আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চ্যালেঞ্জ: পোড়া থানায় আটকে আছে শত শত মামলার তদন্ত
গত বছরের ৯ এপ্রিল এক ধর্ষণ মামলার তদন্ত শুরু হয় রাজধানীর আদাবর থানায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক ও ডিএনএ টেস্ট করা হয়।
কিন্তু হঠাৎ তদন্ত থেমে যায়, যখন গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে বিক্ষোভের মধ্যে আগুনে পুড়ে যায় থানাটি। পুড়ে যায় বহু রিপোর্ট, ৭৬টি মামলার নথি, প্রায় ১০০ মামলার প্রমাণ এবং রেজিস্ট্রেশন বই।
আদাবর থানার উপপরিদর্শক রাকিবুল ইসলাম বলেন, প্রমাণ ধ্বংস হওয়ায় অভিযোগপত্র দাখিলে দেরি হয়। সেই সুযোগে অভিযুক্ত আসামি জামিন পেয়ে গেছে। ভুক্তভোগী ও তদন্তকারীরা এতে হতাশ। সব নথি জোগাড়ের চেষ্টা চলছে, কিন্তু কাজটা খুব কঠিন।'
শুধু আদাবর থানাই নয়, গত বছরের আগস্টের ৫ ও ৬ তারিখে ঢাকা মহানগর পুলিশের আরও ১২টি থানা পুড়ে যায়। এতে ১ হাজার ২০০ মামলার নথি ও ১ হাজার ১০০টি প্রমাণ, যার মধ্যে ফরেনসিক ও ডিএনএ রিপোর্টও ছিল—সব ধ্বংস হয়ে যায়।
এই থানাগুলো মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, পল্টন, শেরে বাংলা নগর, শ্যামপুর, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ভাটারা, ওয়ারী এবং খিলক্ষেত এলাকায় অবস্থিত।
ডিএমপি সদর দপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার এস. এন. নজরুল ইসলাম বলেন, 'আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রায় সব মামলার নথির কপি আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি। তবে প্রমাণ উদ্ধার করতে সমস্যা হচ্ছে।'
তিনি আরও বেলেন, 'কোনো মামলার প্রমাণ উদ্ধার করা না গেলে তদন্ত টিমকে একটি সাধারণ ডায়েরি করতে হয় এবং সেটির কপি আদালতে জমা দিতে হয়।'
গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কারণে পুলিশ কঠোর জনসমালোচনার মুখে পড়ে। অনেক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অযৌক্তিক গ্রেপ্তার, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অভিযোগ রয়েছে, যা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা করেছে।
বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর বিপর্যস্ত পুলিশ
গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যাত্রাবাড়ী থানা। সেখানে ভয়াবহ আগুনে যানবাহন, মামলার নথি ও প্রমাণ পুড়ে যায়। এমনকি অন্তত ছয়জন পুলিশ সদস্য প্রাণও হারান। ধ্বংসের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, থানার কার্যক্রম পুরো দুই মাস বন্ধ থাকে।
যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক রমজানুল হক বলেন, 'সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল—গাড়ি, ফাইল, কম্পিউটার। আমাদের হাতে কিছুই ছিল না।'
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা ও ফরেনসিক রিপোর্ট পুনরুদ্ধার করাও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। হাসপাতালগুলো রিপোর্টের আরেকটি নকল কপি দিতে রাজি হচ্ছিলো না নিয়মের অজুহাতে। তবুও আমাদের চেষ্টা চালাতে হয়।'
মিরপুর থানায়ও সব মামলার নথি ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজ হারিয়ে যায়। থানার ভেতরে থাকা প্রায় ২০০ মোটরসাইকেল ও ১৫টি গাড়ি পুড়ে যায়।
মিরপুর থানার ওসি সাজ্জাদ রুমন বলেন, 'আগুনে সব ফাইল, গাড়ি ও আসবাবপত্র ধ্বংস হয়ে যায়। শুধু কিছু টেবিল–চেয়ার নিয়ে আমরা কাজ শুরু করি। থানা পুরোপুরি সচল হতে সময় লেগেছে আট মাস।'
তিনি আরও বলেন, 'এখনো গুরুত্বপূর্ণ নথি উদ্ধার চলছে। ফরেনসিক রিপোর্ট হারানোয় অনেক তদন্ত বিলম্বিত হয়েছে, বিশেষত ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলোতে।'
কিছু প্রমাণ, যেমন রক্তমাখা পোশাক ও হত্যার অস্ত্র চিরতরে হারিয়ে গেছে বলে জানান তিনি। সাজ্জাদ বলেন, 'আমরা আদালতকে জানিয়েছি যে অনেক মামলার প্রমাণ নষ্ট হয়েছে। বিকল্প হিসেবে সাক্ষীদের বক্তব্য নিচ্ছি।'
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, 'যেসব মামলার নথি আদালতে আছে, সেগুলোর বিচার প্রক্রিয়ায় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অন্য মামলাগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশকে ব্যাখ্যা দিতে হবে।'
৪৬০টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ থেকে ৬ আগস্টের মধ্যে সারাদেশে ৪৬০টি থানা, আউটপোস্ট ও অন্যান্য পুলিশ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কমপক্ষে ৫২৬টি পুলিশ গাড়ি আগুনে পুড়ে যায়—এর মধ্যে ২৪১টি পিকআপ, ২১৭টি মোটরসাইকেল, ১৩টি চারচাকা এবং ৫৫টি গাড়ি।
গত ১৪ মাসে পুলিশের জন্য নতুন করে কেনা হয়েছে ২০০টি পিকআপ, ২০টি চারচাকা, ৪৬টি গাড়ি ও ১৫২টি মোটরসাইকেল।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক এ. এইচ. এম. শহাদাত হোসাইন বলেন, 'বিভিন্ন ইউনিটকে নতুন গাড়ি দেওয়া হয়েছে টহল ও অপরাধ দমন কার্যক্রম জোরদার করতে। প্রতিটি থানা ও ইউনিটের সক্ষমতা বাড়াতে সদর দপ্তর কাজ করছে।'
আরও সহায়তা দরকার
অনেক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গণঅভ্যুত্থানের ১৪ মাস পরেও পর্যাপ্ত সহায়তা তারা পাননি।
মিরপুর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমরা থানাটা পুনর্নিমাণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিছু সহায়তা পেয়েছি, কিন্তু তা যথেষ্ট না।'
তিনি জানান, আগুনের আগে মিরপুর থানায় আটটি পিকআপ ছিল, এখন পাওয়া গেছে পাঁচটি।
মিরপুর থানার ওসি সাজ্জাদ বলেন, 'মিরপুর এলাকা পুরোপুরি কাভার করতে অন্তত ১০টি টহল গাড়ি দরকার। এখন আমরা কেবল গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে টহল দিতে পারছি।'
ওই থানার এক উপপরিদর্শক বলেন, 'আমরা হয়তো বেশিরভাগ প্রমাণ পুনরুদ্ধার করতে পারব, কিন্তু কাজের আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি ফিরে পাইনি। অনেকেই এখনো গণজমায়েত বা সহিংস ঘটনার মুখোমুখি হতে ভয় পান। পোড়া থানার দৃশ্যগুলো এখনো চোখে ভাসে।'
তিনি আরও বলেন, 'কোনো বড় ঘটনা ঘটলে এখনো ঘটনাস্থলে দুই–তিনটি টহল দল পাঠাতে হয়।'


