বিহারিদের সহযোগিতায় সৈয়দপুরে চলে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ

আহমাদ ইশতিয়াক
আহমাদ ইশতিয়াক
14 December 2025, 04:45 AM
UPDATED 14 December 2025, 12:47 PM

'রাত তখন ১০টা। প্রতিদিনের মতো বাবা খেতে বসেছিলেন। এমন সময় আমার ভাই এসে বলল, আমাদের পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেছে মিলিটারি। সবার মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু বাবা যেন প্রস্তুতই ছিলেন। ওরা যখন বলল, "আপনাকে আমাদের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে যেতে হবে"—তিনি নিঃশব্দে নেমে গেলেন। সেটিই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।'

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. জিকরুল হকের শেষ স্মৃতির কথা স্মরণ করতে গিয়ে এই কথাগুলো বললেন তার ছেলে মজিবুল হক। তিনি আরও বলেন, 'বাবাকে জিপে তোলার সময় পেছনে বসা বিহারি নেতা ইউসুফ বাটকে দেখতে পেয়েছিলাম। বুঝতে বাকি ছিল না কারা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে এসেছে।'

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবাঙালি বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা সৈয়দপুরের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জিকরুল হককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। কেবল তাকেই নয়, একই দিন বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয় সৈয়দপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ডা. বদিউজ্জামান, দানবীর ও ব্যবসায়ী তুলসিরাম আগরওয়ালা ও তার ছেলে রামেশ্বর লাল আগরওয়ালাকেও।

এই চার বুদ্ধিজীবীকে তুলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে সৈয়দপুর শহরকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করার নীলনকশার বাস্তবায়ন শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী।

২৫ থেকে ৩১ মার্চের মধ্যে বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা রাজনীতিবিদ ও চিকিৎসক ডা. শামসুল হক, শিক্ষানুরাগী ও দানবীর যমুনা প্রসাদ কেডিয়া, হরিহর প্রসাদ, ডা. ইয়াকুব আলী, ব্যবসায়ী হরিরাম সিংহানিয়া, নাট্যাভিনেতা আমিনুল হক, ব্যবসায়ী বেনারসী লালা গুপ্ত, রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আয়েজ উদ্দিন, আশরাফ আলী, আবেদ আলীসহ সৈয়দপুর শহরের অন্তত ২০ জন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীকে নিজ বাড়ি থেকে তুলে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। টানা ১২-২০ দিন পৈশাচিক নির্যাতনের পর ১২ এপ্রিল রংপুর ক্যান্টনমেন্টের পার্শ্ববর্তী বালারখাইল বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।

সৈয়দপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, দানবীর, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, নাট্যকর্মী, রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ।

সৈয়দপুরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে একাধিক গ্রন্থে। এর মধ্যে আহম্মেদ শরীফের লেখা 'বালারখাইল গণহত্যা', মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাকের 'উত্তরের গণহত্যা ১৯৭১' গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।

সৈয়দপুর ও রংপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজন, প্রত্যক্ষদর্শী, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের সঙ্গে কথা বলে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের এক ভয়াবহ বর্ণনা উঠে আসে।

উল্লিখিত গ্রন্থসূত্র, ইতিহাসবিদ, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সৈয়দপুরের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকেই সৈয়দপুর ছিল উত্তরবঙ্গের অগ্রসর জনপদগুলোর একটি। শিক্ষা, প্রগতি, সাংস্কৃতিক দিক ছাড়াও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও সৈয়দপুর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। চাকরি ও ব্যবসার সুবাদে ব্রিটিশ আমল থেকেই বাঙালিদের পাশাপাশি সৈয়দপুরে বিহারি ও মাড়োয়ারিরাও বসতি স্থাপন করে।

দেশভাগের পর সৈয়দপুরে বাঙালি ও মাড়োয়ারিদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও উভয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিহারিদের শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ষাটের দশক থেকেই সৈয়দপুরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরোধপূর্ণ ছিল। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর এটা তীব্র আকার ধারণ করে।

মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. জিকরুল হককে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় সৈয়দপুর থানা সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। এ সময় ডা. জিকরুল হকের জেয়ারতউল্লাহ মেডিকেল হল সংগ্রাম কমিটির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়া দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে নানামুখী আলোচনার জন্য সৈয়দপুর শহরের বুদ্ধিজীবীরা ঐতিহ্যবাহী 'শিল্প সাহিত্য সংসদে' একত্রিত হতেন।

১৬ মার্চ সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা জেয়ারতউল্লাহ মেডিকেল হলে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২১ মার্চ সৈয়দপুরের জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুর রউফ গাড়িতে মানচিত্রখচিত পতাকা লাগিয়ে সৈয়দপুরে এলে অবাঙালি তরুণেরা পতাকা ছিঁড়ে ফেলে।

২৩ মার্চ শহরের বিভিন্ন স্থানে বাঙালিরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলে বিহারিদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। শহরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে এদিন বিকেল ৪টায় সৈয়দপুর উচ্চবিদ্যালয়ে জিকরুল হকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বক্তব্য দিলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। বিহারিরা এদিন বেশ কয়েকজন বাঙালিকে হত্যা করে।

একপর্যায়ে বিহারিরা জিকরুল হককে হত্যা করেছে এমন গুজব গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়লে বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ মার্চ ভোর থেকে হাজার হাজার বাঙালি সৈয়দপুর শহরে এসে জড়ো হয়। একপর্যায়ে জিকরুল হক জনতার সামনে হাজির হলে গুজবের অসারতা প্রমাণিত হয়। তবে ততক্ষণে বিহারিদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিহারিরা তখন 'বাঙালি লোগ হাম লোগকো মারনে আয়া' স্লোগানে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বহু বাঙালিকে হত্যা করে। চিরিরবন্দর থেকে কয়েক হাজার গ্রামবাসীকে নিয়ে আসা বুদ্ধিজীবী মাহাতাব বেগকে এদিন পাশবিক কায়দায় হত্যা করে বিহারিরা। এর পর থেকে সৈয়দপুরের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

২৫ মার্চ সকাল থেকে বিহারিরা অস্ত্রশস্ত্রসহ বাঙালিদের দেখামাত্র গুলি চালানো শুরু করে। পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিদের গুলিতে বহু বাঙালি শহীদ হন। একপর্যায়ে রাতে কারফিউ ঘোষণা করে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা।

সৈয়দপুরে বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা যেভাবে হয়েছিল

'বালারখাইল গণহত্যা' গ্রন্থসূত্র এবং সৈয়দপুর শহরের প্রবীণ বাসিন্দা, মুক্তিযোদ্ধা ও গণহত্যা গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে সৈয়দপুর কলেজে বিহারি নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন সৈয়দপুর কায়েদে আজম কলেজের (বর্তমানে সৈয়দপুর কলেজ) অধ্যক্ষ মতিন হাশমী। সভায় উপস্থিত ছিলেন অবাঙালি ইজহার আহমেদ, কাইয়ুম খান, ইউসুফ বাট, শামসুদ্দিন কাদেরী, ওয়াসিমুল হক, সেলিম খান, মোজাহেরুল ইসলামসহ শীর্ষস্থানীয় বিহারি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। একাধিক বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে বিহারিরা চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা করে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে পাঠায়।

২৫ মার্চ রাতে চার বুদ্ধিজীবীকে আটকের পর ২৭ মার্চ পাকিস্তানিরা সৈয়দপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও চিকিৎসক ডা. শামসুল হককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।

শামসুল হকের ছেলে লিয়াকত হোসেন বলেন, 'বিহারিরা ফটক ভেঙে বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। ২৫ মার্চের পর থেকেই বাবাসহ সৈয়দপুরের বুদ্ধিজীবীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। রাস্তায় বিহারিদের সশস্ত্র পাহারা ছিল। কেউ পালানোর চেষ্টা করলে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।'

একই দিন পাকিস্তানি সেনারা ন্যাপের সৈয়দপুর থানা কমিটির সভাপতি ও চিকিৎসক এস এম ইয়াকুবকে তুলে নিয়ে যায়। তার মেয়ে ইফফাত জামান বলেন, 'বাবাকে যখন ওরা তুলে নিতে এল, তখন তিনি গোসল করছিলেন। তাকে গা মোছার সুযোগটুকু পর্যন্ত দেয়নি।'

সর্বশেষ ১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আয়েজ উদ্দিনকে আটক করে ক্যান্টনমেন্টে তুলে নিয়ে যায়। ২৩ মার্চ নিজ বাড়িতে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন আয়েজ উদ্দিন।

তার ছেলে সাংবাদিক এম আর আলম ঝন্টু বলেন, '৩১ মার্চ সারা রাত যুদ্ধ হয়েছিল। ১ এপ্রিল ভোর তিনটার সময় দরজায় সেনাদের বুটের লাথির আওয়াজ শুনতে পাই। বাবা দরজা খুলতেই পাকিস্তানিরা তার বুকে সজোরে লাথি মারে।' তিনি আরও বলেন, 'বাবা তখন উঠতেই সেনারা রাইফেলের বাট দিয়ে তাকে পেটাতে পেটাতে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যায়।'

আটককৃত এই বুদ্ধিজীবীদের রাখা হয়েছিল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের কোয়ার্টার গার্ডে। বন্দী বুদ্ধিজীবীদের ওপর চালানো হয়েছিল চরম পৈশাচিক নির্যাতন।

প্রত্যক্ষদর্শী কমলাপ্রসাদের বর্ণনায় জানা যায়, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে বন্দীদের ২ ঘণ্টা চাবুক দিয়ে পেটাত পাকিস্তানি সেনারা। মারের চোটে বন্দীদের হাত-পা ভেঙে গিয়েছিল। পেটাতে পেটাতে ডা. জিকরুল হকের কাছে পাকিস্তানি সেনারা জানতে চাইত, 'বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সর্বশেষ কী কথা হয়েছিল।' কিন্তু তিনি না বলায় সেনারা ডা. হককে পিটিয়ে খোঁড়া করে দিয়েছিল। নির্যাতনে সবাই যখন অতিষ্ঠ হয়ে হাল ছেড়ে দিত, তখনই ডা. হক বলতেন, 'আজ আমাদের ওপর নির্যাতন চলছে। কিন্তু একদিন আমাদের রক্তের বিনিময়ে হলেও এ দেশ স্বাধীন হবে।'

শহীদ বুদ্ধিজীবী আয়েজ উদ্দিনের ছেলে এম আর আলম ঝন্টু বলেন, 'পরিবারের সদস্য হিসেবে আমার বোন আসমা দুই দফায় বন্দীদের দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। সবার শরীরেই তখন রক্তের দাগ। কারও গাল কাটা, হাত-পা ভাঙা; কারও নখ উপড়ে ফেলেছিল, কারও আঙুলই নেই। এতটাই ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালিয়েছিল। ১১ তারিখ বাবার জন্য নতুন কাপড় নিতেই তিনি বললেন, "তুমি কাপড়গুলো নিয়ে যাও। কালকে আমাদের শেষবারের মতো গোসল করাবে।" আমার মা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে কোয়ার্টার গার্ড দেখা যেত। ১২ এপ্রিল বিকেলে দেখলাম বন্দীদের চোখ বেঁধে একে একে মিলিটারি ট্রাকে তোলা হচ্ছে।'

১২ এপ্রিল রংপুর ক্যান্টনমেন্টের পার্শ্ববর্তী নিসবেতগঞ্জের বালারখাইল বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে বন্দী বুদ্ধিজীবীদের রাতের আঁধারে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। গণহত্যায় সেদিন ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনজন ব্যক্তি। তারা সেদিন রাতে বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নিলেও পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান।

সেই রাতে আশ্রয় দেওয়া নিসবেতগঞ্জ গ্রামবাসীর সঙ্গে ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদকের কথা হয়। গণহত্যার রাতের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বালারখাইল গ্রামবাসী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন আজাদ বলেন, 'সে রাতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত আটটা-নয়টার দিকে বালারখাইলের দিকে অনেকক্ষণ ধরে গুলির আওয়াজ শুনেছিলাম। রাত দুইটার দিকে হঠাৎ গোঙানির আওয়াজে ঘুম ভাঙে। বিজলির আলোয় দেখি একজন মানুষ পড়ে আছে। দরজা খুলতেই দেখলাম বুকে গুলি লেগেছে। সারা গা কাদায় মাখামাখি। বললেন, "আমি নান্নু মিয়া কন্ট্রাক্টর। সৈয়দপুর থেকে সব গণ্যমান্য লোকদের ধরে এনে এখানে মেরেছে।"' তিনি আরও বলেন, 'পরদিন সকালে আমরা গিয়ে দেখি চারদিকে শুধুই লাশ। সব লাশ ওরা কোনোমতে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল।'

সৈয়দপুরের বাকি শহীদ বুদ্ধিজীবীরা

কেবল ১২ এপ্রিলই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা সৈয়দপুরে বুদ্ধিজীবী নিধন হয়েছে। ২৩ মার্চ বিহারিরা সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার পেইন্ট ইনচার্জ মনিরুজ্জামানকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করে।

২৭ মার্চ বিহারিরা রেলওয়ে কারখানার হিসাবরক্ষক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আবদুল আজিজকে জবাই করে হত্যা করে গাড়িসহ তার লাশ পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তার ছেলে মঞ্জুর হোসেন বলেন, 'বাবাকে অনেকে সরে যেতে বললেও তিনি বলেছিলেন, এটি আমার জন্মভূমি। প্রয়োজনে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে মরব। কিন্তু ওদের ভয়ে পালাব না।'

২৮ মার্চ নতুন বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা নাট্যাভিনেতা আমিনুল হককে তুলে নিয়ে যায়। তার ছেলে মিজানুল হক বলেন, 'আমাদের সৈয়দপুর হাইস্কুলের একটি কক্ষে রেখে নির্মাণাধীন সৈয়দপুর বিমানবন্দরে শ্রমিকের কাজ করাতে বাধ্য করা হতো। অনভ্যস্ত হওয়ায় বাবা ক্লান্ত হয়ে পড়লে তার ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হতো।' তিনি আরও বলেন, '২৮ জুন পাকিস্তানিরা তাকে বিহারি ইজাহার আহমদের হাতে তুলে দেয়। পরে বিহারিরা তার চোখ উপড়ে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীর টুকরো করে পাটকলের "জুটপ্রেস" যন্ত্র দিয়ে পিষে ফেলে।'

গণহত্যা গবেষক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আহম্মেদ শরীফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সৈয়দপুরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল বিহারি ও পাকিস্তানিদের নিখুঁত এক নীলনকশার ফলাফল। তাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল সৈয়দপুর শহরকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দেওয়া। যেন সৈয়দপুরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোনো জনমত না গড়ে উঠতে পারে।'

কেবল সৈয়দপুরই নয়, মুক্তিযুদ্ধকালে সারা দেশেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। ২৫ মার্চ কালরাতে শুরু হওয়া বুদ্ধিজীবী নিধন চলেছে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন সকাল পর্যন্ত।

২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান, অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মুক্তাদির, অধ্যাপক এ আর খান খাদিম, অধ্যাপক শরাফত আলী, অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান। ২৬ মার্চ ভোরে গুলিতে আহত অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ৩০ মার্চ শহীদ হন। ৪ এপ্রিল হত্যার শিকার হন সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র ঘোষ।

ঢাকার বাইরে ২৯ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ভাষা সংগ্রামী ও রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। ১৪ ও ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও অধ্যাপক হবিবুর রহমানকে হত্যা করে। ২৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে পাকিস্তানিরা কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা করে।

৭ মে পাকিস্তানিরা নারায়ণগঞ্জ থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে দানবীর ও ব্যবসায়ী রণদা প্রসাদ সাহাকে।

১৫ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেলের সহকারী সার্জন ডা. আজহারুল হক ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হুমায়ুন কবীরকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী সুপরিকল্পিত কায়দায় বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করে।

আলবদর, আলশামস ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সহযোগিতায় ১০-১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা একে একে তুলে নিয়ে যায় দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআইর প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির প্রতিবেদক নিজামউদ্দিন আহমদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার, ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বি, ডা. আলীম চৌধুরী প্রমুখকে।

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনেও থামেনি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এদিন পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। ড. আজাদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের শিকার সর্বশেষ বুদ্ধিজীবী।

দেশ স্বাধীনের পর এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে গুটিকয়েক বুদ্ধিজীবীর অর্ধগলিত লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা।

মুক্তিযুদ্ধের ১৫ জুন দ্য ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজে প্রকাশিত 'পূর্ব-পাকিস্তানে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ' শিরোনামের একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, 'পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে বেছে বেছে গণহত্যা চালাচ্ছে, তা তারা প্রতিবারই অস্বীকার করছে। যদিও একের পর এক তথ্যপ্রমাণে এটি প্রমাণিত যে তারা বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র—মোটকথা যারাই একটি স্বতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিতে পারবে, তাদের ঠান্ডা মাথায় হত্যা করছে।'