বুদ্ধিজীবীদের আল-বদর না, হত্যা করেছে পার্শ্ববর্তী দেশের লোকজন: বিএনপি নেতা

By নিজস্ব সংবাদদাতা, নারায়ণগঞ্জ
15 December 2025, 15:03 PM

নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেছেন, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের 'আল-বদর, আল-শামস' নয়, পার্শ্ববর্তী দেশের লোকেরা হত্যা করেছে।

বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য 'একটি রাজনৈতিক দলকে' দায়ী করা হলেও তা সঠিক ইতিহাস নয় উল্লেখ করে এই বিএনপি নেতা ওই রাজনৈতিক দলটিকে বর্তমান সরকারের কাছে 'ইতিহাস সংশোধনের দাবি' জানানোর আহ্বান জানান।

গতকাল রোববার নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

সভায় বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন।

বিএনপি নেতা আবু আল ইউসুফ খান টিপু তার বক্তব্যের শুরুতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।

পরে তিনি বলেন, 'আজকেও পত্রিকা পড়লাম। পত্রিকার পাতার সম্পাদকীয় কলাম ও বিভিন্ন জায়গায় লিখেছে, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে আল-বদর, আল-শামস। আমি আমাদের ইসলামিক রাজনৈতিক দলের নেতারা আছেন, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, বিএনপিরে দোষারোপ করে (আপনারা) অনেক কথা বলেন। যখন আপনাদের দোষারোপ করে ইতিহাস লেখা হয়, আপনারা কেন সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছেন না?'

'১৪ ডিসেম্বর তো কোনো আল-বদর, আল-শামস আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করেন নাই' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'হত্যা করেছিল যারা সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হবে কি হবে না, বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করতে চেয়েছিল। যারা দেশ স্বাধীন হতে দিবে কি দেবে না…। সেদিন পার্শ্ববর্তী কোনো এক দেশের লোকেরা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ বেঁধেছিল সেটাকে টার্গেট করে আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করা হয়েছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ এমন অনেক মেধাবী বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করেছিল, যে সকল মেধাবীরা বেঁচে থাকলে অনেক আগেই দেশ স্বাধীন হতো।'

জামায়াতে ইসলামীকে উদ্দেশ্য করে এ বিএনপি নেতা বলেন, 'আমি মনে করি, ইসলামিক দলগুলোকে টার্গেট করে বিভিন্ন বাম-সংগঠন, বাম-মনা সাংবাদিকরা এখনো আপনাদেরকে টার্গেট করে কথা বলে, আর ইতিহাসের পাতায় আপনাদেরকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। কেন আপনারা এটা সংশোধন করেন না? কেন আপনারা দাবি জানান না? শুধু কোনো জায়গায় স্টেজে উঠলেই তারেক রহমানের বিরুদ্ধে, বিএনপির বিরুদ্ধে (কথা) বলেন, কিন্তু কোনোটা প্রমাণ করতে পারেন না। অতএব রাজনৈতিক ইসলামিক দল, এখানে কাদেরকে বলছি, উনারা ভালো করে বুঝতেছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'ইতিহাসটাকে সঠিক করে তুলে ধরার জন্য আপনারা সরকারের কাছে দাবি জানান। আগামী প্রজন্মের কাছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে আপনারাই শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত থাকবেন। অতএব ইতিহাস সঠিক যেন লেখা হয়, কারা হত্যা করেছে, সেটা যেন লেখা হয়।'

এ সময় সভায় উপস্থিত জামায়াতের মহানগরের আমির মাওলানা আবদুল জব্বার ওই বিএনপি নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'আগামী সরকারের কাছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রচনার দাবি জানাই।'

তাকে থামিয়ে দিয়ে টিপু বলেন, 'বিগত ১৬ বছর বা এর আগে স্বাধীনতার পর অনেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল... অতএব সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্যই আমি আহ্বান করছি। পাশাপাশি এই বক্তব্যে কারও যদি গাত্রদাহ হয়, তাহলে আগামীতে বক্তব্য দেওয়ার সময় আপনারাও বিএনপির যাতে গাত্রদাহ না হয় সেইদিকে খেয়াল করে বক্তব্য দিবেন।'

এ সভায় আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারেরও দাবি জানান। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে তৎপরতা বৃদ্ধির কথাও বলেন টিপু।

বক্তব্যের শেষের দিকে আবারও বুদ্ধিজীবী হত্যার ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরার দাবি জানিয়ে মহানগর বিএনপির এই সদস্যসচিব বলেন, 'আবারও বুদ্ধিজীবী দিবসের যে ইতিহাস সে ইতিহাস ডিসি সাহেবের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের কথা তুলে ধরবেন। বুদ্ধিজীবী হত্যার ইতিহাস, বিজয় দিবসের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস যেন সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়।'

'৫ আগস্ট হয়ে গেলো, অনেকে অনেক কথা বলি। কিন্তু, এখনো স্বাধীনতার ঘোষকের যে ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস, বুদ্ধিজীবীর ইতিহাস এখনো পাঠ্যপুস্তকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয় নাই' যোগ করে তিনি আগামী বছরেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস সংশোধনেরও দাবি জানান।

টিপু বক্তব্যের সমাপ্তি টানার সময় বলেন, 'স্বাধীনতার ঘোষক কে, কারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে, কারা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা এবং কারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে—তার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য জেলা প্রশাসন যে আয়োজন করেছে তার জন্য ধন্যবাদ জানাই।'

জেলা প্রশাসক মো. রায়হান কবিরের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. এ এফ এম মুশিউর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আলমগীর হুসাইন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেক আল মেহেদী, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীব, মহানগর জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমাদ, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়কারী তরিকুল ইসলাম, এনসিপির জেলা কমিটির সমন্বয়কারী আব্দুল্লাহ আল আমিন, ইসলামী আন্দোলনের মহানগর সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ, গণঅধিকার পরিষদ জেলা সভাপতি মো. নাহিদ প্রমুখ।

সভায় এ বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ বা বিরুদ্ধমত প্রকাশ না করলেও পরে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপি নেতা টিপুর বক্তব্যের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান।

এ বিষয়ে এনসিপি নেতা আব্দুল্লাহ আল আমিন মুঠোফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টিপু ভাই যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন আমি আর রাজিব (জেলা বিএনপি নেতা) ভাই পাশাপাশি বসা ছিলাম। আমরা দুজনই তখন খুব অবাক হয়েছি। নিজেরাও এটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম যে, উনি এ ধরনের বক্তব্য কীভাবে দিলেন! আমাদের খুব অবাক করেছে তার বক্তব্য।'

তিনি বলেন, 'প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রশ্ন তুলতে পারেন না। অনেকেই মনগড়া ইতিহাস বানাতে চাচ্ছে, কিন্তু ওনার (টিপু) মতো দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এই ধরনের বক্তব্য আসবে, তা আমরা প্রত্যাশা করিনি। ওই সভায় বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে—এমন চিন্তা করে আমরা সরাসরি প্রতিবাদ না জানালেও, কোনোভাবেই এই বক্তব্যকে সমর্থন করা যায় না।'

সভা শেষে টিপুকে এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের কথা বলেছেন বলেও দাবি করেন এই এনসিপি নেতা।

তিনি বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারীদের দায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের। এখানে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই। যদি কোনো বিতর্ক (ভবিষ্যতে) একাডেমিক্যালি তৈরিও হয়, তাও প্রমাণের ভিত্তিতে হতে হবে।'

সভায় উপস্থিত গণসংহতি আন্দোলনের নেতা তরিকুল ইসলাম সুজন বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধারা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন দেশের মেধাবী সন্তানদের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত আল-বদর, আল-শামসের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী, কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক ও লেখকদের হত্যা করেছে। যারা আজ এ বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করছে, হয় তাদের ইতিহাস-জ্ঞান সীমিত, নয়তো তারা সচেতনভাবে দেশ-বিরোধীদের পক্ষাবলম্বন করছে।'

আজ মুঠোফোনে আবু আল ইউসুফ খান টিপুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রোববার দেওয়া বক্তব্যের সাফাই দেন এবং বলেন, এটি তার ব্যক্তিগত মতামত, দলীয় নয়।

তিনি বলেন, 'পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের চিনতো না। তখন যুদ্ধটাকে আরও উস্কে দিতে এবং দেশকে মেধাশূণ্য করতে তৃতীয় একটি পক্ষ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। আমি বাংলাদেশের রাজনীতি যেহেতু করি, ইতিহাসের বই-পত্র ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাতেই এমন তথ্য পেয়েছি।'

তবে, নিজ দলের সদস্যসচিবের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। ওই সভাতে সাখাওয়াত নিজেও উপস্থিত ছিলেন।

মুঠোফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত না এবং দলও এই কনসেপ্টের সঙ্গে একমত না।'

দলীয় নেতার এমন বক্তব্যের বিষয়টি জ্যেষ্ঠ নেতাদের নজরে আনা হয়েছে এবং তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান সাখাওয়াত।