আইনি আদালতের আগে জনতার আদালতেই পরাজিত শেখ হাসিনা

মাহফুজ আনাম
মাহফুজ আনাম
21 November 2025, 02:41 AM
UPDATED 21 November 2025, 10:27 AM

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) বিচারে শক্তিশালী অংশ বা দুর্বলতা কী—সেগুলো নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করবেন। আমাদের আলোচনার বিষয় হলো, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পতন এবং জনগণের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে তিনি 'দোষী সাব্যস্ত' হয়েছে অনেক আগে—২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সেই অভ্যুত্থানের দিনগুলোতেই।

ভবিষ্যৎ সবসময়ই অনিশ্চিত। কিন্তু বর্তমানে তার খ্যাতি ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে; তার রাজনৈতিক জীবন দাফন হয়ে গেছে অহংকার, আত্মম্ভরিতা, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও পুলিশ-প্রশাসনকে মাথায় তুলে রাখার সংস্কৃতির নিচে। হাসিনার পতনের কারণ হিসেবে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের যে ব্যাখ্যাই আওয়ামী লীগ দিক, বাস্তবতা হলো আইসিটি ঘোষিত 'মৃত্যুদণ্ড' মূলত তিনি নিজেই ডেকে এনেছিলেন রাজনৈতিক ভিন্নমতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন, আইনের অপব্যবহার, দুর্নীতি, দলীয়করণ করে প্রশাসন পরিচালনা, ব্যাংক লুট, অর্থপাচার, স্বাধীন গণমাধ্যমকে দমন ও অনুগতদের দুর্নীতিতে প্রলুব্ধ করা এবং শেষ দিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শিশুসহ অন্তত ১ হাজার ৪০০ নাগরিককে হত্যা করে। বছরের পর বছর গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তার শাসনামলের পরিচায়কে পরিণত হয়েছিল। হ্যাঁ, কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও বেশকিছু সামাজিক সূচকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্র ধ্বংস করা ও অপ্রতিরোধ্য স্বৈরাচারী শাসনের কারণে সেসব কৃতিত্ব সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা একেবারে ধসে পড়ে এবং তার প্রতি ঘৃণা আকাশচুম্বী হয়ে উঠে। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষকে হত্যা করায় জনগণের আদালতে তার 'মৃত্যুদণ্ড' ঘোষিত হয় বহু আগেই। অনেক স্বৈরশাসক ও একনায়কের তুলনায় তার শাসনামলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এতো অল্প সময়ে এত বিপুলসংখ্যক নিরস্ত্র প্রতিবাদকারীকে হত্যা করার নজির খুব কমই আছে।

হাসিনার কৃতিত্ব হলো, ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর দলকে পুনর্গঠিত ও পুনরুজ্জীবিত করে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী করতে পেরেছিলেন। প্রথম মেয়াদে বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (যা তিনি নিজেই বাস্তবায়ন করেননি) ও গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি আওয়ামী লীগের জন্য নতুন যুগের সূচনা করেছিল। কিন্তু বছর গড়িয়ে তিনি কার্যত নিজের দলকেই ধ্বংস করেন—যেভাবে তিনি পুলিশ, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থাকেও ধ্বংস করেছেন। দলকে তিনি রূপান্তরিত করেন এক রাজনৈতিক শক্তিকেন্দ্র থেকে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও সহিংসতার যন্ত্রে। আদর্শের জায়গায় তোষামোদ, নীতির জায়গায় নেতার প্রশস্তি, আর জনগণের সেবা করার পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথে ধাবিত হন। প্রতিটি মনোনয়ন বিক্রি করা হয়েছে, দলীয় পদোন্নতি হয়েছে ঘুষের বিনিময়ে এবং সব উন্নয়ন প্রকল্পকে মনে করত নিজেদের সম্পত্তি। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনটি কীভাবে হত্যায় লিপ্ত এক দলে পরিণত হয়েছিল তার অকাট্য প্রমাণ হলো বুয়েট শিক্ষার্থী আবরারের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন ও হত্যা।

১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচন দুটিতে আওয়ামী লীগের পরাজয় তিনি মেনে নিতে পারেননি। তার বিশ্বাস, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ কখনোই হারে না; আওয়ামী লীগ তখনই হারে, যখন কারচুপির মাধ্যমে তাদের হারানো হয়। তিনি সেই নির্বাচনগুলোতে 'সূক্ষ্ম কারচুপি' হয়েছে দাবি তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন। এখান থেকেই শুরু হয় তার অহংকার ও সংকীর্ণতার—যা থেকে তিনি সত্যকে অগ্রাহ্য এবং ভয়াবহ ভুল করতে থাকেন।

২০০৪ সালের আগস্টে প্রাণঘাতী গ্রেনেড হামলা থেকে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নিহত হন। এই হামলার তদন্ত বা বিচারের কোনো বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নেয়নি তৎকালীন বিএনপি সরকার। সেখান থেকে হয়তো হাসিনা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, বিরোধীদলে থাকলে তিনি সবসময় ঝুঁকিতে থাকবেন এবং একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে আর কখনো ছাড়বেন না। আমাদের দৃষ্টিতে, এখান থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু শুরু।

২০০৮ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন হাসিনা। এরপর কারচুপির মাধ্যমে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফল নিজের মতো করে নেন। প্রতিবার কারচুপির পর তার আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে এবং তিনি মনে করতে থাকেন যে রাজনৈতিক মিত্ররা তার ঘুঁটি, প্রতিপক্ষ সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং ভিন্নমত খুব সহজেই দমন করা সম্ভব। তিনি ভুল স্বীকার না করার মানসিকতায় আটকে যান এবং সীমাহীন অহংকারী হয়ে উঠেন।

২০১৩ সালে সম্পাদকদের এক বৈঠকে তাকে বলতে শুনেছিলাম, 'আমাকে হত্যার এত চেষ্টা সত্ত্বেও আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তার ইচ্ছা পূরণের জন্য। কাজেই আপনারা যা খুশি লিখুন, আমি পরোয়া করি না।' তিনি মনে করতেন, স্রষ্টাই তাকে পথ দেখাচ্ছেন, তাই চিন্তার কিছু নেই। এভাবে তিনি একদিকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, অপরদিকে হয়ে ওঠেন আরও অসহিষ্ণু। ফলে, তিনি জনগণ ও নিজ দলের কাছ থেকে দূরে সরে যান।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে সংবিধান পরিবর্তন করার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হলো যে হাসিনা জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিজের হাতে তুলে নিতে যাচ্ছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রকাশ্যে নির্লজ্জ কারচুপি করা হয় এবং সেটা ছিল সবার সামনে একেবারে স্পষ্ট। আমরা আগেও লিখেছি, কিন্তু আবার উল্লেখ করা প্রয়োজন—৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে একক প্রার্থী ছিলেন, কারণ বাকিরা 'স্বেচ্ছায়' সরে দাঁড়ান। ফলে নির্বাচন কমিশন সেই একক প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে, যারা সবাই আওয়ামী লীগের। অর্থাৎ ২০১৪ সালের নির্বাচনে একটি ভোটও না পড়ার আগেই সরকার গঠনের জন্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। এটি ছিল নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেপরোয়া, অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক হস্তক্ষেপ। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছাড়া এটা কি সম্ভব?

হাসিনা সরকার এ ধরনের নির্বাচনী জালিয়াতি করে পার পেয়ে যাওয়ায়—যেখানে বিএনপির কার্যকর প্রতিবাদ না করার ব্যর্থতাও রয়েছে—তিনি ও তার তোষামোদকারীরা বিপজ্জনক কিন্তু ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাসে চাঙ্গা হয়ে যায়। এই আত্মবিশ্বাসই ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবারও কারচুপি করতে তাদের প্ররোচিত করে এবং শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই নিজেদের খোঁড়া গর্তে পড়ে যায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে।

২০২০-২০২২ সাল পর্যন্ত করোনা মহামারির সময় তিনি দল ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজকর্ম একটি অচিন্তনীয় রীতিতে পরিণত হয়েছিল। এর মধ্যেই ২০২০ সালে আসে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জাঁকজমকপূর্ণ এবং নিদারূণ অপচয়পূর্ণ আয়োজন। সচেতন নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের মনে এই আয়োজন গভীর আঘাত দেয়। সেখান থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে জনগণের জরুরি প্রয়োজনগুলো প্রধানমন্ত্রীর চিন্তায় জায়গা পায়নি। বরং তার সরকারের সব মনোযোগ ও সম্পদ ব্যয় হয়েছে ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতিতে।

জাতির মনস্তত্ত্ব ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে, কিন্তু হাসিনা উল্টো পথে হেঁটেছেন। অসংখ্য অখ্যাত লেখক হাজার হাজার বই লিখলেন, আর সরকার অস্বাভাবিক উচ্চ দামে সেগুলো কিনলো। এগুলোই হয়ে ওঠে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা, শিক্ষক ও কথিত পেশাজীবীদের কাছে সরকারি অর্থ লুটের নতুন পথ। তারা সবাই যেন প্রতিযোগিতায় নামলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের তোষামোদ করে নিজেরাও কিছু অর্থ উপার্জনে।

জন্মশতবার্ষিকীর এত বড় আয়োজনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতা সম্পর্কে একটি ভালো ও গবেষণানির্ভর বর্ণনাও উঠে আসেনি। বরং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে দেওয়া হয় নিম্নমানের প্রকাশনা, যেগুলোর মূল্য কাগজের সমানও না। বঙ্গবন্ধুর শত শত ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে, যেগুলো তার সম্পর্কে সত্যিকারের জ্ঞান বাড়ানোর বদলে উল্টো সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। সরকারিবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে সেই ভাস্কর্যগুলোই সবার আগে হয়ে ওঠে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।

ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটা প্রথমবার দেখেই আমার মনে ভেসে উঠেছিল সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি ভেঙে টেনে নেওয়ার সেই দৃশ্য। অন্তর্দৃষ্টি বলছিল, সুযোগ পেলেই এ দেশের মানুষ এগুলো ছুঁড়ে ফেলবে।

এরপর আসে ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির উদযাপন। হাসিনা এই গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনটিও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের ধারাবাহিকতা হিসেবে উদযাপন করেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে কত সামান্য; তাদের ত্যাগ, বীরত্ব ও দেশপ্রেমের গল্পগুলো হয়েছে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। সশস্ত্র বাহিনীর যে বিদ্রোহী সদস্যরা তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে কার্যকর যুদ্ধশক্তিতে রূপান্তরিত করতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদেরও তেমন কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় ভূমিকাও আলোচনার বাইরে রয়ে যায়। সবকিছু আবারও এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে দাঁড়ায়। জীবিত মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধে নিহতদের পরিবার অপমানিত বোধ করেন।

দম্ভ আর দূরদৃষ্টিহীনতার আরেকটি উদাহরণ হলো—হাসিনা প্রত্যেক সরকারি অফিস, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও, ব্যাংক, বিমানবন্দরসহ সব জায়গায় 'মুজিব কর্নার' চালু করতে বাধ্য করেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি ও বই রাখা হয়, যেসব বইয়ের অধিকাংশই নিম্নমানের। অথচ এর বদলে যদি তিনি 'মুক্তিযোদ্ধা কর্নার' চালুর নির্দেশ দিতেন এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সব ধরনের বই রাখা হতো, তাহলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম আমাদের জীবনের সেই গৌরবময় অধ্যায় সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন ও শিক্ষিত হতে পারত।

বাস্তবতা হলো—১৫ বছরের শাসনামলে হাসিনা সরকার জনগণের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে কার্যত কিছুই করেনি। উল্টো এটাকে পরিণত করেছিল 'মুজিব পূজা'য়, যা দিনশেষে মানুষের মনে ঘৃণা ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে।

২০২২ সালের মধ্যে হাসিনার দম্ভ চরমে পৌঁছায়। 'আমি সব জানি', 'সমালোচক মানেই শত্রু', 'আমি যা করি সেটাই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো' এবং একই ধরনের বক্তব্য রাজনৈতিক আলোচনায় প্রাধান্য পেতে থাকে। তোষামোদ এমন অযৌক্তিকতায় পৌঁছে যায় যে দলীয় নেতাকর্মীরা সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করেন, এমন কোনো সমস্যা নেই যা তাদের নেত্রী সমাধান করতে পারেন না, এমন কোনো চ্যালেঞ্জ নেই যা তিনি মোকাবিলা করতে পারবেন না। এই পরিবেশে দলীয় সুযোগসন্ধানীরা একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে নেত্রীর তোষামোদে। এভাবেই হাসিনা ও তার আশপাশের লোকজন বাস করতে থাকেন নিজেদের তৈরি এক অযৌক্তিক বুদবুদে।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হাসিনা ও তার সরকারের আচরণ স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে তার দল ও সরকার কতটা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। একপর্যায়ে তিনি হঠাৎ ঘোষণা দেন, সব কোটা বাতিল। অথচ, এই সিদ্ধান্ত প্রতিবন্ধী, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তি, জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য চাকরির কোটায় সাংবিধানিক নিশ্চয়তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। ফলে উচ্চ আদালত তা বাতিল করে দেন। এভাবে কোটা সংস্কারের দাবি ঝুলে থাকে।

এই পর্যায়ে তিনি চাইলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়টি সমাধান করতে পারতেন। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাইয়ে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে এবং ১৬ জুলাই থেকে রাস্তায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিকরা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মরদেহের সংখ্যা গুনেছেন। ২০২৪ সালের ১ আগস্ট পর্যন্ত তারা ২০১টি মরদেহ গণনা করেছেন এবং প্রিয়জন হারানো শত শত পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমরা প্রতিদিন যাচাই করা মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে দিনের প্রধান প্রতিবেদন ও শিরোনাম করেছি।

অসংখ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও হাসিনা দাবি করেছেন, তিনি আন্দোলনকারীদের ওপর গুলির নির্দেশ দেননি। যদি তিনি সত্যিই এই নির্দেশ না দিয়ে থাকেন, তাহলে গুলি চালানো শুরু হলে সেটা বন্ধের নির্দেশ দেননি কেন? গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই দেখা যাচ্ছিল আগের দিন কতজনের মৃত্যু হয়েছে। যদি তিনি সত্যিই হত্যার নির্দেশ না দিয়ে থাকেন, তাহলে কেন তাৎক্ষণিকভাবে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধের নির্দেশ দেননি? কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন রাস্তায় গুলি চলছে, সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, অথচ প্রধানমন্ত্রী সেটা জানেন না—এটা কেউ কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারবে না, এটা বিশ্বাস করার কোনো সুযোগই নেই। তিনি জানতেন এবং তিনিই নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই এ নৃশংস অপরাধগুলোর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং গুলি চালানোর 'হুকুম' দেওয়ায় তিনিই দায়ী।

আইনি দিকটি একপাশে রেখে বিবেচনা করলেও যারা সেই ভয়াবহ দিনগুলো স্বচক্ষে দেখেছেন, ঘটনাগুলো নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, সেগুলো নিয়ে লিখেছেন, সরকারকে সতর্ক করেছেন—তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে সরকারপ্রধান হিসেবে হাসিনা নিজ জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার