শিখরা কেন চুল বড় রাখে

শবনম জাবীন চৌধুরী
15 December 2025, 11:27 AM
UPDATED 15 December 2025, 17:35 PM

রাস্তায় চলার পথে কখনো হয়তো মাথায় পাগড়ি পরা কিছু মানুষ আপনার চোখে পড়েছে। সেই পাগড়ির ভেতরে যত্নসহকারে গুছিয়ে রাখা থাকে তাদের লম্বা চুল। হ্যাঁ, শিখ ধর্মাবলম্বীদের কথাই বলছি। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসে, তারা কেন চুল কাটে না? কেন চুল এত লম্বা রাখে?

এই প্রশ্ন শুধু আপনার বা আমার নয়। শিখ ধর্মের প্রায় প্রত্যেক অনুসারীই হয়তো জীবনে অন্তত একবার হলেও এর মুখোমুখি হয়েছেন। সেই কৌতূহল থেকেই চলুন আজ জানার চেষ্টা করি— শিখরা কেন চুল বড় রাখে।

শিখরা কেন চুল দীর্ঘ রাখেন তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত এবং গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো—তাদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় নিয়মের প্রতি আনুগত্য। এই বিষয়েও নানা ধরনের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

পরিচয়ের প্রতীক

কেশ, অর্থাৎ মাথার চুল না কেটে লম্বা রাখা শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি তাদের দৈনন্দিন চেহারার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে কাজ করে এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে সহজেই আলাদা করে চিহ্নিত করে।

গুরুরা, অর্থাৎ শিখ ধর্মের পথপ্রদর্শক, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার অংশ হিসেবে শিখদের মাথার চুল না কেটে লম্বা রাখার পরামর্শ দেন। শিখরা গুরুর আদেশকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে চলেন এবং এটি তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অনুশাসনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

লম্বা চুল রাখার মাধ্যমে শিখরা গুরুর শিক্ষা ও জীবনদর্শনের প্রতি সম্মান প্রকাশ করেন। এছাড়া, শিখদের বিশ্বাস—এই লম্বা চুল তাদেরকে গুরুর শিষ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা তাদের জন্য পরম আরাধ্য ও আত্মিক গৌরবের প্রতীক।

গুরুর আদেশ

চুল অক্ষত রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ১৬৯৯ সালে গুরু গোবিন্দ সিংয়ের দেওয়া নির্দেশ। তিনি শিখ ধর্মানুসারীদের '৫ কে' মেনে চলার পরামর্শ দেন, যা শিখ পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে কেশ (চুল অক্ষত রাখা বা না কাটা চুল) অন্যতম। তৎকালীন বিভিন্ন নথিপত্রে এই আদেশের উল্লেখ পাওয়া যায়।

ত্রিলোচন সিং তার বই 'দ্য টারবান অ্যান্ড দ্য সোর্ড অব দ্য শিখস'-এ উল্লেখ করেছেন, গুরুর প্রতিচ্ছবি ধারণের উদ্দেশ্যে শিখরা তাদের চুল লম্বা রাখেন। এর মাধ্যমে তারা গুরুদের সঙ্গে একটি অদৃশ্য আধ্যাত্মিক সংযোগ অনুভব করেন এবং তাদের জীবন ও শিক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন।

আধ্যাত্মিকতা

প্রাচীন ভারতের ঋষি ও মনীষীরা লম্বা চুল এবং দাড়ি গিঁট বেঁধে রাখতেন। গুরু গোবিন্দ সিং চাইতেন যে শিখরা সংসারী হলেও আধ্যাত্মিক জীবন ও সাধনার দিকে মনোনিবেশ রাখুক। কেশ, অর্থাৎ চুল অক্ষত রাখা পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে গণ্য হয় এবং শিখদের বিশ্বাস অনুযায়ী একজন শিখের মাথা গুরুর জন্য উৎসর্গিত। বলা হয়ে থাকে, যেমন সত্যকে পরিবর্তন বা লুকানো যায় না, তেমনি কেশও তার প্রকৃত রূপে অক্ষত থাকে। কেশ সব গুরুর প্রতি শিখদের নিষ্ঠা ও ভক্তির চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।

ঐতিহ্যের ধারক

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, শিখরা বহু প্রাচীনকাল থেকে লম্বা চুল রাখার প্রথা বজায় রেখেছে। আজকের দিনে এই প্রথা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে তারা কেবল তাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে সযত্নে ধারণ করছে না, বরং এটি তাদের জন্য একটি শক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবেও কাজ করছে।

স্বতন্ত্রতা

অনেক শিখ চুল না কেটে লম্বা রাখেন, যাতে তারা জাগতিক ফ্যাশন ও বাইরের প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারেন। এটি তাদের সমাজের প্রচলিত ধারা থেকে স্বতন্ত্র করে এবং একইসঙ্গে গুরুদের জীবনদর্শন ও শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

নিয়মিত চুল ধোয়া ও আঁচড়ানোর মাধ্যমে তারা আত্ম-শৃঙ্খলার চর্চা করেন, যা শিখ ধর্মের একটি মূলনীতি। এ ছাড়া, চুল অক্ষত রাখার মাধ্যমে তারা সাহস অর্জন করেন, ভয়কে জয় করেন এবং তাদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এটি মনকে দ্বিধামুক্ত রাখে, অন্তরের শান্তি প্রদান করে এবং ওয়াহেগুরুর সৃষ্টি হিসেবে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে গ্রহণের সুযোগ করে দেয়।

সমষ্টিগত অগ্রগতি

লম্বা চুল শিখদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন বৈশিষ্ট্য। পাগড়ি ও লম্বা চুল শিখদের মধ্যে সমমর্যাদা ও ঐক্যের বার্তা বহন করে। এটি কেবল ব্যক্তিগত আচরণে প্রভাব ফেলে না, বরং নৈতিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং গুরুর প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা দৃঢ় করে। একইসঙ্গে এটি শিখ সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়।