আজও হারিয়ে যায়নি ‘জিংগা’র শাফাত আলীর অমর সুর

মাহমুদ নেওয়াজ জয়
মাহমুদ নেওয়াজ জয়
3 December 2025, 12:47 PM

১৯৬৩ সালের কথা। চট্টগ্রামের কয়েকজন যুবক সেদিনও বসেছেন আড্ডায়। তরুণ এই বন্ধুদের ভেতর একজন ছিলেন শাফাত আলী। তার মাথায় তখন ঘুরছিল নানা ধরনের গান নিয়ে কাজ করার চিন্তা। শুধু শাস্ত্রীয় সংগীত নয়, তিনি চেয়েছিলেন বাংলা গানে পপ, জ্যাজ, রক, ব্লুজ ইত্যাদি ঘরানা নিয়ে কাজ করতে।

এজন্য তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠন করে ফেলেছিলেন একটি গানের দল। তবে তখনো নাম ঠিক হয়নি। তার বন্ধু আহমেদ ফারুক পরামর্শ দিলেন—ব্যান্ডের নাম হোক 'জিংগা'। তবে ব্যান্ড কথাটি সরাসরি ব্যবহার শাফাত করেননি। তিনি এটিকে শিল্পীগোষ্ঠী বলতেই আগ্রহী ছিলেন।

'জিংগা' শব্দটি স্প্যানিশ; এর মূল শব্দ 'জিংগারো', যা মূলত জিপসিদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। শাফাত আলীর কাছে এই নামটি পছন্দ হয়। জিপসিদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা থাকে না, তারা বিচরণ করে গোটা দুনিয়াজুড়ে। ঠিক তেমনি শাফাতও চেয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন ধরনের গানের ছোঁয়া নিয়ে বাংলা ভাষায় কাজ করতে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক অনুপ্রেরণা ছিল সলিল চৌধুরীর গানগুলো।

১৯৬৬ সালে তার বোন নাজমা জামানের কণ্ঠে 'তোমারি জীবনে এলো কি আজি বুঝি' গানটি বিটিভিতে (তৎকালীন পিটিভি) প্রচারিত হলে চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। শাফাত, নাজমা, শেহলা—এই তিন ভাই-বোনই মূলত 'জিংগা'র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরবর্তীতে শাফাত আলীর স্ত্রী নিঘাত আলীও এর সঙ্গে যুক্ত হন।

জিংগা সেসময়ই তাদের গানে গিটার, অ্যাকোর্ডিয়ান, কিবোর্ড, ড্রাম ইত্যাদি ব্যবহার করতে শুরু করে। তাদের মাধ্যমে বাংলা গানে পপ ও জ্যাজের সূচনা ঘটে।

সত্তর দশকে জিংগার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সংগীতশিল্পী কাদেরী কিবরিয়া (বর্তমানে প্রবাসী) এবং লিনু বিল্লাহ। এছাড়াও লাকী আখন্দ, ফোয়াদ নাসের বাবু, শেখ ইসতিয়াকের মতো শিল্পীরাও তাদের সঙ্গে কাজ করেছেন।

সত্তর দশক থেকে 'জিংগা' মূলত পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়েই এগিয়ে যায়। এ সময় 'দূরালাপনি দ্বারা হইল নব পরিচয়', 'কে বলে ওই যে চাঁদ', 'আজ কী রান্না করি', 'সাংবাদিক', 'জিংগা শিল্পীগোষ্ঠী থিম সং' ইত্যাদি গান তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এই সময় বনি এম, বিগিস, অ্যাবা-র মতো আন্তর্জাতিক ব্যান্ডগুলোর সঙ্গে তাদের তুলনা হতো।

১৯৮০ সালে গণভবনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সম্মানার্থে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে জিংগা গান পরিবেশন করে। তাদের ওই পরিবেশনা ভূয়সী প্রশংসা পায়।

নাজমা জামানের গায়কীতে ও শব্দের উচ্চারণে পশ্চিমা ধাঁচ ছিল। তিনি পেশায় ছিলেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষিকা। তবে গানের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য ধাঁচ থাকলেও উচ্চারণে কোনো বিকৃতি বা ডিস্টর্শন ছিল না।

আশির দশকে জিংগা বিভিন্ন ধরনের গান করে নিজেদের শক্ত উপস্থিতি জানান। ১৯৮২ সালে শাফাত আলীর কথা ও সুরে নাজমা জামান 'ঢাকা' গানটি করেন। ঢাকা শহরকে এত সুন্দরভাবে খুব কম গানই তুলে ধরেছে। সেই ঢাকা আজকের মতো এত জনবহুল, এত দূষণে ভারাক্রান্ত ছিল না। জাদুর শহর বলে পরিচিত সেই ঢাকা জীবন্ত হয়ে উঠেছিল জিংগার গানে।

নাজমা জামানের পারফরমেন্সের বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গান গাইতেন না। গানের কথার সঙ্গে হাত নাড়ানো, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি, হালকা নাচ—এর মাধ্যমে তার পরিবেশনা শোনার মতোই দেখার ক্ষেত্রেও উপভোগ্য হয়ে উঠত। 

জিংগা এ সময় 'মিশ মাহদুম' নামে আরবি গান করে। এছাড়াও শিশুদের জন্য 'আলীবাবা' ও 'ব্যাটম্যান' নিয়েও গান করে। গানগুলোর সজ্জা ও পরিবেশনার ধরন ছিল সেই সময়ের হিসেবে অভিনব।

শাফাত আলী নিজেও এ সময় বিভিন্ন গান করেন। ১৯৮৩ সালে 'পাখি হয়ে এসেছিলে' গানটি করেন। চমৎকার মেলোডিয়াস এই গানে ছিল পশ্চিমা ক্ল্যাসিকাল মেলোডির প্রয়োগ। এই গানের সুরটি পুরোনো দিনের আধুনিক বাংলা গানের মতো। শাফাত আলীর একক গানগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পায়।

তিনি ১৯৮৬ সালে 'নামিবে বাদল' গানটিতে ইলেকট্রিক গিটার ব্যবহার করেন। এ ছাড়াও নিজের কথা ও সুরে তারই গাওয়া 'আমার ছোট্ট ভাই' গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়। এটি তিনি করেছিলেন ছোটদের ফুটবল খেলার আগ্রহ নিয়ে, ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের সময়।

এ ছাড়াও স্ত্রী নিঘাত আলীর সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছেন—'রূপালি ছোঁয়া লেগেছে' (আশির দশকে) ও 'সঞ্চিত রেখেছি এতদিন ধরে' (সত্তর দশকে)। শেষোক্ত গানটি ছিল 'ডোন্ট ক্রাই জনি' গানের সুর থেকে করা বাংলা ভার্সন। এ সময় পপের বাইরেও তিনি পশ্চিমা মেলোডিয়াস সুরের প্রতি বেশ মনোযোগী হয়ে ওঠেন।

নাজমা জামান ও শেহলা জামানের ডুয়েট 'পথিক আমি ফিরি একাকী' ছিল মেলোডিয়াস আধুনিক বাংলা গান, সঙ্গে ছিল রবীন্দ্র সুরের ছোঁয়া। নিঘাত আলীর একক গান 'কী করি, ভেবে মরি' (১৯৯০) কথার দিক থেকে অনেকটা সলিল চৌধুরীর লেখা গানের কথার মতো ছন্দময় এবং সুরটি ছিল পশ্চিমা ক্ল্যাসিকাল ধাঁচের।

এ সময় বিভিন্ন দেশে নিজেদের বানানো মিউজিক ভিডিও নিয়েও প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় জিংগা। ১৯৯০ সালে লুক্সেমবার্গে বিভিন্ন দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত মিউজিক ভিডিও কনটেস্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে জিংগা।

'তোমারি জীবনে এলো কি আজি' গানটিই ড্রাম ও গিটারের সমন্বয়ে সে সময়ের ব্যান্ডগুলোর মতো করে রক ধাঁচে পরিবেশন করে জিংগা। ভিডিও নির্মাণেও শাফাত আলী চমক দেখান। ভিডিওর মধ্যে তিনি ক্লিপ মার্জ করে জিংগার অতীত কিছু পরিবেশনার অংশবিশেষও জুড়ে দেন।

শাফাত আলী প্রচণ্ড সফল ছিলেন অডিও প্রযোজক হিসেবেও। তার রেকর্ডিং লেবেলের নাম ছিল 'ইপসা'। এখান থেকে আশির দশকে লাকী আখন্দ, হ্যাপি আখন্দ, কুমার বিশ্বজিৎ—প্রমুখের রেকর্ড বেরিয়েছিল। এ ছাড়াও বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেল ও কণ্ঠদানের কাজও হতো ইপসায়, যা তার কাকরাইলের বাসাতেই সম্পন্ন হতো।

১৯৮৯ সালে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কথা ও লাকী আখন্দের সুরে নাজমা জামানের 'চেয়েছি চলে যেতে' গানটি প্রযোজনা করে জিংগা।

১৯৯০ সালের পর নাজমা জামান আমেরিকা প্রবাসী হলে জিংগা আগের তুলনায় গতি হারায়। এই সময়ে অন্য অনেক ব্যান্ড ও রেকর্ডিং লেবেল উঠে আসে। জিংগাকে ১৯৯০ সালের পর আর আগের মতো পাওয়া যায়নি।

১৯৯৭ সালের ২০ জুন শাফাত আলী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে শেষ হয় জিংগার এই গৌরবময় পথচলা। তার দুই ছেলে, একমাত্র মেয়ে ও স্ত্রী—সবাই বর্তমানে আমেরিকাপ্রবাসী। বড় ছেলে শায়ান আলী শিকাগোতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জিংগাকে আবার সচল করেছেন। তার শিশুকন্যাও এখন তাদের সঙ্গে গান গাইছেন। 'দ্য জিংগা' (The Zinga)  নামে তাদের ইউটিউব চ্যানেলে গানগুলো আপলোড করা হয়।

তবুও দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশীয় সংগীতে এতগুলো ব্যান্ডের অগ্রদূত যে জিংগা—তাদের নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি কখনোই।

১৯৪২ সালের ৩ ডিসেম্বর জন্মেছিলেন শাফাত আলী। বেঁচে থাকলে আজ ৮৩ বছর পূর্ণ করতেন তিনি। তার বোন নাজমা জামান এ ব্যাপারে প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, 'আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর কোনো জায়গায়, কোনো অনুষ্ঠানে কেউ তাকে নিয়ে একটা কথাও বললেন না। এই দুঃখ আমার কোনোদিনই যাবে না।' (দ্রষ্টব্য: সেই 'জিংগা'র নাজমা জামান: কবির বকুল)

শাফাত আলী ছিলেন স্বাধীনচেতা মানুষ। তিনি নিজের মতো কাজ করেছিলেন উদার মন নিয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাদের গানই জিংগাকে বাঁচিয়ে রাখবে। সুরকার হিসেবে অনন্য শাফাত আলী চমৎকার অ্যাকোর্ডিয়ান বাজাতেন। গানের মেলোডি ও রিদমের অসাধারণ সমন্বয় ঘটত তার কম্পোজিশনে। এসব কাজই তাকে ও জিংগাকে বাংলা পপ গানে পথিকৃতের মর্যাদা দিয়েছে। নিজস্ব প্রত্যয় নিয়ে তিনি নিজের লেখা ও সুর করা এক গানে যেমনটি  বলেছিলেন—'আমার গানেরও সুর হারিয়ে যাবে না, আমি চলে গেলে দূর, দূর, বহুদূর।'