হরিহরপাড়া বধ্যভূমি: বুড়িগঙ্গা পাড়ের যে গ্রামে হত্যা করা হয় ২০ হাজার মানুষকে
'দিনভর বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে নারী-পুরুষদের ডিপোতে তুলে আনত। দিনের বেলায় পুরুষদের ওপর নির্যাতন চালাত। রাত আটটা-নয়টার দিকে চোখ বেঁধে পুরুষদের নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করত। আর ডিপোতে আটককৃত মেয়েদের ওপর চালাত পাশবিক নির্যাতন।'
গণহত্যার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী আবদুর রশিদ ভোলা মিয়ার (৮৫) চোখে অশ্রু টলমল করছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, 'যুদ্ধের সময় এমন কোনো রাত কাটেনি, যে রাতে ওরা মানুষ মারেনি বা মেয়েদের ধর্ষণ করেনি।'
ভোলা মিয়া হরিহরপাড়া গ্রামের যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণা করছিলেন, তার পেছনেই ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এনায়েতনগর ইউনিয়নে নদীর তীর ঘেঁষে যমুনা অয়েল কোম্পানির ফতুল্লা ডিপোর অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধকালে এই ডিপো ও নদীর পাড়ে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
গত অক্টোবর মাসে হরিহরপাড়া গ্রামে যান দ্য ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদক। এ সময় গণহত্যার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এক ভয়াল হত্যাযজ্ঞের বিবরণ।
বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে পাশাপাশি দুটি স্থাপনা। একটি যমুনা অয়েল কোম্পানির ফতুল্লা ডিপো, অন্যটি সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রি। একাত্তর সালে যমুনা অয়েল কোম্পানির নাম ছিল পাকিস্তান ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রির নাম ছিল ঢাকা ভেজিটেবল অয়েল মিল। মুক্তিযুদ্ধকালে বিহারিদের সহযোগিতায় এই দুটি স্থাপনাকে কেন্দ্র করে এক ভয়ংকর নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি গড়ে তোলে পাকিস্তানি বাহিনী।
গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী, সাংবাদিক ও গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর বিহারি শ্রমিক নেতাদের সহযোগিতায় এই দুটি তেলের মিলে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানি সেনাদের আগমনে হরিহরপাড়ার প্রায় তিন হাজার গ্রামবাসীর মধ্যে গুটিকয়েক বাদে বেশির ভাগই প্রাণভয়ে পালিয়ে যান। এ সময় ডিপোর একটি ভবনের বিভিন্ন কক্ষে টর্চার সেল গড়ে তোলে পাকিস্তানি বাহিনী ও বিহারিরা।
প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষকে ট্রাকভর্তি করে ডিপোতে তুলে আনত। ট্রাক থেকে নামানোর পর আটক ব্যক্তিদের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো ডিপোর ভেতরে থাকা টর্চার সেলে। দিনভর সেখানে তাদের ওপর চালানো হতো পৈশাচিক নির্যাতন।
রাত নামলেই আটক ব্যক্তিদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো নদীর তীরে। ভাটার সময় তাদেরকে হাত-পা বেঁধে নদীর হাঁটুসমান পানিতে নামাতে বাধ্য করা হতো। আর জোয়ারের সময় হলে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো ডিপোর জেটি ঘাটে। এরপর গুলি করে লাশ ফেলে দেওয়া হতো নদীতে। গুলিবিদ্ধ কেউ বাঁচার শেষ প্রচেষ্টা করলেও লাভ হতো না। কারণ, হাত-পা বাঁধা থাকায় তারা পানিতে ডুবে যেতেন। রাতের মধ্যে লাশ স্রোতের টানে ভেসে গেলেও কিছু লাশ নদীর পাড়ে পড়ে থাকত। প্রতিদিন সকালে গ্রামবাসীদের দিয়ে সেই লাশ সরাতে বাধ্য করত সেনারা।
বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা নারীদের রাখা হতো তেলের ডিপোর গুদামের কয়েকটি বদ্ধ কক্ষে। সেখানে দিনের পর দিন তাদের ওপর চলত ধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতন। অনেক নারীকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিত সেনারা।
গণহত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ভোলা মিয়া বলেন, 'প্রতিদিন রাতে কমপক্ষে ৭০-৮০ জন মানুষকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলা হতো। কখনো কখনো এক-দুই শ মানুষকেও হত্যা করেছিল তারা। জোয়ারের পানিতে নয়তো স্রোতের টানে কিছু লাশ ভেসে যেত। আর ভাটার সময় ওগুলো পড়ে থাকত, পরদিন সকালে আমরা সেই লাশ মাঝনদীতে ফেলে দিয়ে আসতাম।'
লাশ সৎকারের বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলা মিয়া বলেন, 'সে সময় লাশ দাফনের মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না। আমরা যে কয়েকজন গ্রামে ছিলাম, তারাই প্রতিদিন সকালে লাশ টানতাম। প্রতিদিনই দেখতে পেতাম শকুন, কুকুর আর শেয়ালে টেনেহিঁচড়ে লাশ খাচ্ছে।'
হরিহরপাড়ার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ সোলায়মান (৮০) বলেন, 'ডিপোতে ওরা যে নারীদের ধর্ষণ করত তাদের চিৎকারে আমরা ঘুমাতে পারতাম না।'
সোলায়মান আরও বলেন, 'যুদ্ধের আগে নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত, কিন্তু যুদ্ধের সময় সব জায়গায় লাশ ভেসে উঠতে থাকায় কেউ নদীতে মাছ ধরতে যেত না।'
হরিহরপাড়া ও পার্শ্ববর্তী ফাজিলপুর গ্রামের একাধিক প্রবীণ বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যুদ্ধের প্রথম দিকে মাসখানেক অয়েল ডিপোতে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ ছিল। একপর্যায়ে তেল সরবরাহ চালু হয়। ৩ ডিসেম্বর অপারেশন কিলো ফ্লাইটের সদস্যদের নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে ইউএসএসওর তেলের ডিপোতে বিমান হামলার আগপর্যন্ত প্রতিদিনই এখানে তেলবাহী জাহাজ আসত এবং পাইপের মাধ্যমে তেল খালাস চলত। ফাজিলপুরের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন বলেন, 'দিনের বেলায় তেল খালাস হতো আর রাত হলেই মানুষ মারত।'
একই অবস্থা ছিল পার্শ্ববর্তী ঢাকা ভেজিটেবল অয়েল মিলেও। বিল্লাল হোসেন বলেন, 'সেখানেও দিনভর উৎপাদন চলত। বিহারিরা সেই মিলেও টর্চার সেল তৈরি করেছিল।' গ্রামবাসীরা জানান, যুদ্ধকালীন দুটি মিলেই অনেক বিহারি শ্রমিক কাজ করতেন।
ফতুল্লার ফাজিলপুর বউবাজার এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ রফিক (৭৫)। পেশায় মুদিদোকানি এই প্রবীণ বলেন, 'যুদ্ধ শেষের দুই মাস পরেও আমরা নদীতে প্রচুর পচা লাশ পেয়েছি। কেউ নদীতে নামতে চাইত না।'
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির বিভিন্ন সেল থেকে জীবিতাবস্থায় অনেক নারীকে উদ্ধার করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
হরিহরপাড়ায় এত বড় পরিসরে গণহত্যা সংঘটিত হলেও এই বধ্যভূমিটি এখনো আড়ালেই রয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা মোহাম্মদ হানিফ বলেন, 'নারায়ণগঞ্জের বড় গণহত্যা বা বধ্যভূমি বলতে আমি বক্তাবলী, আলীগঞ্জের গণহত্যা, আদমজীর শিমুলপাড়ার বধ্যভূমি সম্পর্কেই জানি। কিন্তু হরিহরপাড়ায় যে এত অধিকসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তা অজানা ছিল।'
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি হরিহরপাড়া গণহত্যা নিয়ে 'দ্য কিলিং অ্যাট হরিহরপাড়া' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মার্কিন দৈনিক দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। পুলিৎজারজয়ী সাংবাদিক লুইস এম সাইমনস সেই প্রতিবেদনে লিখেছেন, হরিহরপাড়ায় অন্তত ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি হরিহরপাড়া গ্রামে গিয়েছিলেন তিনি। এ সময় গ্রামবাসী, থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওসিসহ অনেকের সঙ্গে তার কথা হয়।
প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় সাইমনস লিখেছেন, 'পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষকে আটক করে হরিহরপাড়ার ন্যাশনাল অয়েল মিলে তুলে আনত। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সেনারা আটককৃত বাঙালিদের গ্রামের নদীর তীরে নিয়ে যেত। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাদের হাঁটুসমান পানিতে নামতে বাধ্য করা হতো। এরপরই পাকিস্তানি ফায়ারিং স্কোয়াডের সেনারা ব্রাশফায়ার শুরু করত।'
প্রতিবেদনে লুইস সাইমনস আরও লিখেছেন, 'গুলির সঙ্গে আত্মচিৎকারে রাতের আকাশ বিদীর্ণ হয়ে উঠত। ভোর পর্যন্ত এভাবেই হত্যাযজ্ঞ চলত। প্রতিদিন সকালে গ্রামের মাঝিদের নদীতে নামিয়ে লাশ সরিয়ে মাঝনদীতে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হতো।' আত্মসমর্পণের আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরিহরপাড়ায় গণহত্যা চলেছিল বলে উল্লেখ করেছেন লুইস এম সাইমনস।
হরিহরপাড়া গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণে পরবর্তী সময়ে যমুনা অয়েল ডিপোর প্রধান ফটকের পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
স্থানীয় গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, হরিহরপাড়ার নদীর পাড়ে যেখানে প্রতিনিয়ত গণহত্যা চালানো হয়েছে, সেখানেই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা উচিত ছিল। কিন্তু বধ্যভূমি করা হয়েছে ডিপোতে ঢোকার মুখে। এখনো চাইলে জায়গাটি অধিগ্রহণ করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা সম্ভব। এর মধ্য দিয়ে গণহত্যার নির্মম ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় ত্যাগ সম্পর্কে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে।