‘বেগম’ উপাধি ছাড়াই সমাজ সংস্কারক রোকেয়া

মাহামুদুল হক
মাহামুদুল হক
9 December 2025, 16:48 PM

বাংলার নারী জাগরণ ও সমাজ সংস্কারের ধারায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এক অনন্য নাম।

শিক্ষা বিস্তার, যুক্তিবাদ ও পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম উনিশ শতকের রক্ষণশীল সমাজে যেমন আলোড়ন তুলেছিল, আজও তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

বাংলার নারী জাগরণ, শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সংস্কারের ইতিহাসে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবস্থান অনন্য। সমাজের কু-প্রথা ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে আসেন রোকেয়া। 

যদিও তার আগে সমাজসংস্কারের কাজে যুক্ত ছিলেন কুমিল্লার নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী।

রামমোহন রায় ১৮০৯ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে রংপুরে অবস্থান করেন। রংপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের পায়রাবন্দ গ্রামের বিখ্যাত সাবের বংশের কন্যা ছিলেন রোকেয়া। 

ভারতের রিভার (রোকেয়া ইন্সটিটিউট অব ভ্যালু এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ)–এর সমন্বয়ক প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, 'রামমোহন স্বাভাবিক নিয়মেই এই পরিবারের হয়তো বন্ধু হয়েছিলেন… পরোক্ষভাবে হলেও রোকেয়ার পরিচয় ছিল রামমোহনের সঙ্গে। পরিচয় হয়েছিল যুক্তিবাদী চিন্তাধারার সঙ্গেও।'

রামমোহন, আব্দুল আলীম, অক্ষয়কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর, আমীর আলী, ওবায়েদী, আব্দুল আজীজ ও রোকেয়া—এরা যুক্তিবাদের ধারায় সমাজকে এগিয়ে নিয়ে বাঙালি নবজাগরণের পথ দেখিয়েছেন।

শিখা গোষ্ঠী নবজাগরণের সেই ধারাকে এগিয়ে নেয়।

উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিশ শতকের শুরুতে রক্ষণশীল সমাজের ভেতর রোকেয়া যে দৃষ্টিভঙ্গি, সাহস ও মানবমুক্তির বোধ তুলে ধরেন, তা পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। না

নারী অধিকার, শিক্ষা বিস্তার, যৌক্তিক চিন্তা ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজব্যবস্থার পক্ষে তার সংগ্রাম আজও প্রাসঙ্গিক।

রোকেয়া লিখেছেন, 'মাত্র পাঁচ বছর বয়স হইতে আমাকে স্ত্রীলোকদের হইতেও পর্দা করিতে হইতো।' 

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম নেওয়া রোকেয়ার পরিবার ছিল সম্ভ্রান্ত মুসলিম অভিজাত পরিবার। 

সে সময় মেয়েদের লেখাপড়াকে বেপর্দার আশঙ্কায় নিষিদ্ধ ধরা হতো; কেবল কোরআন শিক্ষার সুযোগ ছিল। 

নিজের উদ্যোগে ভাইদের কাছ থেকে ফারসি ও বাংলা শিক্ষা নেন তিনি। তবে এসব পাঠচক্রে পাড়ামহল্লার মুরুব্বিরা বিরক্ত হন, ফলে পুথি পড়াও বন্ধ হয়ে যায় তার।
তার পিতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতায় ছিলেন। 

রোকেয়ার অনানুষ্ঠানিক শিক্ষক ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ ভাই আবুল আসাদ মোহাম্মদ ইব্রাহিম সাবের।

রোকেয়া বলেন, 'বালিকা বিদ্যালয় বা স্কুল-কলেজ-গৃহের অভ্যন্তরে আমি কখনো প্রবেশ করি নাই…।'

১৮৯৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয়। 

স্বামী খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেন বিহারের ভাগলপুরের বাসিন্দা। তার উৎসাহে রোকেয়ার লেখালেখি ও সামাজিক কর্ম নতুন গতি পায়। 

স্বামীর মৃত্যুর পরও তিনি মুসলিম নারীর শিক্ষা বিস্তারে অদম্য মনোবল নিয়ে কাজ চালিয়ে যান—যা ছিল তার স্বামীরও স্বপ্ন।

নারী শিক্ষায় রোকেয়ার সবচেয়ে বড় অবদান ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ। সেদিন কলকাতার ১৭ সিনহা রোডে আটজন ছাত্রী নিয়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

ওই সময়ের সামাজিক বাস্তবতায় এটি ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ। খুব অল্প সময়েই তিনি সরকারি সহায়তাও পান। 

প্রথাগত পাঠ্যসূচির পাশাপাশি জীবনমুখী শিক্ষায় জোর দেন তিনি—গণিত, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, কারুশিল্প, সামাজিক বিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্রশাসনিক দক্ষতা পর্যন্ত শেখানোর ব্যবস্থা করেন।

১৯১৭ সালে তদানীন্তন বড়লাটের পত্নী লেডি চেমসফোর্ড স্কুলটি পরিদর্শন করেন। মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে অনীহা, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও কুসংস্কার সত্ত্বেও রোকেয়া দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যান।

তার ভাষায়, 'নারীকে শিক্ষিত না করে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না।' সে সময় মুসলিম সমাজে এই বক্তব্য ছিল এক ধরনের সামাজিক প্রতিবাদ।

সামাজিক সংগঠন গঠনে রোকেয়া ছিলেন অগ্রণী। ১৯১৬ সালে নারী শিক্ষা ও অধিকার রক্ষায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'আনজুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম'।
 
দরিদ্র নারীদেরকে সহায়তা, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান এবং সচেতনতা সৃষ্টির নানা কর্মসূচি পরিচালিত হতো এই সংগঠনে।
 
১৯৩৭ সালে শামসুন নাহার তার জীবনী 'রোকেয়া জীবনী'-তে লিখেছেন, "নারীর রাজনৈতিক অধিকার সমন্ধে এই সমিতি যথেষ্ট কর্মতৎপরতার পরিচয় দিয়েছে।"

বাংলা সাহিত্যে নারীবাদী লেখার পথিকৃৎ হিসেবেও রোকেয়ার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তার 'সুলতানার স্বপ্ন' নারী-মুক্তির বিজ্ঞানমনস্ক কল্পপ্রতিচ্ছবি; লেডিল্যান্ডের মাধ্যমে তিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অসারতা ব্যঙ্গ করেছেন। 

'অবরোধবাসিনী'তে তিনি নারীর জীবনসংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরে পর্দা প্রথার কুফল ব্যাখ্যা করেন—যা পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নৃবৈজ্ঞানিক দলিল।

'পদ্মরাগ', 'মতিচূর', 'নারী সমাজ'সহ অন্যান্য রচনায় রোকেয়া নারী-পুরুষ সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, যুক্তিবাদ ও ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তার ভাষা ছিল সহজ, যুক্তিপূর্ণ এবং প্রভাব বিস্তারকারী।

নারীর মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক স্বীকৃতি ছিল তার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।
 
রোকেয়ার মতে, নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—তিন স্তরেই জরুরি। ধর্মীয় মূল্যবোধ অস্বীকার না করলেও তিনি ধর্মের নামে আরোপিত কুসংস্কারের সমালোচনা করেন। তার বক্তব্য, "অজ্ঞতা-ই পর্দার মূল কারণ।"

রোকেয়ার উত্তরসূরী মাজেদা সাবের তার 'ভেঙ্গেছে দূয়ার এসেছে জ্যোর্তিময়ী' গ্রন্থে লেখেন, "নিজ ধর্মের প্রতি গাঢ় অনুরাগ, শ্রদ্ধা, অবিচল বিশ্বাস, এবং আরও অনেক সামাজিক সংকীর্ণতা ও সংস্কারের উর্দ্ধেও যেতে পেরেছিলেন।"

বাংলাদেশ সরকার তার জন্মদিন ৯ ডিসেম্বরকে 'বেগম রোকেয়া দিবস' ঘোষণা করেছে। 

তার নামে পায়রাবন্দে 'বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র' ও রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে রোকেয়া নিজে কখনও নামের আগে 'বেগম' ব্যবহার করেননি। 

শামসুন নাহারের 'রোকেয়া জীবনী'তে সংযুক্ত ২৫টি পত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন আর.এস. হোসেন ও রোকেয়া খাতুন; খান বাহাদুর তসাদ্দক আহমদকে লেখা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন 'রোকেয়া খাতুন'।

বাঙালি সমাজে বিয়ের পর স্বামীর নাম যুক্ত করে স্ত্রী পরিচয় পাওয়া একটি প্রচলন; সে কারণে রোকেয়া খাতুন হয়েছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। 

কিন্তু 'বেগম' উপাধি তিনি কখনো লেখেননি। তাই গবেষণা, লেখালেখি বা গণমাধ্যমে তার নামে 'বেগম' সংযোজন কতটা যথার্থ—সে প্রশ্ন উঠেছে। 

অনেকের মতে, 'বেগম' উপাধি সম্ভ্রান্ত মুসলিম নারীকে বোঝালেও এটি নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সামাজিক পৃথকীকরণের একটি চিহ্নও বটে। যে লেখক নিজের কর্মে পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়েছেন, তার নামের সঙ্গে এমন উপাধি জুড়ে দেওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য—এ প্রশ্নও তাই উঠে আসে।

পায়রাবন্দে রোকেয়ার নামে যে স্মৃতিকেন্দ্র রয়েছে, সেখানে তার কোনো স্মৃতি সংরক্ষিত নেই—শুধু একটি লাইব্রেরি আছে যেখানে সরকারি একজন কর্মচারী দায়িত্ব পালন করেন। 

দর্শনার্থীরা মনে করেন, এটি 'রোকেয়া গবেষণা ইনস্টিটিউট' হিসেবে উন্নীত হওয়া প্রয়োজন।

পর্যটকরা জানান, রোকেয়ার পায়রাবন্দ অঞ্চলে এখনো নীরবে বা প্রকাশ্যে নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, যৌতুক, কুসংস্কার ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা যায়। ফলে রোকেয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষা আজও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক আলোচ্য।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন সত্যিকারের সমাজ সংস্কারক। শিক্ষার আলো, যুক্তির শক্তি ও মানবমুক্তির দর্শনে তিনি যে স্বপ্ন এঁকেছিলেন, তার সংগ্রাম ব্যক্তি থেকে সমাজ, পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। 

শিক্ষা বিস্তার, সাহিত্য, এবং সংগঠন—এই তিন মাধ্যমে তিনি যে নারীজাগরণের ভিত্তি নির্মাণ করেছেন, তা আজকের উন্নয়নধারার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত।

শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর