‘প্রাক-অ্যান্টিবায়োটিক যুগ’ ফিরে আসতে পারে আবার

By ড. মুনীরউদ্দীন আহমদ
30 November 2025, 05:30 AM
UPDATED 30 November 2025, 11:39 AM

যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় গত ১৩ অক্টোবরের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, 'বিশ্বজুড়ে হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সংক্রমণ বাড়ছে'। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে যেসব সংক্রমণ একসময় সহজে নিরাময় করা যেত, এখন আর সেসবে কাজ হচ্ছে না। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, আগামী বছরগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে সাধারণ সংক্রমণের চিকিৎসাও কঠিন হয়ে পড়বে।

২০২৩ সালের একটি বৈশ্বিক সমীক্ষা অনুযায়ী, পরীক্ষাগারে নিশ্চিত হওয়া প্রতি ছয়টির সংক্রমণের মধ্যে একটি এখন অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী। রক্ত, অন্ত্র, মূত্রনালি এবং প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণের প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ই. কোলাই এবং সালমোনেলার মতো 'গ্রাম-নেগেটিভ' ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের হার ৭০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। আর এটা ঘটলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কয়েক দশকের অগ্রগতি উল্টে যেতে পারে।

এই সংকট অবশ্য নতুন নয়। ২০১৭ সালেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছিল, 'বিশ্বের অ্যান্টিবায়োটিক ভান্ডার ফুরিয়ে আসছে।' যক্ষ্মাসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছিল, নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বাজারে থাকা অধিকাংশ অ্যান্টিবায়োটিক মূলত পুরোনো ওষুধেরই সামান্য পরিবর্তিত সংস্করণ—যা সাময়িক স্বস্তি দিলেও স্থায়ী সমাধান দিচ্ছে না। ব্যাকটেরিয়া যত দ্রুত নিজের ধরন পাল্টাচ্ছে (মিউটেশন), এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আসছে না। নতুন ওষুধ না এলে ছোটখাটো অস্ত্রোপচারও সংক্রমণের কারণে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

বর্তমানে সবচেয়ে বিপজ্জনক জীবাণুগুলোর মধ্যে রয়েছে 'ই-কোলাই' এবং যক্ষ্মার জীবাণু 'মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস'। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১২টি ব্যাকটেরিয়াকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছে, যেগুলো 'মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট' বা একাধিক ওষুধ প্রতিরোধী। এর মধ্যে নিউমোনিয়া ও হাসপাতালে সৃষ্ট সংক্রমণের জন্য দায়ী জীবাণুও রয়েছে। এসবের অনেকগুলোর বিরুদ্ধেই এখন আর কোনো কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক অবশিষ্ট নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় বর্তমানে ৫১টি অ্যান্টিবায়োটিক উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। তবে এর মধ্যে মাত্র আটটি ক্লিনিক্যাল বা চিকিৎসাক্ষেত্রে কার্যকর অবদান রাখতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মা, 'ক্লেবসিয়েলা নিউমোনি' বা 'ই-কোলাই'-এর মতো প্রাণঘাতী সংক্রমণের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের হাতে এখন খুব সামান্য বা বলতে গেলে দেওয়ার মতো কোনো ওষুধই অবশিষ্ট নেই। এসব 'সুপারবাগ' বা শক্তিশালী জীবাণু প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

ডব্লিউএইচও-এর অ্যাসেনশিয়াল মেডিসিন বিভাগের পরিচালক ডা. সুজান হিল অ্যান্টিবায়োটিক গবেষণায় জরুরি বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'প্রাণঘাতী জীবাণুদের বিরুদ্ধে মানুষের হাতে আত্মরক্ষার প্রায় কোনো ঢালই আর অবশিষ্ট নেই।'

বিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী 'ল্যানসেট'-এ প্রকাশিত 'অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: নিড ফর আ গ্লোবাল সলিউশন' শীর্ষক নিবন্ধে ২৬ জন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তারা বলছেন, আগামী দুই-তিন দশকের মধ্যে মানবজাতি হয়তো 'প্রাক-অ্যান্টিবায়োটিক যুগে' ফিরে যাবে। তখন সাধারণ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণেও গণহারে মানুষের মৃত্যু হবে এবং সাধারণ অস্ত্রোপচারও অসম্ভব হয়ে পড়বে।

একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করতে কোটি কোটি ডলার খরচ হয়, অথচ এর বিপরীতে মুনাফা খুবই সামান্য। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ রোগীকে আজীবন খেতে হয়, কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয় মাত্র কয়েক দিনের জন্য। এ ছাড়া নতুন অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে আসার দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ফলে ওষুধের বাণিজ্যিক গুরুত্ব কমে যায়। এসব কারণে বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো অ্যান্টিবায়োটিক গবেষণা থেকে সরে আসছে।

এই প্রেক্ষাপটে ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর পালিত হলো বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) সচেতনতা সপ্তাহ ২০২৫। এবারের প্রতিপাদ্য—'এখনই কাজ করুন: আমাদের বর্তমান রক্ষা করুন, ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করুন'। এএমআর কেবল ভবিষ্যতের হুমকি নয়, বরং এটি বর্তমানের এক সংকট—যা বিশ্বজুড়ে মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে।

লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।