ঘটবে। এর পরও কোনো নির্বাচিত সরকার যদি সেগুলো বাস্তবায়ন না করে, তখন কী হবে? যদি তারা সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অথবা একটি পাতানো গণভোটের মাধ্যমে সনদের অঙ্গীকারগুলো বাতিল করে দেয়, তার প্রতিকারই বা কী?

অনেকে আশাবাদ ব্যক্ত করেন— 'ক্ষমতাসীন দল যদি জুলাই সনদে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তাহলে ছাত্রজনতা পুনরায় রাস্তায় নেমে তাদের উৎখাত করবে।' কিন্তু বাস্তবতা হলো— গণঅভ্যুত্থান বারবার ঘটে না; একবার জনতার মনোবল ভেঙে গেলে সেটি পুনরুজ্জীবিত হতে দীর্ঘ সময় লাগে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, এরপর ১৯৮২ থেকে ১৯৯১, এবং সর্বশেষ ২০২৪—প্রত্যেক গণআন্দোলনের মধ্যবর্তী সময়ে কেটেছে এক দীর্ঘ বিরতি।

স্বৈরাচারের পুনরাবৃত্তি থেকে একটি সমাজকে রক্ষা করতে পারে কেবল সমাজের প্রতিটি স্তরে সক্রিয় নাগরিকদের উপস্থিতি। অর্থাৎ, যারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবগত। তারা সঠিকভাবে ভোট দিতে পারে, সঠিক নেতা নির্বাচন করতে পারে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ জানাতে পারে। যে সমাজে সচেতন নাগরিকদের উপস্থিতি যত বেশি, স্বৈরাচারের জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা সেখানে তত কম—এটাই উন্নত বিশ্বে গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহির মূল চাবিকাঠি।

দেশের সাক্ষরতার হার বেড়েছে, কিন্তু সে হারে রাজনৈতিক ও সামাজিক জ্ঞান বাড়েনি। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক যথার্থই মন্তব্য করেছেন— 'জুলাই সনদে যা লেখা হয়েছে, দেশের ২০ শতাংশ মানুষও তা বুঝবে না।' বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন—কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ, বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে রাজনীতি এখন আর বিদ্যমান নেই; যা আছে, তা মূলত ব্যক্তিপূজা, দলাদলি ও দালালি। যে জিনিস বাস্তবে অনুপস্থিত, তা মানুষের চেতনায় বা উপলব্ধিতে স্থান পাওয়া সম্ভব নয়।

দেশে নাগরিক শিক্ষার প্রক্রিয়া যত দ্রুত শুরু হবে, দেশ তত দ্রুত রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হতে থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দেবে কে? যেহেতু এটি একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, তাই এর মূল দায়িত্ব রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। বড় দলগুলো, যারা ক্ষমতায় একচেটিয়া আধিপত্যের জন্য লালায়িত, তাদের এ বিষয়ে আন্তরিক আগ্রহ থাকবে না—কারণ এটি তাদের স্বার্থের পরিপন্থী। হীরক রাজা বলতেন: 'এরা (জনগণ) যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে।'

যেসব দল আকারে ছোট এবং দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠার পূর্বে যাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা নেই—এই গুরুদায়িত্ব নিতে হবে তাদেরই। দেশের মানুষকে সচেতন করার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ হলেও, রাজনৈতিক স্থবিরতা থেকে বেরিয়ে আসার এটাই একমাত্র পথ। বড় দলগুলোর দালালি করা বা তাদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করার মধ্যে রাজনৈতিক নীতিবোধ, মর্যাদা কিংবা অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের কোনো উপাদান নেই।

যেসব দেশে নাগরিক শিক্ষা কার্যক্রম শক্তিশালী, সেখানে দুর্নীতি তুলনামূলকভাবে কম, ভোটারদের অংশগ্রহণ বেশি এবং শাসনব্যবস্থা স্থিতিশীল—যেমন নর্ডিক দেশসমূহে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে নাগরিক শিক্ষা বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক জ্ঞান এবং সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশের শিক্ষা দেওয়া হয়। জার্মানিতে নাগরিক শিক্ষা শুধু বিদ্যালয় পর্যায়েই নয়, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও চালু রয়েছে, যাতে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে নাগরিকেরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় থাকতে পারেন।

১৯৯৬–৯৭ সালে বাংলাদেশে ব্র্যাকের নেতৃত্বে 'লোকাল ডেমোক্রেসি এডুকেশন প্রোগ্রাম' নামে একটি ভোটার শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। এই কর্মসূচির আওতাধীন এলাকাগুলোর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো—সেই নির্বাচনে প্রায় ৪৩ শতাংশ নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন সৎ ও যোগ্য প্রার্থী—বর্তমানে এ সংখ্যাটি প্রায় শূন্যের কোঠায়। স্থানীয় জনগণ সেই নির্বাচনকে ইতিহাসের অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য ও স্মরণীয় নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করেন।

ভোটার শিক্ষাদান কর্মসূচির মেয়াদ ছিল এক বছরেরও কম এবং এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল ১২টি জেলায়। অন্তর্বর্তী সরকার যে সময় হাতে পেয়েছিল, সেই সময়ে তারা অনায়াসেই এ ধরনের একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারত। এতে সরকারের জনসম্পৃক্ততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেত। ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও এত উদ্বেগ থাকত না—কারণ তখন ভোটাররাই প্রহরীর ভূমিকা পালন করত।

বাংলাদেশে সার্বজনীন সাক্ষরতার অভিযানের মতো একটি ব্যাপক নাগরিক শিক্ষা কর্মসূচি আরম্ভ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই শিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে নাগরিকদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা, পাশাপাশি শাসনব্যবস্থা, ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে সমালোচনামূলক চিন্তা গড়ে তোলা। এ ধরনের কর্মসূচি বিদ্যালয়-কলেজের আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমে সংযোজন করা যেতে পারে, আবার অনানুষ্ঠানিকভাবেও পরিচালিত হতে পারে—যেমন কমিউনিটি কার্যক্রম, গণমাধ্যম প্রচার, নাগরিক কর্মশালা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে।

ছোট দলগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থের অভাব। গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রচারের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী বহু সংস্থা আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। তাদের দ্বারস্থ হয়ে দলগুলো সম্পূর্ণ আইনসম্মত উপায়ে নাগরিক শিক্ষা কর্মসূচির জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে পারে। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও দেশে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হোক—তা আন্তরিকভাবে কামনা করে; তারাও হতে পারে তহবিলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

অনেক দেশেই রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান আছে, যেখান থেকে তাদের তহবিলের একটি বড় অংশ আসে। নতুন দলগুলোকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, তাই তাদেরও দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী নিজস্ব আয়ের উৎস খুঁজতে হবে।

ছোট পরিসরে আরম্ভ করতে হবে—লক্ষ্য হবে এক বা দুটি উপজেলায় কার্যক্রম সীমিত রেখে সেগুলোকে মডেল উপজেলায় পরিণত করা। সেখানে প্রত্যেক নাগরিক হবেন রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সচেতন; কেউ ভোট বিক্রি করবে না, তারা সৎ ও যোগ্য মানুষকে নির্বাচিত করবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে আওয়াজ তুলবে এবং প্রয়োজনে শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। কয়েকটি উপজেলায় যদি এ ধরনের সাফল্য অর্জিত হয়, তবে তা জ্যামিতিক হারে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না। কারণ, এ ধরনের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বহুদিন ধরে প্রতিটি মানুষই তার হৃদয়ে ধারণ করে আছে।

শেষ করতে চাই অর্থনীতির একটি সূত্র উল্লেখ করে—'ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই রুল।' যে জিনিসের জোগান নেই কিন্তু চাহিদা অনেক, তার মূল্য অনেক। বর্তমানে দেশে যে জিনিসটির সবচেয়ে বেশি অভাব, তা হলো সুস্থ রাজনীতি—যে রাজনৈতিক দল এটি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবে, তাদের চাহিদা হবে আকাশচুম্বী—দেরিতে হলেও জয় তাদের হবে অবশ্যম্ভাবী।

সাইফুর রহমান: সিনিয়র তথ্য প্রযুক্তিবিদ