মন্দায় বেড়েছে দারিদ্র্য, আরও ২০ লাখ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও টালমাটাল পরিস্থিতিতে পড়েছিল। এখন আবারও ওই সময়ের মতো তীব্র অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে—এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
গতকাল মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত 'বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫' প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়। দেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতার করুণ চিত্র তুলে ধরে সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, জিনি সহগ বা সমৃদ্ধির ফাঁক, যা দিয়েই অর্থনীতিকে মাপা হোক না কেন, বৈষম্য আরও বাড়ছে।
২০২৩ সালের পর থেকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি শতকরা ৬ থেকে কমে চলতি বছর প্রায় ৪–এ নেমে এসেছে।
এর ফলে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২০২৪ সালের ২০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ২১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগের বছর ২০২৪ সালে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে। এটি দেখায় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে আর আগের মতো সুরক্ষা দিতে পারছে না দেশের অর্থনীতি।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, 'সাম্প্রতিক আয় কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দুটোই আরও খারাপের দিকে যাবে।'
কয়েক বছর আগে থেকেই পরিস্থিতির অবনতি শুরু হয়। তখন দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছিল, তবে সেই তুলনায় তার সুফল সবাই সমানভাবে পাচ্ছিল না। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষদের ক্ষেত্রে সেই প্রবৃদ্ধি খুব কমই ভূমিকা রাখছিল।
২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অর্থনীতি বড় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা দরিদ্র্যদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে খুব বেশি কাজে লাগেনি। অর্থনীতি ১ শতাংশ বাড়লে বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমেছে মাত্র ০ দশমিক ৯ শতাংশ। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার গড় হিসেবে একই প্রবৃদ্ধিতে দারিদ্র্য কমেছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বাড়ার বড় কারণ হলো মানুষের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা। বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, মানুষের বাস্তব আয় ও চাকরি কমেছে। এসব কারণে যারা দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে ছিল, এমন ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ এখন খুবই অনিশ্চিত অবস্থায় আছে। তারা ঠিকমতো খরচ চালাতে পারছে না, সঞ্চয় খুব কম আর সরকারের সামাজিক সুরক্ষাও যথেষ্ট নয়।
চাকরির সুযোগ কমায় শ্রম আয়ও কমে গেছে। বিশেষ করে কম দক্ষ শ্রমিকদের আয় বাড়েনি, স্থির হয়ে আছে। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ২০ লাখ মানুষের চাকরি হারিয়েছে এবং ২০২৫ সালে আরও ৮ লাখ চাকরি কমার আশঙ্কা রয়েছে। এই সংকটে নারী ও তরুণরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটান–বিষয়ক বিভাগীয় পরিচালক জ্যাঁ পেসমে বলেছেন, আগের মতো করে কাজ চালালে দারিদ্র্য কমবে না। দারিদ্র্য কমানোর সবচেয়ে দ্রুত এবং কার্যকর উপায় হলো নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা। বিশেষ করে তরুণ, নারী এবং ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের জন্য।
২০১৬ সাল থেকে যে কাঠামোগত পরিবর্তন শুরু হয়েছিল, এবারের অর্থনৈতিক মন্দা সেটাকে আরও খারাপ করে তুলেছে। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গ্রামে কৃষিখাতে কাজ বেড়েছিল। তাই এই সময়ে গ্রামই দারিদ্র্য কমানোর ব্যাপারে মূল ভূমিকা রাখে।
এই সময়ে গ্রামে দারিদ্র্য কমেছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ, শহরে কমেছে মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। তাই গ্রাম–শহরের দারিদ্র্যের ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।
তবে এই পরিবর্তন পুরোপুরি ইতিবাচক ছিল না। কারণ, নতুন কর্মসংস্থানের বেশির ভাগই কম উৎপাদনশীল খাতে তৈরি হয়েছে, যেখানে আয় কম এবং কাজের মানও দুর্বল। আর দারিদ্র্য কমাতে শ্রম আয়ের যে ভূমিকা আগে খুব বেশি ছিল, তা অনেক কমে গেছে।
শ্রম আয়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসের অবদান ২০১০–২০১৬ সালে যেখানে ছিল ৮৯ শতাংশ, ২০১৬–২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৫১ শতাংশে।
শ্রমবাজার
শ্রমবাজার থেকে কিছুটা সরে গেলেও অধিক সংখ্যক তরুণী এখন শিক্ষায় মন দিয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী মেয়েদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩১ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছেছে।
তবে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের শিক্ষায় অগ্রগতি জাতীয় গড়ের তুলনায় ধীরগতির হয়েছে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী দরিদ্র মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাগত লিঙ্গবৈষম্য ২০১৬ সালে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১৪ দশমিক ৪ শতাংশে চলে গেছে।
শিক্ষায় বিনিয়োগ করলেও শহরে নতুন চাকরির সুযোগ বাড়েনি। জাতীয় নগর বেকারত্বের হার কম দেখালেও প্রকৃতপক্ষে তরুণ ও শিক্ষিত মানুষরা কাজ পেতে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।
গতকালের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, 'আমাদের এক ধরনের বিপরীতমুখী বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষা মানবসম্পদে রূপান্তরিত হচ্ছে না। এই মূল সমস্যার সমাধান না হলে 'দশ হাজার চাকরি দেওয়ার কর্মসূচি' বরং অদক্ষতাকেই আরও বাড়াবে। আমাদের বুঝতে হবে কেন শিক্ষা উৎপাদনশীলতায় রূপান্তরিত হচ্ছে না।'
২০১৬ থেকে ২০২২ সালে জাতীয় বেকারত্ব কমলেও তরুণ নারীদের প্রায় ৫ ভাগ এখনও বেকার। একই সময়ে তরুণ পুরুষদের বেকারত্ব ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, এর একটি কারণ—শিক্ষা ব্যবস্থায় যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদার মিল নেই।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যদি সত্যিই উৎপাদনশীলতা এবং চাকরির ক্ষেত্র বাড়াতে চাই, আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশকে আঞ্চলিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সংযোগে আরও সহযোগিতা বাড়াতে হবে।'
চাকরির সুযোগ কমার কারণে অনেক মানুষ, বিশেষ করে নারীরা পুরোপুরি শ্রমবাজার থেকে সরে গেছে। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে নেমে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশে এসেছে। এই সময়ে কাজের বয়সী ৩০ লাখ মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, যার মধ্যে ২৪ লাখ নারী।
এর আগে প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০২২ সালে গ্রামে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ ৫৯ দশমিক ১ থেকে ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশে বেড়েছে। কিন্তু শহরে একই সময়ে তা ৫৬ দশমিক ৪ থেকে নেমে ৫১ দশমিক ১ শতাংশে এসেছে। যদিও শহরে কাজের চাহিদা বেশি এবং মজুরি তুলনামূলকভাবে ভালো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, গ্রামে অনেক নারী বিনা পারিশ্রমিকে পরিবারের কাজে যুক্ত থাকেন বা খুব বিশেষ ধরনের অনানুষ্ঠানিক কাজ করেন। তাই শুধু চাকরির সংখ্যা নয়, চাকরির মানও খুব গুরুত্বপূর্ণ।'
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মহাপরিচালক এ. কে. এনামুল হক বলেন, 'বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা এখন জরুরি। চাকরি সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য সরাসরি যুক্ত। ব্যাংকিং খাতকে সুস্থ না করলে অর্থনীতি ভালোভাবে বাড়বে না। দরিদ্রতা কমাতে সরকারের বিনিয়োগও প্রয়োজন, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলকে শহরের সঙ্গে যুক্ত করতে।'