ডিজিটাল যুগের নতুন যে বাস্তবতায় আমরা

নাদিয়া রহমান
নাদিয়া রহমান
10 December 2025, 13:47 PM

আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন, ফেসবুকে কারও সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার পরই সেই বিষয়ের বিজ্ঞাপন আপনার টাইমলাইনে দেখা যায়? আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম, 'এ তো কাকতালীয়!' কিন্তু এমন কাকতালীয় ঘটনা যখন বারবার ঘটতে লাগল, তখন বুঝলাম আমাদের প্রতিটি ক্লিক, লাইক, শেয়ার এমনকি কোনো পোস্ট পড়া, সবই যেন কারও নজরের মধ্যে। ডিজিটাল যুগে আমরা যতটা স্বাধীন ভাবি, বাস্তবে কিন্তু সেই স্বাধীনতার ওপর অদৃশ্য এক নজরদারি সবটা সময়েই কাজ করে। আর সবচেয়ে বড় নজরদারির জায়গা হলো সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক।

ফেসবুক আমাদের প্রতিটি ক্লিক, লাইক, রিঅ্যাকশন, স্ক্রল, সবকিছু মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। আমরা কোন পোস্টে কোন রিঅ্যাক্ট দেই, কোন বিষয়ে তর্ক করি, কোন ধরনের ভিডিও বেশি দেখি—এসব তথ্যের ভিত্তিতেই অ্যালগরিদম আমাদের একটি ডিজিটাল পরিচয় তৈরি করে। আপনি নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন, এই পরিচয়ের ভিত্তিতেই আমরা কোন বিজ্ঞাপন দেখব, কোন খবর বেশি পাব, এমনকি কোন রাজনৈতিক মতের প্রতি আকৃষ্ট হব, সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়! প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কি আদৌ বুঝি, আমাদের সিদ্ধান্তে কতটা আমরা, আর কতটা অ্যালগরিদম?

ফেসবুক নজরদারির বিষয়টি অনেকেই খারাপ বলে মনে করেন। যদিও সত্য হলো, এটা পুরোপুরি খারাপ বা পুরোপুরি ভালো—কোনোটিই নয়। ধরুন, আপনি বই পড়তে ভালোবাসেন, তাই ফেসবুক আপনাকে বই সংক্রান্ত পেজ বা বিজ্ঞাপন দেখাবে। এতে সুবিধাও আছে! আপনার আগ্রহের জিনিস সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু মূল সমস্যা হয় তখনই, যখন এই তথ্যগুলো শুধু আপনার আগ্রহ বোঝার জন্য নয়, বরং আপনার আচরণকে প্রভাবিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। আপনি না চাইতেই এমন কিছু কনটেন্ট দেখবেন, যা খুব সূক্ষ্মভাবে আপনার চিন্তাকে বদলাচ্ছে, এখানেই আসে প্রকৃত ঝুঁকি।

আরেকটা প্রশ্ন, আমাদের ব্যক্তিগত কথোপকথন কি নিরাপদ? অনেকেই মনে করেন মেসেঞ্জারে কথা বললে সেগুলো সম্পূর্ণ গোপন থাকে। বাস্তবে, সব কথোপকথন 'এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড' নয়। আর এনক্রিপশন না থাকলে প্ল্যাটফর্ম চাইলে সেই কথোপকথন বিশ্লেষণ করতে পারে, অন্তত তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা নিতে পারে। আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আমরা যে ছবিগুলো আপলোড করি, যেগুলো পরে মুছে ফেলি, সেগুলো সত্যিই পুরোপুরি মুছে যায় কি না? গবেষণা বলে, এসব তথ্য অনেক সময় সার্ভারে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত থাকে।

তবে সবকিছুর পরেও প্রশ্ন, এই নজরদারি কি আমরা বন্ধ করতে চাই? হয়তো আমরা গোপনীয়তা চাই। কিন্তু আবার সুবিধাও চাই। দৈনন্দিন জীবনে আমরা নিজেরাই ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করি, কোথায় যাচ্ছি, কী খাচ্ছি, কার সঙ্গে দেখা করছি, সব! সমাজে নিজের অস্তিত্ব জানানোর ক্ষেত্রে আমাদের চাওয়াটাই যেন আমাদের নজরদারির দিকে ঠেলে দেয়। অনেকটা নিজের ঘরের দরজা খুলে রেখে পরে প্রশ্ন তোলার মতো, 'কেউ দেখল কীভাবে?'

তারপরও সচেতন থাকা জরুরি। ফেসবুকের প্রাইভেসি সেটিংস পরিবর্তন করা, অযথা লোকেশন অন না রাখা, অতিরিক্ত ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার না করা—এসব ছোট কাজ আমাদের তথ্যকে অনেকটাই সুরক্ষিত রাখতে পারে। কারণ ডিজিটাল যুগের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হলো, সচেতনতা।

শেষ পর্যন্ত ফেসবুক নজরদারি মানে শুধু প্রযুক্তিগত কোনো সমস্যা নয়; বরং আমাদের অভ্যাস, আমাদের পছন্দ, আমাদের প্রয়োজন সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি বাস্তবতা। আজকে আপনি যেটায় লাইক দিচ্ছেন, সেটাই হয়তো আগামী দিনে আপনার সম্পর্কে একটা 'ধারণা' তৈরি করছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজ নয়।

তবে আমাদের প্রতিদিনের অনলাইন জীবনকে যদি আমরা একটু ভেবে দেখি, তাহলে হয়তো বুঝতে পারব, আমাদের জীবনের কতটুকু এখন সত্যিই নিজেদের হাতে, আর কতটুকু অ্যালগরিদমের নিয়ন্ত্রণে। ডিজিটাল যুগে আমরা যত বেশি সচেতন হবো, তত বেশি নিজের গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারব। আর প্রশ্ন তো থেকেই যায়, নজরদারি কি সত্যিই এড়ানো যায়, নাকি আমরা শুধু তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখছি?