রক্তস্বল্পতা বা দুর্বলতা প্রতিরোধে কলিজা কি আসলেই উপকারী

তাফহিমাহ জাহান নাহিন
তাফহিমাহ জাহান নাহিন
28 October 2025, 13:45 PM
UPDATED 28 October 2025, 19:58 PM

বাংলাদেশে গরু, ছাগল, মুরগি বা হাঁসের কলিজা (লিভার) খুব জনপ্রিয় একটি খাবার। বিশেষ করে রক্তস্বল্পতা বা দুর্বলতার সময়ে এটি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কলিজা অত্যন্ত পুষ্টিকর প্রাণীজ খাদ্য। কারণ এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার প্রোটিন, লোহা (আয়রন), ভিটামিন এ, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, জিঙ্ক ও ফলিক এসিড।

কলিজার পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে জানিয়েছেন এমএইচ সমরিতা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ আঞ্জুমান আরা শিমুল

তিনি জানান, কলিজা বা যকৃত হচ্ছে প্রাণীজ খাবারের মধ্যে অন্যতম পুষ্টিগুণে ভরপুর অঙ্গ। একে অনেক সময় ন্যাচারস মাল্টিভিটামিন বলা হয়। কারণ এতে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি।

কলিজার পুষ্টি উপাদান

প্রতি ১০০ গ্রাম রান্না করা গরু বা ছাগলের কলিজায় গড়ে থাকে:

প্রোটিন ২৫–২৮ গ্রাম, যা পেশি গঠন ও কোষ মেরামতে সহায়ক।

ভিটামিন এ (রেটিনল) প্রায় ১৫–৩০ হাজার আইইউ, যা চোখের দৃষ্টি, ত্বক, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।

ভিটামিন বি১২ অত্যন্ত বেশি (৩০০–৮০০ শতাংশ আরডিএ), যা রক্ত তৈরিতে সহায়ক, স্নায়ু সুস্থ রাখে।

ফোলেট (বি৯) ১৫০–২০০ মাইক্রোগ্রাম, গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ।

আয়রন (আয়রন) ৬–১০ মিলিগ্রাম (হেম আয়রন) রক্তস্বল্পতা রোধ করে, শক্তি বাড়ায়।

জিঙ্ক, কপার, সেলেনিয়াম পর্যাপ্ত ইমিউনিটি, হরমোন ব্যাল্যান্স, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভূমিকা রাখে।

কো-এনজাইম কিউ ১০ কিছু পরিমাণে হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

কোলিন ৩৫০–৪০০ মিলিগ্রাম, লিভার ফাংশন, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর জন্য প্রয়োজনীয়।

কলিজার প্রধান পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা

১. রক্তস্বল্পতা দূর করে

কলিজায় থাকা হিম আয়রন খুব সহজে শরীরে শোষিত হয়, যা রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায় এবং অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে।

২. চোখের দৃষ্টি রক্ষা করে

এতে থাকা উচ্চমাত্রার ভিটামিন এ (রেটিনল) চোখের দৃষ্টি শক্তি বজায় রাখে এবং নাইট ব্লাইন্ডনেস (রাতকানা) প্রতিরোধে সাহায্য করে।

৩. দেহের শক্তি ও পেশি গঠনে সহায়ক

প্রোটিনের ভালো উৎস হওয়ায় এটি মাংসপেশি ও কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে।

৪. স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়

ভিটামিন বি১২, বি৬ এবং ফলিক অ্যাসিড স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৫. রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

জিঙ্ক ও ভিটামিন এ শরীরের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে।

৬. ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে

ভিটামিন এ ও প্রোটিন ত্বক মসৃণ রাখে এবং চুল পড়া কমাতে সহায়ক।

কলিজা খাওয়া যাদের জন্য উপকারী

  • রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া রোগীর শরীরে হেম আয়রন ও বি১২ তৈরিতে সহায়তা করে কলিজা, যা দ্রুত রক্ত তৈরিতে কাজ করে।
  • শিশু ও কিশোর-কিশোরীর মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে।
  • পোস্টমেনোপজাল নারীর আয়রন ও বি১২ ঘাটতি পূরণ করে।
  • দুর্বল, ক্লান্ত বা অপুষ্ট রোগীর শক্তি ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
  • ভিটামিন বি কমতি রোগীর নিউরোপ্যাথি ও মুখে ঘা তে দ্রুত উপকার দেয়।

কোন প্রাণীর কলিজা সবচেয়ে উপকারী?

গরুর কলিজা: সবচেয়ে পুষ্টিকর। এতে ভিটামিন এ, বি ১২, আয়রন বেশি পরিমাণে থাকে। অ্যানিমিয়া, দুর্বলতা, শক্তি কম থাকলে গরুর কলিজা উপকারী।

ছাগলের কলিজা: সবচেয়ে হালকা ও হৃদযন্ত্রবান্ধব। এটি হালকা, চর্বি কম, আয়রন ও জিঙ্ক সমৃদ্ধ উচ্চ কোলেস্টেরল বা ডায়াবেটিসে তুলনামূলক নিরাপদ।

মুরগির কলিজা: হজমে সহজ, শিশুর জন্য উপযুক্ত। মুরগির কলিজায় ভিটামিন এ ও ফোলেট বেশি। শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও দুর্বলদের জন্য উপযোগী।

হাঁসের কলিজা: ফ্যাট বেশি, মাঝে মাঝে খাওয়া ভালো, নিয়মিত নয়।

যাদের কলিজা খাওয়া নিষেধ বা সীমিত

যাদের উচ্চ ভিটামিন 'এ'-এর স্তর বা হাইপারভিটামিনোসিস থাকে, তাদের কলিজা খাওয়া নিষেধ। কারণ কলিজায় ভিটামিন 'এ' প্রচুর পরিমাণে থাকে। ফলে বিষক্রিয়া হতে পারে।

উচ্চ ইউরিক অ্যাসিড বা গাউট বা কিডনি রোগে কলিজা খেতে নিষেধ করা হয়। কারণ কলিজায় পিউরিন বেশি, ইউরিক অ্যাসিড বাড়ায়।

যাদের রক্তে চর্বি ও কোলেস্টেরল বেশি, ফ্যাটি লিভার, হার্ট ডিজিজ আছে, তাদের গরু ও হাঁসের কলিজা খেতে নিষেধ করা হয়। কারণ কলিজা কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ।

অন্তঃসত্ত্বা নারীর (প্রথম তিন মাস) ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভিটামিন 'এ' ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে। তাই অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় প্রথম তিন মাস কলিজা খেতে মানা করা হয়।

কলিজা হজমে লিভারের ওপর চাপ ফেলে। তাই লিভার সিরোসিস বা হেপাটাইটিস রোগীর ক্ষেত্রে এটি খাওয়া নিষেধ।

খাওয়ার পরিমাণ ও পরামর্শ

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সপ্তাহে ১–২ বার (৭০–১০০ গ্রাম) যথেষ্ট।

অন্তঃসত্ত্বা নারী কিংবা কিডনি বা হৃদরোগীদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিয়মিত নয়।

রান্না অবশ্যই ভালোভাবে করতে হবে। আধাসেদ্ধ বা কাঁচা কলিজা খাওয়া বিপজ্জনক। এতে ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।