আবুরখীল: হালদাপাড়ের যে গ্রাম ছিল মুক্তি সেনাদের দুর্গ
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার হালদা নদীর তীর-ঘেঁষা গ্রাম আবুরখীল। বৌদ্ধ-অধ্যুষিত এই গ্রামটি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে হয়েছিল এক সংগ্রামী জনপদ।
যুদ্ধের শুরুতে গ্রামটি ছিল শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল। সেখান থেকেই একাধিক দুর্ধর্ষ অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। গ্রামের এক বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছিল ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল। এই গ্রামেরই অন্তত ১০ বাসিন্দা সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন রণাঙ্গনে।
মুক্তিযুদ্ধে আবুরখীল গ্রাম ও এর বাসিন্দাদের অবদানের কথা বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে। এর মধ্যে রোকেয়া কবিরের লেখা 'মুক্তিযুদ্ধ ও নারী', জগন্নাথ বড়ুয়ার 'মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের অবদান' এবং জামাল উদ্দিনের 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম' উল্লেখযোগ্য।
চলতি বছরের জুন মাসে আবুরখীল গ্রাম ও আশপাশের এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন দ্য ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদক। এ সময় আবুরখীলের বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা, যুদ্ধকালীন আশ্রয় নেওয়া শরণার্থী, মুক্তিযোদ্ধা ও বৌদ্ধ ধর্মগুরুসহ অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বইগুলো থেকে জানা যায়, একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতে পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রাম শহর দখল করে নেয়। ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট হয়ে রাউজানে প্রবেশ করে। সেখানে ১৩টি স্থানে গণহত্যা চালিয়ে মদুনাঘাটে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে তারা।
এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতাকর্মীরা কেরানীহাট বাজার ও আশপাশের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ব্যাপক হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালায়। প্রাণ বাঁচাতে হিন্দুরা আবুরখীল গ্রামে আশ্রয় নেন। শহর ছেড়ে পালানো অনেক সাধারণ মানুষও সেখানে আশ্রয় পান। এছাড়া প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধের পর পিছু হটা ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বেশ কয়েকজন বাঙালি সেনাও আবুরখীলে অবস্থান নেন।
রাউজানের পশ্চিম গুজরা গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা শরবিন্দু কান্তি বণিক (৭৫) বলেন, 'আমরা শত শত হিন্দু আবুরখীলের বাড়িতে বাড়িতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরে অবশ্য বেশির ভাগই ভারতে চলে যান, তবে আমরা থেকে যাই। আবুরখীলের গ্রামবাসীরা তখন আমাদের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তা ভোলার নয়।'
শুরুতে গ্রামবাসীরা নিজেদের বাড়িতেই শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। তবে দ্রুত শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বাড়িতে স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে পড়ে। তখন গ্রামবাসীরা সর্বসম্মতিক্রমে আবুরখীল অমিতাভ উচ্চবিদ্যালয় ও অমিতাভ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কক্ষগুলো খুলে দেন।
গ্রামবাসী মঞ্জু মুৎসুদ্দী (৭৩) বলেন, 'তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রতিটি বাড়ির পুরুষ সদস্য ও পুরুষ শরাণার্থীরা স্কুলে থাকবেন। আর নারীরা থাকবেন বাড়িতে। শরণার্থীদের খাবারের খরচ পালাক্রমে এক–একদিন এক–একটি পরিবার বহন করবে।'
শরণার্থী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল
যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে আবুরখীলে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের বেশির ভাগই পরে ভারতে পাড়ি জমান। এরপর জুলাই-আগস্ট মাসে আবুরখীলে মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন শুরু হয়। নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা আবুরখীলে নিরাপদেই ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধারা কেন আবুরখীলকে নিরাপদ মনে করতেন, তার পেছনে রয়েছে এক অভাবনীয় ঘটনা। ১৯৭১ সালে ঢাকার বাসাবোর ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন প্রভাবশালী ধর্মগুরু বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো। রাউজানের হোয়ারাপাড়া গ্রামের এই ধর্মগুরুর সঙ্গে চীনা বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। চীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায়, বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো দেশব্যাপী বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তার জন্য একটি বিশেষ পরিচয়পত্র প্রবর্তন করেছিলেন।
পরিচয়পত্রটিতে নাম ও গ্রামের নামসহ প্রয়োজনীয় তথ্য থাকত। আবুরখীলের বেশির ভাগ বাসিন্দা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হওয়ায় এই পরিচয়পত্র তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিলি করা হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও বেশ কিছু পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে নেন।
যুদ্ধের সময় আবুরখীল কেন্দ্রীয় বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন বনশ্রী মহাথেরো। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভার সংঘনায়ক। তিনি বলেন, 'গ্রামবাসীর মাধ্যমেই ওই কার্ড মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পৌঁছেছিল। যেহেতু সেখানে সবাই বাঙালি ছিলেন, তাই কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে গ্রামবাসী—তা বোঝা পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছিল।'
আবুরখীলে আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা এখান থেকেই বেশ কয়েকটি অভিযানে অংশ নেন এবং যুদ্ধ শেষে আবার গ্রামে ফিরে আসতেন। গ্রামটি থেকে নদীপথে হাটহাজারীর মদুনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল খুব কাছে। ওই কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম শহর ও বন্দরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। সেপ্টেম্বরে মুক্তিযোদ্ধারা কেন্দ্রটির সাবস্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কয়েক দফা রেকি করার পর ৬ অক্টোবর আবুরখীল থেকে গিয়ে মদুনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা চালান তারা।
অপারেশনে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা দিদারুল আলম বলেন, 'মদুনাঘাট যুদ্ধের জন্য সুলতান মাহমুদ বীর উত্তমের নেতৃত্বে আমরা ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে আবুরখীলে এসে ভূষণ বাবু ও বীরেশ্বর বড়ুয়ার বাড়িতে আশ্রয় নিই। ৬ অক্টোবর গ্রাম থেকে নৌকা নিয়ে হালদা নদী পেরিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে অতর্কিত আক্রমণ চালাই। রকেট লঞ্চার দিয়ে দুটি ট্রান্সফরমারও ধ্বংস করা হয়।'
যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে গুরুতর আহত হন আবদুল মান্নান বীর বিক্রম। ডান হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হন দলনেতা সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম। আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। দিদারুল আলম স্মৃতিচারণা করে বলেন, 'মদুনাঘাট যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছিলেন আবুরখীলের ডা. রেণুকণা।'
রেণুকণা বড়ুয়ার ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল
একাত্তরের শুরুতে ডা. রেণুকণা বড়ুয়া চট্টগ্রামের ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে হাসপাতালের সহকারী সার্জন ছিলেন। এপ্রিলে বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা তার স্বামী সুপতিরঞ্জন বড়ুয়াকে তুলে নিয়ে যায়। স্বামী শহীদ হয়েছেন বুঝতে পেরে মে মাসে বাবার বাড়ি আবুরখীলে চলে আসেন তিনি। শোককে শক্তিতে রূপ দিয়ে স্থানীয় বীরেশ্বর বড়ুয়ার বাড়িতে একটি অস্থায়ী হাসপাতাল চালু করেন তিনি। চিকিৎসার জন্য গ্রামের কয়েকজন মেয়েকেও প্রশিক্ষণ দেন।
মদুনাঘাট যুদ্ধে আহত আবদুল মান্নানসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেন রেণুকণা। অন্যরা সুস্থ হলেও আবদুল মান্নান বীর বিক্রমকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকার মাঝি পরিতোষ বড়ুয়া বলেন, 'আবদুল মান্নানকে গুলি লাগার পর আমরা ধরাধরি করে তাকে নৌকায় তুলি। এরপর রেণুকণার কাছে নিয়ে আসি। তিনি দিনরাত চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু গুলিতে মান্নানের পাকস্থলী ছিঁড়ে যাওয়ায় তাকে বাঁচানো যায়নি।' মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়াও অনেক শরণার্থী তার সেবা পেয়েছিলেন বলে জানান গ্রামবাসী খগেন্দ্র লাল বড়ুয়া। তিনি বলেন, 'আবুরখীল ও পাশের গ্রামের মানুষের কাছে ডা. রেণুকণাই ছিলেন একমাত্র ভরসা।'
ভয় আর আতঙ্কের দিনরাত
মদুনাঘাট যুদ্ধের পর বিপদ আঁচ করতে পেরে আবুরখীলের বাসিন্দারা গ্রামে পাহারা বসান। প্রবীণ বাসিন্দা উদয়ন বড়ুয়া বলেন, 'অপারেশনের পরপরই আমরা বুঝেছিলাম রাজাকারেরা মিলিটারি নিয়ে আসবে। তাই সতর্ক থাকার জন্য পাহারা বসানো হয়। দিনের বেলা মানুষের চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়।'
যুদ্ধের দু-তিন দিন পর মুক্তিযোদ্ধাদের ধরতে রাজাকারদের নিয়ে আবুরখীলে অভিযান চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে তারা গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে পুরুষদের আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং প্রবল নির্যাতন চালায়। শেষ পর্যন্ত ধর্মগুরুদের অনুরোধে তারা ছাড়া পান।
ছাড়া পেলেও গ্রামবাসীদের মনে আতঙ্ক কাটেনি। পাকিস্তানিদের নজরদারির মধ্যেও তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধারাও নানা কৌশলে গ্রামে অবস্থান করতেন।
অক্টোবরের শেষের দিকে এক রাজাকার মুড়ি বিক্রেতার বেশে গ্রামে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পাকিস্তানি বাহিনীকে জানিয়ে দেয়। এরপর গ্রামটি ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা।
মুক্তিযোদ্ধা দিদারুল আলম বলেন, 'আমরা দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। তখনই দুদিক থেকে গ্রাম ঘেরাও করে গুলি শুরু হয়। আমরাও পাল্টা গুলি চালাই। কিন্তু তাদের ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে নদী পেরিয়ে বারইঘোনায় চলে যাই।'
মুক্তিযোদ্ধারা সরে যেতে পারলেও আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে আবুরখীলের বিভিন্ন বাড়িতে হামলা ও নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। অনেককে ক্যাম্পে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়। তবে শত নির্যাতনের মুখেও গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তথ্য ফাঁস করেননি।
সম্মুখযুদ্ধের গ্রামবাসীরা
মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার পাশাপাশি আবুরখীলের অন্তত ১০ জন যুবক সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে প্রশিক্ষণ নেন। তাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা তেমিয় কুমার মুৎসুদ্দী। তিনি বলেন, 'আমরা যারা গিয়েছিলাম, আমি ছাড়া বাকিরা সবাই মুক্তিবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছে। আমি ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে দেশের ভেতরে বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নিয়েছিলাম।'
মুক্তিযুদ্ধে আবুরখীলবাসীর অবদানের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম। তিনি বলেন, 'আবুরখীলের মানুষ আমাদের জন্য কী করেনি! খাবার, রসদ, আশ্রয়—সবই দিয়েছে। আশ্রয় দেওয়ার কারণে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তবুও আমাদের কথা ফাঁস করেনি।'
মুক্তিযোদ্ধা দিদারুল আলম বলেন, 'বাড়িতে থাকার জায়গার সংকট ছিল, তবু তারা শরণার্থী নারীদের আশ্রয় দিয়েছিল। গ্রামের নারীরা নিজেরা ঘরের ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিছানায় শোয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন। তারা যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।'