মন কষাকষি না করেই সম্পর্কে আর্থিক বিষয়ে কথা বলবেন যেভাবে

By রেহনুমা শাহরীন
5 November 2025, 11:36 AM
UPDATED 5 November 2025, 17:49 PM

সম্পর্কের শুরুতে টাকা খরচের বিষয়টা মুখ্য না হলেও ধীরে ধীরে এটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা করে নেয়। কখনো ডিনারের খরচ, কখনো ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আবার কখনো রিকশা নেবো নাকি রাইড শেয়ার বুক করবো—এসব সময়ে টাকা খরচের বিষয়টি চলে আসে। প্রথমে খুব একটা চোখে না পড়লেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খরচের বিষয়টি যেকোনো সম্পর্কেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

'আর্থিক সামঞ্জস্য' কথাটি শুনতে যদিও বিয়ের আগের কাউন্সেলিং বুকলেটের মতো লাগে, কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা অনেক সহজ। উপার্জন, খরচ, সঞ্চয় আর স্বপ্নের পথে চলা—এগুলো নিয়ে দুজনের মতামতে ভিন্নতা আছে কি না, তা জানা জরুরি। একই পরিমাণ আয় করা কিংবা সবকিছুতে নিজেদের পছন্দের মিল থাকা আবশ্যক নয়। কিন্তু যদি একজন মনে করেন, জীবনটা খুব ছোট, তাই শুক্রবার রাতে একটু খরচ করে আনন্দ করতেই হবে, আর অন্যজন বিশ্বাস করেন, অতিরিক্ত টাকার প্রতিটা পয়সাই সঞ্চয়ে রাখা উচিত, তাহলে সামনে পথটা কিছুটা কঠিন হতে পারে।

এই বিষয়ে আলোচনা কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ টাকা শুধু টাকা নয়। এটি মূল্যবোধ, নিরাপত্তা, বিশ্বাস, আর কখনো কখনো গর্বের প্রতীক। দুইজন মানুষ খোলাখুলি টাকা খরচের বিষয় নিয়ে কথা বলার মাধ্যমে আসলে তাদের কোন জিনিসগুলো সবচেয়ে প্রিয়, তারা কী নিয়ে ভয় পায়, আর ভবিষ্যৎকে কীভাবে দেখতে চায়—এই বিষয়গুলো নিয়ে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করে।

তাই অতিরিক্ত খরচ নিয়ে হওয়া ঝগড়া কখনো শুধু শপিং বিলের হিসাবের জন্য নয়। একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, এর ভেতরে থাকে আরও বড় প্রশ্ন। উভয় পক্ষ একে অপরের কথা শুনছে কি না ও এই সম্পর্কে একে অপরের প্রতি সম্মান বজায় আছে কি না এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি একরকম কি না—এই আলোচনাগুলো উঠে আসে।

সামঞ্জস্য মানে এই নয় যে একজনকে হুবহু আরেকজনের প্রতিচ্ছবি হতে হবে। বরং এর অর্থ হলো—দুজনের জীবনযাপন কোনো সংঘাত ছাড়া চলতে পারে। যোগাযোগ অবশ্যই জরুরি, আর ঠিক তেমনই জরুরি সেই যোগাযোগের সঠিক সময়।

ডেটের তৃতীয় দিনে হুট করে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করা যায় না, 'তাহলে বলো, তোমার ক্রেডিট স্কোর কেমন?' শুরুতে কথাগুলো হালকাভাবে শুরু হতে পারে। যেমন: উইকএন্ড কীভাবে কাটাতে পছন্দ করো, ভ্রমণে তুমি লাক্সারিয়াসভাবে থাকো নাকি বাজেট-সাশ্রয়ীভাবে। ধীরে ধীরে সম্পর্ক গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নগুলোও গভীর হতে পারে। যেমন: তুমি সঞ্চয় কীভাবে সামলাও? ঋণ সম্পর্কে তোমার ভাবনা কী? পাঁচ বছর পরে তুমি নিজের জীবনকে কোথায় দেখতে চাও? এভাবে সময়ের সঙ্গে বোঝা যায় অপরজনের সঙ্গে আপনার পথচলা আদৌ সম্ভব কি না।

আমরা কখন কথা বলছি সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কীভাবে বলছি সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। টাকা নিয়ে কথা বলা আসলে জেরা করা নয়, এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা। বিচার বা জিজ্ঞাসাবাদের ভঙ্গিতে না বলে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করুন। যেমন: 'তুমি গ্যাজেটে এত নষ্ট করো কেন?'—এ ধরনের প্রশ্ন না করে 'নতুন গ্যাজেট কেনার সময় কোন ব্যাপারটি তোমার বেশি ভালো লাগে?'—এ ধরনের প্রশ্ন করুন। এভাবে আপনি তার সিদ্ধান্তের পেছনের গল্প জানতে পারবেন।

খরচ করার অভ্যাস খুব সহজেই দেখায় দু'জনের জীবনধারা ঠিক কতটা মেলে। আপনি যদি প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে জমকালো ডিনারে যেতে পছন্দ করেন আর আপনার সঙ্গী বাড়িতে ভাত-ডাল রান্না করতে পছন্দ করেন, তাহলেই আপনার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে না। এই মুহূর্তে সম্পর্কে প্রবেশ করে 'সমঝোতা'।

খরচ করার অভ্যাস খুব সহজেই দেখায় দু'জনের জীবনধারা কতটা মেলে। কিন্তু সঞ্চয় নিয়ে অনেক সময় মতবিরোধ দেখা যায়। কারও কাছে সঞ্চয় মানে নিরাপত্তা, কারও কাছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আবার কারও কাছে কোনো গুরুত্বই নেই।

তারপর আসে আরও বড় বড় বিষয়। বাড়ি ভাড়া, বিয়ে, সন্তান, ভ্রমণ, এমনকি বৃদ্ধ বয়সের নিশ্চয়তা। সামঞ্জস্য মানে সব বিষয়ে একমত হওয়া নয়। এর অর্থ বাড়িতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না করে শান্তিপূর্ণ আলোচনা করতে পারা।

আপনি যেন সহজে বলতে পারেন—'আমি চাই আমাদের ভবিষ্যতের জন্য কিছুটা সঞ্চয় থাকুক'। আর আপনার সঙ্গী যেন বলতে পারে, 'আমি চাই জীবনটা যেন শুধু হিসাব করতে করতে না কেটে যায়'। দুটো অনুভূতিই সত্য, দুটোই গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সম্পর্কে দু'টারই জায়গা হওয়া উচিত।

আসলে আর্থিক সামঞ্জস্য মানে ধনী হওয়া বা অতি মিতব্যয়ী হওয়া নয়। এর মূল কথা হলো স্পষ্ট ও খোলামেলা থাকা। আপনার সঙ্গী কোনটাতে নিরাপত্তা অনুভব করেন—একটি স্থায়ী আমানতে, নাকি হঠাৎ প্ল্যান করা একটি ভ্রমণের টিকিটে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। এবং আপনি যেন নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, 'এটাই আমার সামর্থ্য, এটাই আমার ইচ্ছে, আর আমি আমাদের এইভাবেই একসঙ্গে এগোতে দেখি।'

অর্থ সবসময় সম্পর্কের সঙ্গে থেকে যায়। কখনো অকারণে চাপ তৈরি করা নিঃশব্দ অতিথির মতো, আবার কখনো শান্ত বন্ধুর মতো, যা দু'জনকে ভারসাম্যে রাখে। তবে মানিব্যাগের আকার এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং আপনারা যেকোনো বিষয় নিয়ে সৎ ও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন কি না, সেটাই মুখ্য। কারণ একবার যদি অর্থ নিয়ে সত্যি বোঝাপড়া তৈরি হয়, এর মানে হলো আসলে আপনারা আলোচনা করছেন পাশাপাশি, একই পথ ধরে কীভাবে একসঙ্গে জীবনটা কাটাতে চান তা নিয়ে।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম