২০২৫ শ্রম আইন সংশোধনী: নিরাপত্তা, অধিকার ও এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে ২০২৬ সালে উত্তরণের প্রাক্কালে বাংলাদেশে শ্রম আইন সংশোধন এখন আর কেবল অভ্যন্তরীণ সংস্কারের প্রশ্ন নয়।
শ্রমিক সুরক্ষা, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার শর্ত হিসেবে ২০২৫ সালের শ্রম আইন সংশোধনী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকার শ্রমিকদের স্বার্থে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কনভেনশনে সই করে। এগুলো হলো—কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ (কনভেনশন ১৫৫), পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন (১৮৭) এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধে বৈশ্বিক মানদণ্ড (১৯০)।
এলডিসি উত্তরণের আগে শ্রম সুরক্ষা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার পথে এই উদ্যোগকে অগ্রগতি হিসেবে দেখা হলেও বাস্তব পরিস্থিতি এখনো জটিল।
রপ্তানিমুখী শিল্প, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে শ্রম নিরাপত্তা ও অধিকার এখনো বহু ক্ষেত্রে দুর্বল।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ২০২০–২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেড় হাজারের বেশি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং এতে ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ২২৭ কোটি টাকা। অগ্নি নিরাপত্তা, ভবন নির্মাণবিধি ও জরুরি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়ে গেছে; বড় অগ্নিকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় দায়বদ্ধতার সংকটও স্পষ্ট।
শ্রমিকদের জীবনমানের চিত্রও উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পোশাক খাতের প্রায় ৩২ শতাংশ শ্রমিক ন্যূনতম মজুরির নিচে আয় করেন এবং প্রায় ৭৮ শতাংশ শ্রমিক পরিবারে পর্যাপ্ত খাদ্য জোগাতে পারেন না।
সাব-কন্ট্রাক্টেড বা মিশ্র চুক্তিভিত্তিক কারখানায় ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি শিফট এখনো স্বাভাবিক ঘটনা। কিছু ক্ষেত্রে শিশু শ্রম ও জবরদস্তিমূলক শ্রমের ঝুঁকিও রয়ে গেছে, যা শ্রমিক সুরক্ষার কাগুজে অঙ্গীকার ও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার ব্যবধানকে স্পষ্ট করে।
এই বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তাদের সদস্যভুক্ত ১৫৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ২ লাখ শ্রমিক। এর মধ্যে ২০–৩০ শতাংশ অন্য কারখানায় কাজ পেলেও বাকিরা বেকার রয়ে গেছেন। বন্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও অন্তত ২০টি কারখানা।
আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডের প্রশ্নে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই বহিরাগত চাপের মুখে। ২০১২ সালের তাজরিন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য এলডিসি-সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সুবিধা বন্ধ করে দেয় এবং আজও জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করেনি।
শ্রমিক অধিকার, সংগঠন স্বাধীনতা, অগ্নিনিরাপত্তা ও কারখানা তদারকির দুর্বলতাই এ ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নও নিয়মিতভাবে শ্রম আইন সংস্কার ও ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা নিয়ে নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে।
রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সরকার ও শিল্পমালিকরা কারখানা নিরাপত্তা সংস্কারে বাধ্য হয়। ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলোর উদ্যোগে গঠিত হয় 'অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ', যা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক ছিল।
২০২০ সালে অ্যাকর্ডের দায়িত্ব হস্তান্তরের পর গঠিত হয় রেডিমেড গার্মেন্টস সাস্টেইনিবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি)। শুরুতে অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তায় সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০২৫ সালের নভেম্বর থেকে আরএসসি শ্রমিক অধিকার, মজুরি, ছুটি, সমষ্টিগত দরকষাকষি এবং জবরদস্তি ও শিশুশ্রম–সংক্রান্ত অভিযোগও গ্রহণ ও তদন্ত করছে।
উত্তর আমেরিকার রিটেইলারদের উদ্যোগে গঠিত অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি এবং পরবর্তী সময়ে নিরাপদ ও 'সাস্টেইনিবিলিটি কমপ্যাক্ট'—সব মিলিয়ে গত এক দশকে আন্তর্জাতিক চাপই শ্রম আইন সংস্কার ও নিরাপত্তা মানদণ্ড প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রধান চালিকাশক্তি হয়েছে।
তবে এসব উদ্যোগ বৈশ্বিক সরবরাহ–শৃঙ্খলের কাঠামোগত সমস্যা—কম দামে দ্রুত পণ্য সরবরাহের চাপ, অডিট ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং শ্রমিক সংগঠনের দুর্বলতা কিছুই সমাধান করতে পারেনি।
এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী বাস্তবতায় অন্য দেশের অভিজ্ঞতাও শিক্ষণীয়।
অবকাঠামো ও মানবসম্পদে বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনীতি স্থিতিশীল করেছে বতসোয়ানা, পর্যটন ও সেবা খাতে বৈচিত্র্য এনেছে কেপ ভার্দে, আর সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করেছে সামোয়া ও মালদ্বীপ।
বিপরীতে, ইকুইটোরিয়াল গিনির মতো দেশে একক খাতনির্ভরতা উত্তরণের পর ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত ২০২৫ সালের শ্রম আইন সংশোধনীকে একটি রূপান্তরমুখী উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গৃহকর্মী ও নাবিকদের শ্রম আইনের আওতায় আনা, ব্ল্যাকলিস্টিং ও বাধ্যতামূলক শ্রম নিষিদ্ধ করা, বেসরকারি খাতে প্রভিডেন্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক করা এবং ন্যূনতম মজুরি নিয়মিত পুনর্নির্ধারণ—এসব পদক্ষেপ শ্রমিক সুরক্ষা জোরদারের ইঙ্গিত দেয়।
ইউনিয়ন গঠন ও নিবন্ধন সহজ করা এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার প্রবর্তন শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ বাড়াতে পারে।
নারী শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২০ দিন নির্ধারণ এবং দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনের ঘোষণাও গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
তবে সংশোধনী নিয়ে মালিক ও শ্রমিক—উভয় পক্ষের মধ্যেই উদ্বেগ রয়েছে। বিজিএমইএর মতে, ইউনিয়ন গঠনের কিছু বিধান শিল্পে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, আর শ্রমিক পক্ষের দাবি—আইনের বাস্তব প্রয়োগই মূল চ্যালেঞ্জ।
সংশোধিত শ্রম আইন ২০২৫ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারের কঠোর তদারকি, নিয়মিত তদারকি ও প্রয়োগযোগ্য নীতি অপরিহার্য।
একইসঙ্গে মালিক–শ্রমিকের মধ্যে সংলাপ, মধ্যস্থতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আস্থা গড়ে তোলাও জরুরি। শ্রমিকদের নিরাপদ ও ন্যায্য কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা কেবল সামাজিক দায় নয়, এলডিসি উত্তরণের পর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এটি এখন অপরিহার্য শর্ত।