বুড়িগঙ্গায় দেখা মিলল ডলফিনের, নদীর স্বাস্থ্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী
সময় সকাল ৭টা। বসিলায় নদী তীরবর্তী ওয়াকওয়েতে রোজ দিনকার মতো প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছি। বুড়িগঙ্গার মাঝ নদীতে হঠাৎই ছোট্ট একটি লাফ। তার কিছুক্ষণ পর পানিতে আলোড়ন তৈরি করে আরেকটি লাফ।
চোখ কচলে উঠলাম। প্রথমে ডলফিনই মনে হলো। কিন্তু পরক্ষণেই আপন মনে হাসলাম। বুড়িগঙ্গার এই দূষিত পানিতে মাছই যেখানে নেই, সেখানে থাকবে ডলফিন! এও কি হতে পারে। কয়েক মিনিট পানির দিকে নজর রাখতেই দেখলাম আবার লাফিয়ে উঠল প্রাণীটি। এবার নিশ্চিত হলাম ডলফিনই বটে!
স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে কথা বললে তারাও জানান, বসিলার বুড়িগঙ্গা নদীতে তারা দুটি ডলফিন দেখেছেন। এছাড়া তুরাগেও ডলফিন দেখেছেন তারা।
বাসিলার স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দাও জানান, গত কয়েক বছর ধরেই বুড়িগঙ্গায় ডলফিনের আনাগোনা দেখছেন তারা।
ঢাকায় বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ মিলিত হয়েছে মোহাম্মদপুরের বসিলাতেই। বুড়িগঙ্গার মিলন হয়েছে ধলেশ্বরীর সঙ্গে। এই নদীর পানি গড়িয়েছে মেঘনায়।
কিন্তু বুড়িগঙ্গার দূষিত পানিতে ডলফিন কীভাবে বাস করছে! কৌতূহল বাড়তে থাকে। জানতে চাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজের কাছে।
তিনি বলেন, 'আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বংশী নদীতে এখনো বেশ কয়েকটি মিঠাপানির ডলফিন বা গাঙ্গেয় শুশুক টিকে আছে। বিশেষত বুড়িগঙ্গায় যে ডলফিন রয়েছে তা মোহাম্মদপুরের বসিলা অংশেই থাকে। আমরা ওখানে তিনটি ডলফিনের দেখা পেয়েছি। তবে বুড়িগঙ্গার এই পানিতে কীভাবে ডলফিন টিকে রয়েছে তা কিছুটা বিস্ময়কর। কারণ এই নদীতে মাছ নেই বললেই চলে।'
ড. আজিজ আরও বলেন, 'আমার ধারণা ডলফিন এখন সাকার মাছও খাচ্ছে। নয়তো এরা টিকে থাকবে কী করে! যেভাবেই হোক তারা এখন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে।'
তিনি জানান, বুড়িগঙ্গার অন্য স্থানগুলোতে দূষণ বেশী হলেও বসিলায় সে তুলনায় দূষণ কম। এখানে মানুষের নদী মুখী ব্যস্ততাও কম।
ডলফিন মূলত নদীর এমন জায়গা থাকে যে জায়গাটি নিরপদ্রুপ। যেখানে মানুষের চলাচল বেশি ডলফিন সেখানে থাকতে চায় না। তারা শান্ত পরিবেশ পছন্দ করে। মজার বিষয় হলো বুড়িগঙ্গায় শীতকালে ডলফিনের দেখা পাওয়া অনেকটা ভাগ্যের বিষয়। কারণ এ সময় বুড়িগঙ্গা ও তুরাগে পানি কমে যাওয়ায় দূষণ বাড়ে। মাছও পাওয়া যায় না।
ড. আজিজ আরও বলেন, 'তবে কোনো নদীর পানি কতোটুকু ভালো রয়েছে তা বোঝার উপায় হলো ডলফিন রয়েছে কি না। এক্ষেত্রে ডলফিনকে আমরা প্যারামিটার বা সূচক ধরতে পারি।'
ঢাকার নদীগুলোতে ডলফিনের সংখ্যা কত
২০২৪-২৫ সালে বন অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস) দেশে মিঠাপানির ডলফিন বা গাঙ্গেয় শুশুক নিয়ে জরিপ চালায়। গত অক্টোবর মাসে আন্তর্জাতিক মিঠাপানির ডলফিন দিবস উপলক্ষে এই জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়।
জরিপে ফলাফলে বলা হয়, দেশের ৪৫টি নদী ও সুন্দরবনের জলপথ মিলিয়ে মোট ৪ হাজার ৮৯৩ কিলোমিটার জলপথ জুড়ে ২ হাজার ৩০৭টি ডলফিন খুঁজে পেয়েছেন ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির গবেষকেরা।
ঢাকার নদীগুলোতে ডলফিনের সংখ্যা কতো জানতে চাইলে ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'আমাদের গবেষক দল বুড়িগঙ্গা নদীতে ৩টি ও তুরাগ নদীতে ৫টি ডলফিন চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া বংশী নদীতেও আমরা ৭টি ডলফিন খুঁজে পেয়েছি। বুড়িগঙ্গায় যে তিনটি ডলফিন পাওয়া গেছে তা বসিলাতেই দেখা মিলেছে।'
বসিলা এলাকায় ডলফিন থাকার বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'বসিলায় দুটি নদী মিলিত হওয়ায় এখানে কিছুটা পানির ঘূর্ণি রয়েছে। এখানে ডলফিন থাকতে পছন্দ করে। এমন না যে এরা শুধু বসিলাতেই থাকে। এরা ঘুরে বেড়ায়। দুটি নদীর মিলন স্থলে স্রোত তৈরি হয়। অন্যান্য জায়গার চেয়ে ওখানে মাছ বেশী পাওয়া যায়। তাই অনায়াসে মাছ শিকার করতে পারে ডলফিন। এছাড়া পানির বাড়তি প্রবাহ থাকায় ডলফিনের ভেসে থাকাও সহজ হয়। নদীতে যেখানে স্রোত বেশি সেখানেই ডলফিন থাকতে পছন্দ করে।'
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, 'ডলফিন পানিতে থাকলেও ফুসফুসের সাহায্যে বাতাস থেকে শ্বাস নেয়। তাই ঢাকায় নদীর দূষিত পানির মধ্যেও কোনক্রমে তারা টিকে আছে।'
তবে ঢাকার আশপাশে ডলফিন কতদিন টিকে থাকতে পারবে এ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, 'দূষণের কারণে ঢাকার নদীগুলোর মাছ নেই বললেই চলে। এখন যা আছে প্রায় সবই সাকার মাছ। সেটি হোক বুড়িগঙ্গা, তুরাগ বা বংশী। আমি নিজেও ডলফিনকে মুখে সাকার মাছ নিয়ে ভেসে উঠতে দেখেছি।'
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, 'ঢাকার নদ-নদীগুলোতে দুই দশক আগেও নিয়মিত ডলফিনের দেখা মিলত।'
বুড়িগঙ্গায় ডলফিনের হারানো সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে কী করতে হবে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'বুড়িগঙ্গায় দূষণ সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রথমে নদী দূষণ রোধ করতে হবে। এখানে নৌযানের সংখ্যাও এখন অত্যধিক। বিশেষ করে বালুবাহী নৌযান। এগুলো ডলফিনের স্বাভাবিক চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে।'
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, 'বুড়িগঙ্গায় ডলফিনের সংখ্যা বাড়াতে হলে প্রথমে নদীকে ডলফিনের বসবাসের অনুকূল অবস্থায় আনতে হবে। নদী দূষণের পাশাপাশি নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে বুড়িগঙ্গায় ডলফিনের হারানো সুদিন ফিরবে। এক্ষেত্রে সকল কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।'
